শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষা জীবন থেকে ঝরে পড়েছে অনেক শিক্ষার্থী। আট শতাংশ ছেলেশিশু এবং তিন শতাংশ মেয়ে শিশু সংসারের রোজগার বাড়াতে বিভিন্ন ধরনের পেশায় নিয়োজিত হয়ে পড়েছে। বেড়ে গেছে বাল্যবিয়ে। পড়াশোনার চর্চা না থাকায় শিক্ষার্থীদের বড় একটি অংশ পড়া ভুলে যেতে বসেছে। শিক্ষণের বড় ঘাটতি নিয়ে অর্থাৎ লার্নিং লস নিয়ে ওপরের শ্রেণীতে উঠেছে অনেকেই এবং সেখানে নতুন শিখন নিয়ে এগুতে পারছে না। ফলে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে শিক্ষার্থীরা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় আছে। তারা বেড়ে উঠছে দুর্বল মানবসম্পদ হিসেবে। বাধাগ্রস্ত হচ্ছে তাদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশ। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে বের হওয়া শিক্ষার্থীরা কর্মজীবনে প্রবেশ করতে পারছে না, বড় একটি অংশ শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারছে না। অনেক হতাশাগ্রস্ত হয়ে সামাজিক অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে। বেড়ে যাচ্ছে’ কিশোর গ্যাং’ নামক সামাজিক ব্যধির বিষফোঁড়া। শুক্রবার (২৭ আগস্ট) সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত এক নিবন্ধে এ তথ্য জানা যায়।
নিবন্ধে আরও জানা যায়, গত বছরের মার্চ থেকে এ পর্যন্ত ২২ দফা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি বাড়ানো হলো ফলে সর্বশেষ ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ৫৩২ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর দরজা বন্ধ। এই বন্ধ আর কত দিন চলবে কেউ ঠিক করে বলতে পারে না, মনে হচ্ছে যেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে অস্বাভাবিকতা প্রদর্শনে কারোর কোন ইঙ্গিত আছে। সমাজের প্রতিষ্ঠান, বাজার রাস্তাঘাটে স্বাভাবিকতা বিরাজ করলেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো যেন অস্বাভাবিকই থেকে যাচ্ছে। বিশ্বের ১৪টি দেশেই এই ধরনের অস্বাভাবিকতা প্রদর্শন করা হচ্ছে তাদের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। অন্যান্য দেশ একটানা এতদিন বন্ধ রাখেনি। আমাদের দেশে গত বছরের অক্টোবর থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত অর্থাৎ এই পাঁচ মাস কিন্তু পরিস্থিতি স্কুল খোলার মতো ছিল , তারপরেও দেখলাম খোলা হলো না।
১৮ আগষ্ট প্রধানমন্ত্রী সচিবদের সঙ্গে বৈঠক করে বলেছেন, সুবিধাজনক সময় এলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিতে হবে এবং ১৮ বছরের ঊর্ধ্বে সব শিক্ষার্থীকে টিকার আওতায় আনার কথাও বলেছেন। প্রধানমন্ত্রীর বৈঠকের আগে শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন যে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি আছে, করোনার সংক্রমণ কমলেই প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া হবে। এত দীর্ঘদিন বন্ধের পর প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার যেসব প্রস্তুতি দরকার সেই প্রস্তুতি প্রতিষ্ঠানগুলোর আছে কি? পুনরায় প্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া মানে ব্যাপক প্রস্তুতির ব্যাপার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবস্থান, অবকাঠামো, শিক্ষার্থী ও শ্রেণি সংখ্যার ভিত্তিতে প্রস্তুতি নিতে হবে। অবস্থা দৃষ্টে মনে সে রকম প্রস্তুতি পুরো ব্যবস্থাপনায় নেই। করোনা সংক্রমণের হার বর্তমানে ২০ শতাংশের কাছাকাছি, বিশেষজ্ঞরা মনে করেন যে, এই সংক্রমণ ৫ শতাংশের নিচে নামলে প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়া যেতে পারে। এই কদিন আগেও এই হার ছিল ৩০ শতাংশ। সংক্রমণের হারকে সামনে রেখে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার কতটা যুক্তি আছে, সেটি এখন ভাবার বিষয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অস্বাভাবিকতা দেখানো কেন হচ্ছে- বুঝতে পারছি না, যেখানে সবকিছু স্বাভাবিক দেখানোর প্রচেষ্টা বা প্রক্রিয়া আছে। আগামী নভেম্বরে এসএসসি ও ডিসেম্বরে এইচএসসি পরীক্ষা নেযার ঘোষণা দিয়েছে সরকার, সেটি করতে হলে সেপ্টেম্বরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে না দিলে কতটা সম্ভব হবে সে প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে।
