আজ ১৬ অক্টোবর বিশ্ব খাদ্য দিবস। খাদ্য আমাদের জীবনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ। তদুপরি, বিশ্বব্যাপী মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে, খাদ্য সুরক্ষা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংস্থা, যেমন- কৃষি বিকাশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক তহবিল, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি ইত্যাদির দ্বারা ‘বিশ্ব খাদ্য দিবস’ পালিত হয়। দিনটি সবার জন্য খাদ্য সুরক্ষা এবং পুষ্টিকর ডায়েটের প্রয়োজনীয়তা নিশ্চিত করার জন্য বিশ্বব্যাপী সচেতনতা তৈরি করে। বিশ্ব খাদ্য দিবস উদযাপন শুরু হয় ১৯৮১ খ্রিষ্টাব্দে। ১৯৪৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ অক্টোবর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থাটি প্রতিষ্ঠিত হয়। বিশ্বের মানুষের প্রয়োজনীয় খাদ্যের জোগান, দরিদ্র ও পুষ্টিহীনতা দূর করে ক্ষুধামুক্ত পৃথিবী গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে (খাদ্য ও কৃষি সংস্থা) তাদের কার্যক্রম শুরু করে। এ পৃথিবীর প্রায় ৬.৫ বিলিয়ন মানুষের মধ্যে এখন প্রায় ৮৫০ মিলিয়ন মানুষ খাদ্যের অভাবে দারিদ্র্যতার কষাঘাতে ধুঁকে মরছে।
মানুষ এ পৃথিবীতে জন্মগ্রহণ করে খাদ্যের অধিকার নিয়ে। আর এ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বিশ্বের প্রতিটি দেশ নির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা সামনে রেখে তা বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। তবে খাদ্যের সঙ্গে কৃষির সম্পর্কটি অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত, যদি কৃষিকে বাদ রেখে আমরা খাদ্যের কথা বলি তবে বিষয়টি হবে অযৌক্তিক।। এবারের প্রতিপাদ্য বর্তমান কৃষিবান্ধব সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার কার্যক্রমের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আর প্রতিপাদ্যে সবার জন্য খাদ্য বিষয়টি অন্তর্নিহিত রয়েছে। কৃষি প্রধান এ দেশে ১ কোটির ওপর বসতবাড়ি রয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বসতবাড়িগুলো শুধুই আবাসস্থল নয় বরং একেকটি কৃষি, মৎস্য, পশু, হস্ত ও কুটিরশিল্পের কেন্দ্রবিন্দু। আমাদের দেশের আবাসস্থলগুলোতেই মূলত শাকসবজি, মসলা, ভেষজ, ঔষধি, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল, মৎস্য প্রকৃতি চাষাবাদ হয়ে থাকে। কৃষকদের পর্যাপ্ত জ্ঞানের অভাবে এসব সম্পদ কাজে লাগানো যাচ্ছে না। বর্তমান সরকারের একটি বাড়ি একটি খামার কার্যক্রম সফল করা সম্ভব, যদি কৃষকদের ধ্যান-ধারণা চিন্তার কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন করে এসব বসতভিটা কার্যকরী তথ্যনির্ভর জ্ঞান দ্বারা পরিচর্যা করা যায়। এ কার্যক্রম সফল হলে দেশের পুষ্টি ঘাটতি দূরীকরণ সম্ভব, সঙ্গে সঙ্গে কুটিরশিল্প বিকাশে সহায়ক হবে। এতে কৃষকের ভাগ্য উন্নয়নসহ ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে এবং কৃষক পরিবার হবে স্বাবলম্বী। দেশের পতিত জায়গার সুষ্ঠু ব্যবহার করে সবার জন্য খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এ দেশের কৃষি ক্লাবগুলো জোরালো ভূমিকা পালন করতে পারে। আমাদের দেশে সরকারি বা বেসরকারিভাবে নানা নামে কৃষি ক্লাব গড়ে উঠেছে। কৃষি ক্লাবগুলো মূলত কৃষি সম্প্রসারণ এবং আয়বর্ধনমূলক কাজ করে থাকে। এগুলো গড়ে ওঠার মূল কারণ উদ্ভাবিত প্রযুক্তি, তথ্য বা সেবা যথাসময়ে সাধারণ জনগণের হাতের নাগালে পৌঁছে দেয়া এবং তার সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা। তবে তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে বাংলাদেশের কৃষিকে ডিজিটাল কৃষি করতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের কৃষি তথ্য সার্ভিস কর্তৃক পরিচালিত কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র নামে সক্রিয় কৃষি ক্লাব গঠিত হয়েছে। যেখানে কম্পিউটার, প্রিন্টার, ওয়েব ক্যাম, মোবাইল সেট ও সিম, মডেম ও ইন্টারনেট সিমসহ আরো অন্যান্য আধুনিক যন্ত্রপাতি ও সুযোগ-সুবিধা রয়েছে। সুস্থ-সবল জাতি গঠন এবং সমৃদ্ধিশালী সোনার বাংলাদেশ গড়তে হলে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও পুষ্টিকর ও নিরাপদ খাদ্যে গুরুত্ব দিয়েছেন। পুষ্টি ও নিরাপদ খাদ্য মানুষের মৌলিক অধিকার।
