ক্লাস, পরীক্ষা বন্ধ হলে দায়ভার নেবে না শিক্ষকরা

এম এইচ ইমরান |

সর্বজনিন পেনশনের প্রত্যয় স্কিমে শিক্ষকদের অন্তুর্ভুক্ত করা হলে অধ্যাপকরা অবসরের পর এককালীন অর্থ পাবেন না। এ ছাড়া প্রত্যয় স্কিমে বেতন থেকে পেনশন বাবদ ১০ শতাংশ কাটা হবে। এটা শিক্ষকদের জন্য অবমাননাকর, অবজ্ঞামূলক ও চরম বৈষম্যমূলক। যেখানে নতুনদের জন্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করার কথা, সেখানে উল্টো তাদের সুযোধ-সুবিধা কেটে নিম্নতর অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

এ অভিমত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. জিনাত হুদার। আজ থেকে সারাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষা ও ক্লাস বর্জনসহ সর্বাত্মক কর্মবিরতি শুরুর প্রাক্কালে দৈনিক আমাদের বার্তাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাতকারে তিনি এ কথা বলেন।

জিনাত হুদা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য কালকেও দেখলাম। উনি সুস্পষ্টই বলেছেন, যারা বর্তমানে পেনশন পাচ্ছেন সর্বজনিন পেনশন স্কিম তাদের জন্য নয়। যারা প্রান্তিক পর্যায়ে আছেন তাদের জন্য। কিন্তু, অর্থ মন্ত্রণালয় সবাইকে অবাক করে ১৩ মার্চ একটা প্রজ্ঞাপন দিলো। তাতে বলা হলো, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো এর আওতাভুক্ত থাকবে। আমরা তো বিদ্যমান পেনশনের অধীনেই আছি। তাহলে কেনো আমাদেরকে একটা নতুন পেনশন স্কিমে আনা হচ্ছে।

তিনি বলেন, একজন নবীন প্রভাষক চলতি বছরের ৩০ জুন শিক্ষক হিসেবে প্রবেশ করলেন। আর অন্যজন ১ জুলাই। প্রথমজন বিদ্যমান ব্যবস্থায় পেনশন এবং বোনাসগুলো পাবেন। আর দ্বিতীয়জনের বোনাস, গ্র্যাচুইটি, পেনশন, ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধাগুলো হবে পুরো ভিন্নরকম। একই রাষ্ট্রে একই প্রতিষ্ঠানে একই বিভাগে একই পদে কর্মরতদের জন্য দুটো আইন কি চলতে পারে? এটি সংবিধানের সঙ্গে, আমাদের সমতাভিত্তিক যে চেতনা তারা সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং চরম বৈষম্যমূলক।

জিনাত হুদা বলেন, শুধু নবীন নয়, জুলাই থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন যেসব শিক্ষকরা প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী অধ্যাপক থেকে সহযোগী অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হবেন তারা সকলেই প্রত্যয় স্কিমের অধিনে যাবেন। তাদের ভাতা-পেনশন সবই নিম্নমুখী হবে।

তিনি বলেন, কারো সঙ্গে কথা না বলেই তারা নতুন একটা স্কিম নিয়ে এসেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একটি স্বায়ত্তশাসিত প্রাতিষ্ঠান। নতুন কোনো আইন প্রয়োগ করতে হলে অবশ্যই আমাদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। বিদ্যমান পেনশন স্কিমকে কেটে পঙ্গু বানিয়ে নতুন স্কিম করা হয়েছে। যা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি হস্তক্ষেপ। এটাতো দ্বৈত নীতি। লর্ড কর্নওয়ালিসরা এটা করেছে। আধুনিক ব্যবস্থায় কি এটা হতে পারে? আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতি নির্ধারণী ফোরাম সিনেটে ‘প্রত্যয়’ স্কিমকে প্রত্যাখ্যান করে দিয়েছি। 

তিনি আরো বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা অবসরে যান ৬৫ বছর বয়সে। আর সরকারি চাকরিজীবীরা ৫৯ বছর বয়সে। তাহলে যারা প্রত্যয় স্কিমে যুক্ত হবেন তারা কি ৫৯ বছর বয়সে অবসরে যাবেন? তোমার ইচ্ছা হলো তুমি আমাদের বোনাস কাটবা, তোমার ইচ্ছা হলো তুমি আমাদের পেনশন কাটবা, তোমরা ইচ্ছা হলো তুমি আমাদের বয়স কেটে দেবে। এটা বিশ্ববিদ্যারয়ের স্বায়ত্তশাসনের প্রতি হস্তক্ষেপ। অর্থনৈতিকভাবে শিক্ষকেরা এটা ভঙ্গুর অবস্থানে রয়েছেন। এর মাধ্যমে সামাজিকভাবে শিক্ষকদের অবস্থান আরো অবনমন হবে।

এ স্কিম প্রত্যাহারের পাশাপাশি আপনাদের আরো কোনো দাবি আছে কি না-এমন প্রশ্ন করলে তিনি বলেন, আমাদের আরো দুটি দাবি আছে। একটি হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সুপারগ্রেডের অন্তর্ভুক্তকরণ এবং দ্বিতীয়ত একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তন করতে হবে। এর মাধ্যমে আমাদের সামাজিক মর্যাদা, অর্থনৈতিক স্থিতিশীল অবস্থা এবং মানসিক স্বস্তি থাকবে। যদি তা না হয় তাহলে দেশের মেধাবীরা এই পেশায় আগ্রহ হারাবেন। পয়সা কড়ির জন্য বিশ্বদ্যিালয়ের শিক্ষকেরা শিক্ষকতায় আসেন না। কিন্তু যা কিছু আছে তাও কেটে দেবেন, তাহলে তো আরো আসবেন না।  

অধ্যাপক জিনাত বলেন, সেই মার্চ মাস থেকেই আমরা প্রতিবাদ, স্বাক্ষর গ্রহণ কর্মসূচি করে তা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো, আবার মূল্যায়ন রিপোর্ট তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়সহ সব জায়গায় পাঠিয়েছি। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় আজকে পর্যন্ত প্রশাসনের কোনো পর্যায় থেকে আমাদের সঙ্গে বসবার, আলাপ-আলোচনা করার আগ্রহ দেখালো না। উনারা কি ঘুমাচ্ছেন? উনারা কি বুঝতে পারছেন না যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো গর্জে উঠলে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হবে? কেউ কি চাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলতে? প্রধানমন্ত্রীও দুদিন আগে বলেছিলেন, তোমরা আমাকে একাকী করে দিচ্ছ। কারা প্রধানমন্ত্রীকে শিক্ষকদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছেন?

শিক্ষকদের টানা কর্মবিরতির ঘোষণায় করোনার মতো সেশন জটের শঙ্কা দেখা দেবে কি না এমন প্রশ্নে করলে ড. জিনাত হুদা বলেন, আমারা আলাপ-আলোচনায় বিশ্বাস করি। এটার যদি একটা ইতিবাচক  সমাধান হয় তাহলে তো কোনো সমস্যা নেই। যদি শেষ পর্যন্ত কোনো ইতিবাচক সমাধান না হয় তাহলে আমরা সর্বাত্মক আন্দোলনে যেতে বাধ্য হবো। এর ফলে ক্লাস, পরীক্ষা, রেজাল্ট বন্ধ হয়ে যাবে। এর দায়ভার শিক্ষকেরা নেবে না। এটা পরিষ্কার। এর দায় অর্থমন্ত্রণালয় এবং এই বৈষম্যমূলক স্কিমের সঙ্গে যারা সংশ্লিষ্ট রয়েছেন তাদেরকে দায় নিতে হবে। তারা তার জবাবদিহিতা করবে। আর আন্দোলনে যেটুকু ক্ষতি হবে আমরা তা পুষিয়ে নিতে পারবো। আমরা পূর্বেও তার মোকাবিলা করেছি।  

গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সম্ভাব্য সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে ড. জিনাত হুদা বলেন, এ বিষয়ে আমি কিছু শুনিনি। যদি তাই হয় আমরা সাধুবাদ জানাই। আমরা আহ্বানে সাড়া দেবো। যুক্তি দিয়ে বোঝাবো। তথ্য-উপাত্ত দেখবো। আমরা আলাপ-আলোচনা করতে ইচ্ছুক।

প্রসঙ্গত, দেশের উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় সব নাগরিককে সম্পৃক্ত এবং সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম চালু করেছে সরকার। এরপর অনেকটা হুট করেই চলতি বছরের ১৩ মার্চ সর্বজনীন পেনশনে যোগ করা হয় ‘প্রত্যয়’ নামের একটি নতুন স্কিম। নতুন এ স্কিমে বলা হয়, দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকসহ দেশের স্ব-শাসিত, স্বায়ত্তশাসিত, রাষ্ট্রায়ত্ত, সংবিধিবদ্ধ বা সমজাতীয় প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ কর্মীদের বাধ্যতামূলকভাবে এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত হতে হবে। এতেই অর্থমন্ত্রণালয়ের ওপর চটেছেন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।

নতুন এ স্কিমকে বৈষম্যমূলক এবং শিক্ষকদের প্রতি অবমাননাকর আখ্যা দিয়ে সর্বাত্মক আন্দোলনে নেমেছেন তারা। প্রত্যয় স্কিম প্রত্যাহার, পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখা, সুপার গ্রেডে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অন্তর্ভুক্তি এবং শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র বেতন স্কেল প্রবর্তন কার্যকর করার দাবিতে কয়েক ধাপে সংবাদ সম্মেলন, মানববন্ধন, অর্ধ-দিবস কর্মবিরতির মতো কর্মসূচি পালন করেছেন শিক্ষকরা।

দাবি আদায়ে গতকাল রোববার পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করেন শিক্ষকেরা। শিক্ষক নেতারা আগেই ঘোষণা দিয়ে রেখেছিলেন, ৩০ জুনের মধ্যে দাবি আদায় না হলে আজ সোমবার থেকে সবাত্মক কর্মবিরতি শুরু হবে। এর আওতায় আজ থেকেই সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষকরা ক্লাস-পরীক্ষা বর্জনসহ সর্বাত্মক কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন। তাদের পাশাপাশি পৃথক কর্মসূচিতে কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন কর্মকর্তা আর কর্মচারীরাও।   

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি - dainik shiksha শিক্ষা ব্যবস্থাপনায় ধর্মীয় শিক্ষা বাধ্যতামূলক করার দাবি কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় - dainik shiksha কারিগরি শিক্ষকদের অক্টোবর মাসের এমপিওর চেক ছাড় সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা - dainik shiksha সরকারি কর্মচারীদের ৯ দফা নির্দেশনা স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার - dainik shiksha স্কুল-কলেজে বেতন ছাড়া সব ফি বেঁধে দিলো সরকার সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha সব শিক্ষকের স্বার্থ সংরক্ষণ করে বদলির নীতিমালা : সাক্ষাৎকারে শিক্ষা উপদেষ্টা ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম - dainik shiksha ঢাবিতে মুক্তিযোদ্ধা কোটা রেখেই ভর্তি কার্যক্রম ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত - dainik shiksha ক্যামব্রিয়ানের বাশারকে গ্রেফতারের দাবিতে আন্দোলন অব্যাহত শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি - dainik shiksha শিক্ষক নিবন্ধন ভাইভা: অষ্টম দিনে যেসব প্রশ্নের মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক - dainik shiksha ছাত্ররাজনীতি বন্ধ করা কল্যাণের হবে না: ছাত্রদল সম্পাদক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0021390914916992