খুদে শিক্ষার্থীর হাতে অস্ত্র কেনো!

মাছুম বিল্লাহ |

২০২৪ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বের সবচেয়ে সুখী দেশ ফিনল্যান্ড! আমাদের দেশের মতো সেখানে এতো পরিবেশ দূষণ, রাজনীতি দূষণ, অভাব, খাদ্যে ভেজাল ও চারিদিকে শব্দ দূষণ নেই। তাদের মন, মস্তিষ্ক সবই শান্ত থাকার কথা। অভাব নেই, দারিদ্র নেই, নেই আমাদের মতো বেকারত্ব। অথচ এমনই একটি দেশের একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে কিছু দিন আগে এক শিশু শিক্ষার্থীর গুলিতে অন্য এক শিশু নিহত এবং আরো দুই শিশু গুরুতর আহত হয়েছেন। বার বছরের যে শিশুটি গুলি চালিয়েছেন বলে সন্দেহ করা হচ্ছে পুলিশ তাকে হেফাজতে নিয়েছে।  

রাজধানী হেলসিঙ্কির কাছের ভানতা শহরের দ্য ভিয়েরতোলা বিদ্যালয়ে গত ২ এপ্রিল ভোরে গুলির এই ঘটনা ঘটে। স্কুলটিতে সাত থেকে পনেরো বছর বয়সের শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন অর্থাৎ প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া করানো হয়। সেখানে কর্মীর সংখ্যা প্রায় ৯৯ জন। ফিনল্যান্ডের চতুর্থ বৃহত্তম শহর ভান্তা, যেখানে দুই লাখ ৪০ হাজার মানুষ বসবাস করেন।

সকালে পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছে স্থানীয় বাসিন্দাদের বাড়ির ভেতরে থাকার অনুরোধ জানান। স্কুলের একটি ভবন পুলিশ ঘিরে রেখেছে। কয়েকশ মিটার দূরে স্কুলের আরেকটি ভবন থেকে বাবা-মা নিজ সন্তানদের গ্রহণ করেছেন। স্কুল থেকে দূরে সিলতামাকি এলাকা থেকে পুলিশ কোনো ধরনের জোরজবরদস্তি ছাড়াই সন্দেভাজন অস্ত্রধারী শিশু ও তার আগ্নেয়াস্ত্রটি উদ্ধার করেছে। পূর্ব উসিমা পুলিশ বিভাগের প্রধান ইলক্কা কোসকিমাকি এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন সকাল নটার পরে এক স্কুলে একটি গুলি চালানোর ঘটনা ঘটে, এতে স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণির একজন শিক্ষার্থী মারা যান। আর দুইজন শিক্ষার্থী গুরুতর জখমের শিকার হয়েছেন। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে সন্দেহভাজন শিশু শিক্ষার্থী নিজের দোষ স্বীকার করেছেন। তাকে সোশ্যাল সার্ভিসের কেয়ারে পাঠানো হয়। বয়স খুব কম বলে তাকে পুলিশ হেফাজতে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে না। কী কারণে শিশুটি তার সমবয়সী অন্য শিশুদের গুলি করেছে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। 

গত কয়েক দশকের মধ্যে ফিনল্যান্ডের স্কুলে এ রকম বড় দুটি বন্দুক হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর একটি ঘটেছিলো ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের নভেম্বর মাসে দক্ষিণ ফিনল্যান্ডের তুসুলার জোকলা উচচ বিদ্যালয়ে। সেই ঘটনায় ৯ জন নিহত হয়েছিলো। ১৮ বছর বয়সী হামলাকারীকে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিলো। এর পরের বছরই দক্ষিণ-পশ্চিম ফিনল্যান্ডের কাউহাজেকির একটি কলেজে ২২ বছর বয়সী এক ছাত্র আধা-স্বয়ংক্রিয় পিস্তল দিয়ে দশজনকে গুলি করে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেন। ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের জোকেলা হাইস্কুলে পেক্কা-এরিক আউভিনেন নামের এক ব্যক্তি একটি হ্যান্ডগান ব্যবহার করে ৬ শিক্ষার্থী, স্কুলের নার্স এবং অধ্যক্ষকে গুলি করে হত্যা শেষে আত্মহত্যা করেন। তারপরের বছর অর্থাৎ ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দের মাত্তি সারি নামে আরেক শিক্ষার্থী উত্তরপশ্চিম ফিনল্যান্ডের কাউহাজেকিতে একটি ভোকেশনাল স্কুলে গুলি চালান। আত্মহত্যা করার আগে ৯ ছাত্র ও একজন পুরুষ কর্মীকে গুলি করে তিনি হত্যা করেন। 

২০০৭ ও ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে স্কুলের গুলির ঘটনার পর ফিনল্যান্ড আগ্নেয়াস্ত্র মালিকানার বয়স আর লাইসেন্সের জন্য আবেদনকারীর ব্যাকগ্রাউন্ড চেকের ব্যাপারে কঠোর নিয়ম কানুন প্রয়োগে পুলিশের হাতে আরো বেশি ক্ষমতা দিয়েছে। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে বন্দুক আইন কঠোর করেছে ফিনল্যান্ড। বন্দুকের লাইসেন্স দেয়ার আগে আবেদনকারীদের জন্য একটি যোগ্যতা পরীক্ষা চালু করেছে দেশটি। আবেদনকারীদের বয়সীমাও ১৮ থেকে ২০ বছর করা হয়েছে। 

