সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন বলেছেন, শিক্ষকদের চাকরি অনেক সুন্দর চাকরি। শিক্ষা দেওলয়ার পাশাপাশি তারা ব্যবসা, রাজনীতিসহ বিভিন্ন কাজ করতে পারেন। সমাজেও তাদের একটা অন্যরকম মূল্যায়ন আছে। সে জন্য তারাই সুষ্ঠু ও সুন্দর সমাজ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারেন। একই অনুষ্ঠানে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেছেন, শিক্ষকতা মহান পেশা। আর প্রাথমিক বিদ্যালয় হচ্ছে শিক্ষার মূল ভিত। আজকের শিক্ষার মান এত উন্নত সেটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অবদান।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রী প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থেকে প্রাথমিক শিক্ষা কোন দৃষ্টিভঙ্গী থেকে দেখেছেন, তা বোধগম্য নয়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষকতা মহান পেশার পাশাপাশি ব্যবসা ও রাজনীতি করার সুযোগ আছে বলে মনে করেন। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম স্বাধীনতার উষালগ্নে চরম অভাবের মাঝে, যাতে প্রাথমিক শিক্ষকদের শিক্ষকতা পেশা ছাড়া অন্য কোন কাজ না করতে হয়, সে মহৎ উদ্দেশ্যকে লক্ষ রেখে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেছিলেন। তার সুযোগ্যকন্যা জননেত্রী প্রধানমত্রী শেখ হাসিনা একই আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে প্রাথমিক শিক্ষা জাতীয়করণ করেন।
বঙ্গবন্ধু ও তাঁর কন্যার স্বপ্ন অনুযায়ী প্রাথমিক শিক্ষকদের লক্ষ হবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আগামী প্রজন্মকে গড়ে তোলা। শিক্ষকদের ধ্যান, মন সবকিছু উজাড় করে দেয়া উচিত শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য। রাজনীতি বা ব্যবসা বাণিজ্যের জড়িতে রেখে আগামী প্রজন্ম সুনাগরিক হিসাবে গড়ে তোলা দুরহঃ। পাশাপাশি বঙ্গবন্ধু ও জননেত্রী শেখ হাসিনা জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক শিক্ষার স্বপ্ন ব্যাহত হবে।
মাননীয় প্রতিমন্ত্রীর কাছে শিক্ষকদের প্রত্যাশা, ন্যায্য সমস্যা এড়িয়ে না যেয়ে দ্রুত সমাধান করা। প্রাথমিকের প্রাপ্তি আদায় কেন সুপ্রীম কার্টে যেতে হচ্ছে? মহামান্য আদালত প্রাপ্তির নায্যতা বুঝতে পারে। অথচ মন্ত্রণালয়ে জ্ঞানী গুণীর সমাহার। তাঁরা কেন অনুধাবন করতে সক্ষম নয়। আমাদের মন্ত্রণালয়ে শুধু কেন সময়ক্ষেপেণের বেলায় পারদর্শী?
প্রাথমিক শিক্ষকদের মর্যদা থাকা উচিত প্রথম শ্রেণি। অথচ সংশ্লিষ্টরা ভাবনাহীনভাবে দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণি রেখে চলেছেন। প্রাথমিক শিক্ষায় নিজস্ব ক্যাডার সার্ভিস নেই। শিক্ষকদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা ও ক্যাডার সার্ভিস ছাড়া প্রাথমিক শিক্ষা নিরব ঘাতকের মতো ক্ষয়ে ক্ষয়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় সমস্যা সমাধানে অনীহা বা সময়ক্ষেপণে প্রাথমিক শিক্ষকেরা মহামান্য আদালতের দ্বারস্থ হয়ে চাঁদাবাজদের কবলে পতিত হচ্ছে। শিক্ষক নেতারা সংগ্রামী ঐতিহ্য হারিয়ে চাঁদাবাজ খেতাব নিয়ে তোষামোদকারী হিসাবে চিহ্নিত হচ্ছে। এতে ধীরে ধীরে প্রাথমিক শিক্ষক সমাজ দুর্নীতি নিমজ্জিত হচ্ছে।
সেনাবাহিনীর সৈনিকদের মতো সারাক্ষণ মুখে মুখে মেম্বার, চেয়ারম্যান, ম্যানেজিং কমিটি, কর্মকর্তাদের তোষামোদী করতে করতে অনেকটা জীবন মর্যাদাহীনভাবে চালিয়ে যাচ্ছেন শিক্ষকরা। শিক্ষকতা এক মহান পেশা। শিক্ষকদের কোন বস বা প্রভু থাকা কাম্য নয়। বিদ্যালয়ে ম্যানেজিং কমিটি ম্যানেজ শব্দটা পরিবর্তন প্রয়োজন। বিদ্যালয় কল্যাণ সমিতি বা পরিষদ নামকরণের মাধ্যমে শিক্ষকদের ম্যানেজ বা তাদের ওপর খবরদারি করার মানসিকতা ভাবনা দূর করা প্রয়োজন। এ কমিটিতে প্রধান শিক্ষক থাকবেন সভাপতি বা আহ্বায়ক। সদস্য সচিব থাকবেন শিক্ষক প্রতিনিধি, সকল শিক্ষক থাকবেন সদস্য। প্রত্যেক শ্রেণির ১ জন করে অভিভাবক প্রতিনিধিসহ জমি দাতার প্রতিনিধি হবে সদস্য। বিদ্যালয়ের সাথে পরোক্ষভাবে জড়িত নয় এমন কাউকে বিদ্যালয় কল্যাণ সমিতিতে রাখা সমীচিন নয়।
ক্যাডার সার্ভিস সৃষ্টির মাধ্যমে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত সর্বস্তরের অভিজ্ঞতা সমৃদ্ধ শিক্ষককে পদায়ন করে প্রাথমিক শিক্ষাবান্ধব প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। যাতে সর্বস্তরে অনাভিজ্ঞ বসের বদলে শিক্ষকেরা শিক্ষকদের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। তাতে শিক্ষকদের মর্যাদা অনেকটা সমৃদ্ধ।
শিক্ষকদের ক্ষমতা তলানীতে রেখে তাদের মর্যাদা সমৃদ্ধ করা সম্ভব নয়। পরিশেষে সমাজ ও রাষ্ট্রকে সকলকে অনুধাবন করত হবে যে, শিক্ষকেরা কারো কর্মচারী নয়। তারা দেশ ও জাতির সেবক। তাদের কোন বস বা প্রভু থাকতে পারেনা। তারাই সমাজ, দেশের সুনাগরিক গড়ার কর্নধার। সকলে বিষয়টি গভীরভাবে অনুধাবন করুক। এ প্রত্যাশায়। জয় বাংলা।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সভাপতি, বঙ্গবন্ধু প্রাথমিক শিক্ষা গবেষণা পরিষদ ও সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম।