খরার প্রভাবে হারিয়ে যাচ্ছে শিশুদের শৈশব

সাধন সরকার |

৫ জুন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। এ বছরের প্রতিপাদ্য- ‘করবো ভূমি পুনরুদ্ধার, রুখবো মরুময়তা, অর্জন করতে হবে মোদের খরা সহনশীলতা’। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত একটি গুরুত্বপূর্ণ অভিঘাত হলো খরা। খরার কারণে শিশুদের একটি বড় অংশ বিশুদ্ধ পানির অভাব ও অপুষ্টিতে ভুগছেন। 

জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে দেশজুড়ে। উন্নত দেশগুলোর মাত্রাতিরিক্ত কার্বণ নিঃসরণের ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা একটু-একটু করে বেড়ে যাচ্ছে। ফলশ্রুতিতে উপকূলীয় দ্বীপ রাষ্ট্রসমূহ জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবে এলোমেলো হয়ে পড়েছে।

দেশের দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চল খরার প্রভাবে ধুঁকছে। যদিও আগে থেকেই উত্তরাঞ্চলে খরার প্রভাব ছিলো। এখন দক্ষিণাঞ্চলে খরা দেখা দিচ্ছে। উত্তর ও উত্তর পশ্চিমাঞ্চলের খরা আরো তীব্র হচ্ছে। 

জলবায়ু পরিবর্তন রাজশাহী, রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও এর আশপাশের এলাকার চিরচেনা খরাকে ত্বরান্বিত করছে। খরা মূলত শুষ্ক আবহাওয়া ও অপর্যাপ্ত বৃষ্টিপাতের ফল। এছাড়া নদ-নদী ভরাট হয়ে যাওয়ার ফলে খরার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। খরার প্রভাবে জলাভূমি শুকিয়ে যাচ্ছে, দাবদাহ দেখা দিচ্ছে। 

খরার কারণে সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে যার প্রভাব পড়ছে দরিদ্র শিশুদের ওপর। জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ‘ইউনিসেফ’- এর প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশের প্রায় ২ কোটি শিশু জলবায়ু পরিবর্তনের বলি। জলবায়ু পরিবর্তন শিশুদের ওপর নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার করছে- এতে কোনো সন্দেহ নেই। 

শুধু বাংলাদেশে নয়, বিশ্বের দ্বীপরাষ্ট্রগুলোতেও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে শিশুদের ওপর। একটার পর একটা দুর্যোগ ধেয়ে আসছে উপকূলবর্তী এলাকায়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নদ-নদী খরার কারণে শুকিয়ে যাচ্ছে। 

বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৪০ ভাগ শিশু। আন্তর্জাতিক সংস্থার তথ্য বলছে, বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ শিশু কোনো না কোনোভাবে খরায় আক্রান্ত। খরাপ্রবণ এলাকায় বৃষ্টিপাত ব্যাপকমাত্রায় কমে যাওয়ার কারণে দেখা দিচ্ছে দাবদাহ। নদ-নদী, খাল-বিল, জলাশয় শুকিয়ে যাওয়ার কারণে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য সুপেয় পানির সংকট দেখা দিচ্ছে। 

দরিদ্র এলাকার জনগোষ্ঠী প্রকৃতির পানির ওপর নির্ভরশীল। প্রকৃতির পানিই যদি শুকিয়ে যায় তাহলে বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিবে এটাই স্বাভাবিক। খরা শুধু শিশুদের ওপর নয়, ফসল উৎপাদনেও ব্যাপকভাবে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। 

২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে ৪১ বছরের মধ্যে বাংলাদেশে সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছিলো। ২০২৩ খ্রিষ্টাব্দে স্বাভাবিকভাবে জুলাই মাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হওয়ার কথা থাকলে তা অতিমাত্রায় কম হয়েছিলো। 

বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, চলতি বছরের এপ্রিল মাসে দেশে গড় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ছিলো মাত্র মিলিমিটার। যা ১৯৮১ খ্রিষ্টব্দে পর সর্বনিম্ন বৃষ্টিপাতের রেকর্ড। বৃষ্টিপাত দিনে দিনে কমে যাচ্ছে, আবার অসময়ে হঠাৎ বৃষ্টিপাত হচ্ছে। 