ফিনল্যান্ডে ৫ কোটি ৬০ লাখ মানুষের বসবাস। তাদের মধ্যে এক কোটি ৫০ লাখেরও বেশি মানুষের লাইসেন্সকৃত আগ্নেয়াস্ত্র রয়েছে। একইসঙ্গে বন্দুকের লাইসেন্সধারী প্রায় ৪ লাখ ৩০ হাজার। আমার প্রশ্ন এতো শান্তির দেশ, এত প্রাকৃতিকভাবে সুন্দর পরিবেশ দূষণমুক্ত দেশে মানুষের মন মেজাজ তো এমনিতেই শান্ত, ধীর ও স্থির থাকে। তারা অস্ত্র দিয়ে করে? এতো লাইসেন্সধারী অস্ত্র কেনো? এটি কেমন সভ্যতা! অস্ত্র মানেই তো ধ্বংস!
কী কারণে শিশুটি তার সমবয়সী অন্য শিশুদের গুলি করেছেন তা এখনো নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তিনি যে পিস্তলটি ব্যবহার করেছেন সেটি বৈধ এবং তার এক আত্মীয়ের। তার মানে হচ্ছে, ফিনল্যান্ডে আগ্নেয়াস্ত্র অত্যন্ত সহজপ্রাপ্য জিনিস এবং অভিভাবক বা সমাজ এসব অস্ত্র নিয়ে খুব একটা ভাবে না। তা না হলে এতো ছোট শিশুর হাতে আত্মীয়ের অস্ত্র কীভাবে স্থান পায়?  

প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ তার এক উপন্যাসে লিখেছেন, পশ্চিমাদের কী যেনো একটা হয়েছে, তাদের মাথায় এক দুটি স্ক্রু ঢিলা হয়ে গেছে। কারণ হিসেবে তিনি অনেক উদাহরণ দিয়েছেন। তার মধ্যে একটি ছিলো বিশ্ববিদ্যালয়ের’ কিচিং বুথ’, যেখানে এক নারী শিক্ষার্থী এক ডলারের বিনিময়ে একটি করে কিস গ্রহণ করেন। আবার কেউ কেউ বেশি অর্থের বিনিময়ে বেশিক্ষণ কিস নেন। আবার অন্য দুই নারী পুরুষ শিক্ষার্থী ৪৮ ঘণ্টা কিংবা ৭২ ঘণ্টা কিস দিয়ে যাচ্ছেছন। স্যার অন্যদের জিজ্ঞেস করলেন, তাদের এই দুই তিন দিন খাওয়া দাওয়ার কী হবে? উত্তর দিলেন, কেনো নাকে পাইপ দিয়ে লিকুয়িড খাবার খাওয়াবে! এগুলো শুনে, জেনে এবং দেখে আসলেই মনে হয় ওদের কী যেনো হয়েছে। স্ক্রু আসলেও ঢিলা হয়ে গেছে!

আমাদের এই দরিদ্র ও হাজার সমস্যার দেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় তো দূরের কথা, মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও কখনো অস্ত্র কিংবা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করার কথা চিন্তাও করতে পারেন? অস্ত্র দিয়ে প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সহপাঠী হত্যার কোনো উদাহরণই আমাদের দেশে নেই। এই আমাদের কালচার! এটিই আমাদের গর্ব! এটিই আমাদের মূল্যবোধ! তবে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে কিছু নোংরা রাজনীতির জন্য কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে, আর ইদানিং কিশোর গ্যাং সমাজের কোথাও অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। রাষ্ট্র এই দুটো বিষয়কে সঠিকভাবে নজরে নিলে আমার দেশ হবে বহু দেশের জন্য উদাহরণ! 

লেখক : ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের দাবি নিয়মমাফিকভাবে জানানোর আহ্বান মাহফুজ আলমের জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা - dainik shiksha জামি’আ মাদরাসা দখলমুক্ত চেয়ে প্রধান উপদেষ্টার হস্তক্ষেপ কামনা ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা - dainik shiksha ৭ কলেজ নিয়ে পরিকল্পনা জানালেন শিক্ষা উপদেষ্টা ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু - dainik shiksha ই-রিকুইজিশনের সংশোধন অপশন চালু পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি - dainik shiksha পদোন্নতি নিয়ে যে ব্যাখ্যা দিলো ইউজিসি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কমিটি সংক্রান্ত শিক্ষা বোর্ডের নির্দেশনা ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ - dainik shiksha ছাত্রাবাস খোলার দাবিতে পলিটেকনিক শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন - dainik shiksha ট্রাম্প প্রশাসনে শিক্ষামন্ত্রী হচ্ছেন লিন্ডা ম্যাকমোহন কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0029661655426025