বঙ্গবন্ধু খাদ্য নিরাপত্তা ও নিরাপদ খাদ্যের প্রতি জোর দিয়েছিলেন। তার অনুপস্থিতিতে দেশ অদ্ভুত এক উটের পিঠে চলছিলো। তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারে আসার পর দেশ আবার খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে। বেড়েছে খাদ্য উৎপাদন। বর্তমানে আমাদের মোট খাদ্যশস্য উৎপাদন বেড়ে ৪ কোটি ৫৩ লাখ ৪৩ হাজার টন হয়েছে।
বিশ্ব ক্ষুধা সূচকে বাংলাদেশ প্রশংসনীয় অবস্থায় আছে। এখন আমাদের নিরাপদ খাদ্য নিয়ে ভাবতে হবে। নিরাপদ খাদ্যের সঙ্গে এসডিজির সম্পর্ক গভীর। রপ্তানিতেও নিরাপদ খাদ্য যথেষ্ট প্রভাব রাখে। মানুষের আয় যতো বেশিই হোক, খাদ্য নিরাপদ না হলে জীবন হুমকিতে পড়বে। উন্নয়ন টেকসই করতে হলে নিরাপদ খাদ্যের বিকল্প নেই। নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তায় আইনগত কাঠামো প্রয়োজন। খাদ্য উৎপাদনের গুণগত মান বাড়াতে হবে। তবে খাদ্যের মান নিয়ন্ত্রণের বাড়াবাড়ির কারণে যেন কোনো ক্ষতি না হয়। শ্রীলঙ্কায় খাদ্য অর্গানিক করতে গিয়ে দেশটিতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছিলো। আমাদের দেশের মানুষ এখন খাদ্য গ্রহণে অনেক সচেতন। এ মুহূর্তেই দরকার উদ্যোগ। তারপরও প্রচুর মানুষ এখনো খাদ্যের প্রাপ্যতা থেকে দূরে। যে খাবার তারা পাচ্ছেন, সেটিও নিরাপদ নয়। এরা সংখ্যায় অসংখ্য, তারা কেন্দ্রীয় ক্ষমতা বলয়ের বাইরে। তাদের নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে।
খাদ্য নিরাপত্তার সঙ্গে দারিদ্র্য বিমোচনের সম্পর্ক খুব ঘনিষ্ঠ। বাংলাদেশে দারিদ্র্যের হার, তীব্রতা ও গভীরতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছিলো। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে দারিদ্র্যের হার ছিলো ৫৬.৭ শতাংশ, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩.৫ শতাংশে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে দারিদ্র্যের হার ১৮.৬ শতাংশে কমিয়ে আনার প্রক্ষেপণ করা হয়েছিলো। বাংলাদেশে ৪৫.১ শতাংশ জনগণের মাথাপিছু জমির পরিমাণ ০.০৫ একরের কম। জনসংখ্যার ক্রমাগত বৃদ্ধি, নগরায়ণ, শিল্পোৎপাদন ও বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে একদিকে খাদ্য উৎপাদন হ্রাস, অপরদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা যুগোপযোগী না হওয়ায় বিষয়টি বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দেখা দিয়েছে। বর্তমানে দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে এ দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ; এর মধ্যে ১২.৫ শতাংশ চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে। উল্লিখিত চ্যালেঞ্জের সঙ্গে পরিবেশগত পরিবর্তন এবং অজ্ঞতা ও অতিমুনাফার লোভে মানুষের মনুষ্যত্ব হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে আরো একটি চ্যালেঞ্জ যুক্ত হয়েছে নিরাপদ খাদ্য ধারণায়।
খাদ্য মানবদেহের গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। নিম্নে তা আলোচনা করা হয়েছে। খাদ্য ছাড়া আমাদের জীবন ধারণ অসম্ভব। দৈনন্দিন কাজকর্ম ও চলাফেলা করার জন্য সবল, রোগমুক্ত ও সুস্থ শরীর প্রয়োজন। আর এই সুস্থ শরীর বজায় রাখতে খাবার প্রয়োজন। খাবার শরীর গঠন, বৃদ্ধি সাধন এবং ক্ষয়পূরণ করে; তাপশক্তি ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়। এ ছাড়া রোগমুক্ত রাখতে সাহায্য করে। অসুস্থ শরীরকে আরোগ্য হতেও সাহায্য করে। তবে খাবারের রয়েছে অনেক শ্রেণিভাগ। আর দেহকে সুস্থ রাখতে কোন খাবার কতোটুকু প্রয়োজন শরীরের জন্য সেটিও জানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