বরেন্দ্রভূমিসহ উত্তর- পশ্চিমাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে খরার প্রভাব তীব্র হচ্ছে। বাংলাদেশে এলাকাভেদে বৃষ্টিপাতের তারতম্য রয়েছে। সিলেটে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে ৬৫০০ মিলিমিটার সেখানে বরেন্দ্রভূমিতে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ ১৫০০ মিলিমিটার। 
খরাসহ বিভিন্ন জলবায়ুগত দুর্যোগের কবলে পড়ে দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলের হাজার হাজার পরিবারের আয়ের উৎস কমে গেছে। বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার তথ্য বলছে, খরার কারণে ২০১৭ থেকে ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় ৭ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছে। স্বাধীনতার পর গত ৫৩ বছরে বাংলাদেশ ছোট-বড় মিলিয়ে ২০ বার খরা কবলিত হয়েছে। এর মধ্যে ১৯৭৮ ও ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সবচেয়ে বেশি খরার কবলে পড়ে দেশ। 

সাধারণত তিন ধরনের খরা দেখা যায়। এক. জলজ খরা, দুই. কৃষিজ খরা ও তিন. আর্থসামাজিক খরা। এর মধ্যে আর্থ- সামাজিক খরা শিশুর জীবনে প্রভাব ফেলছে বেশি। নদ-নদী শুকিয়ে যাওয়ায় অনেকে দীর্ঘদিনের পেশা বদল করতে বাধ্য হচ্ছে। 

অনেক দরিদ্র পরিবার জলবায়ুগত দুর্যোগের কবলে পড়ে ভিটেমাটি ছেড়ে শহরে পাড়ি জমাচ্ছে। খরার প্রভাবে পরিবারপ্রতি আয়-রোজগার কমে যাওয়ায় বহু দরিদ্র পরিবার শিশু সন্তানদের কাজে লাগিয়ে দিচ্ছে। খরার পরোক্ষ প্রভাবে দরিদ্র পরিবারের শিশুরা আরো দরিদ্র হয়ে পড়ছে।

বিশ্বর যতো ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ সংঘটিত হয় তার প্রায় ১৫ শতাংশের জন্য দায়ী এই খরা। খরার কারণে প্রধান দুটি সমস্যা হলো- সুপেয় পনির অভাব ও খাদ্য সংকট। 

বিশেষজ্ঞদের মতে, জলবায়ু পরিবর্তনের এই ধারা অব্যাহত থাকলে ২০৫০ খি্রষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশে ৮০ লাখ লোক খরার কারণে উদ্বাস্তু হবে। বর্তমান প্রজন্মের এক-চতুর্থাংশ শিশুর জীবনে যদি খরার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে তাহলে তাদের টেকসই ভবিষ্যতের কী হবে? জলবায়ু পরিবর্তন থেকে একবারে পরিত্রাণের সুযোগ নেই বললেই চলে। তাই পরিবর্তিত পরিস্থিতির সাথে অভিযোজনের পাশাপাশি ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় সব কার্যক্রম দ্রুততার সঙ্গে এগিয়ে নিতে হবে।

খরাপ্রবণ এলাকায় শিশুদের সুরক্ষায় আলাদা প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে হবে। শিশুদের জীবন খরার প্রভাবে যে হারিয়ে না যায়- এ প্রত্যাশা সবার। 

লেখক: জলবায়ু ও পরিবেশকর্মী

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha বর্তমানে ছাত্রদের নেতৃত্ব দেয়ার কেউ নেই: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! - dainik shiksha শিক্ষাখাতের নতুন তদবিরবাজ তিতাস! শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিভাজন তৈরির চেষ্টা চলছে: সমন্বয়ক হান্নান তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা - dainik shiksha তদন্ত রিপোর্ট না দিয়েই সটকে পড়ছেন শিক্ষা পরিদর্শকরা বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ - dainik shiksha বরখাস্ত হচ্ছেন শিক্ষা বোর্ডের সেই সচিব নারায়ণ নাথ আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা - dainik shiksha আমরা চাই না ছাত্রদের কঠোর হয়ে দমন করতে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0036828517913818