বিশ্বব্যাংকের জরিপ বলছে , মহামারীর আগে দেশে পাঁচ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যে প্রায় ৫৮ শতাংশ ন্যূনতম পড়ার দক্ষতা অর্জন করত। এই সংখ্যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৬ শতাংশ। আগে চার বছর বয়সে তাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া শুরু হতো, এখন তা পাঁচ-কিংবা ছয় বছরে পড়তে যাচ্ছে। অর্থাৎ শুরুতেই প্রায় দুই বছর হারিয়ে যাবে প্রতিটি শিশুর শিক্ষা জীবন থেকে। কি পরিমাণ শিক্ষার্থী ঝরে পড়ল, শিক্ষার্থীদের শিখন ফলের বাস্তাবিক অবস্থাটা কী ইত্যাদি কোন ধরনের জরিপ বা গবেষণা কি আমরা সরকারের তরফ থেকে দেখতে পেয়েছি? পাইনি। বরং কোন ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান যদি কিছু একটা বের করে সরকারের পক্ষ থেকে তার যৌক্তিকতা নিয়ে প্রশ্ন তোলা হয়।
শিক্ষার ক্ষতির একটি অর্থনৈতিক পরিসংখ্যান দিয়েছে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক। তারা বলেছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের কারণে ভবিষ্যতে আয়ের ক্ষেত্রে শিক্ষার্থী প্রতি ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ১৮০ মার্কিন ডলার। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দীর্ঘ ছুটির ফলে বাংলাদেশের মতো দেশে ধনী-দরিদ্র বৈষম্যের অভিশাপ শিক্ষা ক্ষেত্রকে গ্রাস করতে যাচ্ছে। সামর্থ্যবান ও শহুরে শিক্ষার্থীরা ডিজিটাল পদ্ধতি ব্যবহার করে শিক্ষা কিছুটা চালিয়ে নিলেও দরিদ্র শ্রেণী এ থেকে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। যেমনটি ঘটেছে পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে। এখানে একটি বিষয় হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দারিদ্র্যের কারণে ডিজিটাল পদ্ধতি চালু করা যায়নি বিষয়টি তা নয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা তো আর দরিদ্র নয়। তারা যা প্রদর্শন করছেন সেটি হচ্ছে ‘ডিজিটাল্লি ইল্লিটারেসি’। এটাও তাদের জন্য কোন বিষয় ছিল না কারণ তারা মেধাবী। ইচ্ছে করলেই ডিজিটালি তারা ‘হাইলি এডুকেটেড হতে পারতেন’ কিন্ত কেন যে বিষয়টিকে এরিয়ে গেছেন বুঝতে কষ্ট হচ্ছে। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষার্থীই দরিদ্র নয়, তাছাড়া তাদের তো আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মতো বেতন দিয়ে পড়তে হচ্ছে না, ২০-৩০ টাকা বেতন। দু’পক্ষই ইচ্ছে করলেই অনেকটা ডিজিটালি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে পারত। সেটি না করে প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যখন ডিজিটালি কাজটা শুরু করে দিল তখন সেটিকে বন্ধ করে দেয়া হলো। এটি কোনভাবেই ঠিক হয়নি। ২০২১ সালের মার্চ মাসে ইউনিসেফ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সংস্থাটি ১৪৭টি দেশের ওপর একটি সমীক্ষা চালিয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে ২০২০ সালের মার্চ থেকে ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি র্পযন্ত বাংলাদেশের মতো এত দীর্ঘ সময়ে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রেখেছে বিশ্বের আর ১৩টি দেশ। এই দেশগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র দেশ হচ্ছে বাংলাদেশ। এই দীর্ঘসময় বন্ধ থাকায় ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে ১৬৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী যার মধ্যে বাংলাদেশেরই ৩৭ মিলিয়ন শিক্ষার্থী।
শিক্ষার ক্ষতির ভয়াবহতাকে প্রথম অনুধাবন করতে হবে, তারপর স্বীকার করতে হবে, এরপরে সংশ্লিষ্টদের মতামত চাওয়া হবে। এসবের পরে ব্যবস্থা নেয়া। ব্যবস্থা নেয়াটা কিন্তু নীতিনির্ধারকদের হাতে, অর্থাৎ সরকারের হাতে। আমাদের দেশের শিক্ষা গবেষণার ক্ষেত্রে যেটি হয়-তা হচ্ছে শিক্ষা নিয়ে যারা গবেষণা করেন সেগুলো সব বিচ্ছিন্ন। এর কোন ধরনের প্রয়োগ কোথাও নেই। কে প্রয়োগ করবেন? কীভাবে করবেন? প্রয়োগ করতে হলে সরকারকে বিষয়গুলো স্বীকার করতে হবে আর যারা গবেষণা করেন তাদের দায়িত্ব হচ্ছে সরকারকে দেখানো, জানানো, বোঝানো। ফলে, তাদের গবেষণার বিষয়বস্তু সব জার্নালের পাতায় সীমাবদ্ধ থাকে। সেটি কেউ উল্টেও দেখে না যদি না কারোর পেশাগত লাভের জন্য (যেমন প্রমোশনের জন্য একটি পাবলিকেশন) কেউ একটু পড়েন কিংবা উদ্ধৃতি দেন। নীতি-নির্ধারকেরা এগুলো দেখেন না, শুনেন না, শুনতে চান না, আর প্রয়োগ করা বা বাস্তাবয়ান করা তো দূরের কথা। অনেক গবেষক আবার বেশ আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন যে, শিক্ষা বিষয়ে তার যথেষ্ট গবেষণা রয়েছে। কিন্তু যে গবেষণা দেশের, জাতির, শিক্ষকের, শিক্ষার্থীরা কিংবা শিক্ষা বিভাগের কোথাও কাজে লাগল না সে গবেষণা শিক্ষাক্ষেত্রে কতটা কল্যাণ বয়ে আনতে পারে । হযতো গবেষক একটি ইনক্রিমেন্ট পেয়েছেন বা প্রমোশন পেয়েছেন কিংবা তার বিদ্যা কিছুট ধারালো হয়েছে।
লেখক : মাছুম বিল্লাহ, ব্যাক শিক্ষা কর্মসূচিতে কর্মরত