খাদ্য উপাদানের শ্রেণিবিভাগ করলে আমরা এসব উপাদানকে ছয়টি ভাগে ভাগ করতে পারি। এগুলোও আবার বিভক্ত মূখ্য ও গৌণ উপাদানে। খাদ্যের মূখ্য উপাদান'-শ্বেতসার বা শর্করা (উৎস-চাল, গম, ভুট্টা, চিড়া, মুড়ি, চিনি, আলু, মূল জাতীয় খাদ্য, আমিষ (উৎস-মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, ডাল, সীমের বীচি, কাঁঠালের বীচি, বাদাম ইত্যাদি), স্নেহ জাতীয় খাদ্য (উৎস্য-তেল, ঘি, মাখন, চর্বি ইত্যাদি)। খাদ্যের গৌণ উপাদান- খাদ্যপ্রাণ বা ভিটামিন (উৎস-রঙ্গিন শাক-সবজি, ফল, ডিম, দুধ, কলিজা ইত্যাদি)। খনিজ উপাদান (উৎস-ছোট চিংড়ি, ছোট মাছের কাঁটা, ঢেঁড়স, কচুশাক ইত্যাদি)।
যে খাদ্যের মধ্যে মানবদেহের জন্য প্রয়োজনীয় সব খাদ্য উপাদান পরিমাণ মতো থাকে, তাকেই এক কথায় সুষম খাদ্য বলা হয়। অর্থাৎ মানবদেহের প্রয়োজনীয় ও পরিমাণ মতো ছয়টি উপাদানযুক্ত খাবারকেই সুষম খাদ্য হিসেবে ধরা হয়। সুষম খাদ্য দেহের চাহিদা অনুযায়ী পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের জোগান দেয়। এ সুষম খাদ্যের মাধ্যমে দেহের ক্ষয়পূরণ, বুদ্ধিসাধন, শক্তি উৎপাদনসহ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অর্জিত হয়ে থাকে।
পরিশেষে বলতে চাই, বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের কোনো বিকল্প নেই। সুস্বাস্থ্যের তথা মানুষেরই প্রয়োজন নিরাপদ খাদ্য সুরক্ষা তথা পুষ্টিকর খাদ্য। পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করতে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দে নিরাপদ খাদ্য আইন পাস হয়। ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গঠন করা হয়।
অনিরাপদ খাদ্য গ্রহণে গর্ভবতী মায়ের শারীরিক-মানসিক বিভিন্ন জটিলতা এবং গর্ভজাত ও গর্ভ-পরবর্তীকালে স্বাস্থ্যগত সমস্যা, বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম পর্যন্ত হওয়ার মতো ভয়াবহতা উড়িয়ে দেয়া যায় না। ভেজালযুক্ত অনিরাপদ খাবার খেয়ে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। জাতীয় অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। উৎপাদিত পণ্য আন্তর্জাতিক মানসম্মত না হওয়ার ফলে রপ্তানিতে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। সাধারণ মানুষ প্রকারান্তরে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর বর্তমানে বিপুলসংখ্যক মানুষকে জীবন-জীবিকা, নিত্যদিনের কর্মকাণ্ডের জন্য ঘরের বাইরে থাকতে হয়। বাধ্য হয়ে বাইরের দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ, প্যাকেটজাত বা প্রক্রিয়াজাত খাবার খেতে হয়। এ ছাড়া খাদ্য এখন শুধু জীবনরক্ষাকারী উপাদান নয়, আচার-অনুষ্ঠান, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ হয়ে পড়েছে। উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, বিপণনে, প্যাকেটজাতকরণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে খাদ্য অনিরাপদ হয়ে পড়ছে। বিশ্বব্যাংকের হিসেবে, খাদ্যসংশ্লিষ্ট রোগের কারণে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৯ হাজার ৫০০ কোটি ডলার এবং রোগের চিকিৎসা ব্যয় এক হাজার ৫০০ কোটি ডলার।
আয়তনে বাংলাদেশ বিশ্বের ৮৮তম দেশ হলেও জনসংখ্যায় সারা বিশ্বে অষ্টম। জনসংখ্যার বিভিন্ন সূচকে দক্ষিণ এশিয়ায় অবস্থান সুদৃঢ় হয়েছে। গত ৬০ বছরে আমাদের গড় আয়ু বেড়েছে। ২০৩০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য দক্ষ মানবসম্পদ গড়তে দরকার সুস্থ দেহ-সুস্থ মন। কর্মব্যস্ত সুখী জীবন গড়তে খাদ্য সুরক্ষা নিশ্চিতকরণ সর্বাগ্রে জরুরি।
লেখক: প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারম্যান, জাতীয় রোগী কল্যাণ সোসাইটি