জনবল নিয়োগের প্রায় সাড়ে ৪ কোটি টাকার দরপত্র নিয়ে খুলনা মেডিকেল কলেজ (খুমেক) হাসপাতালে চলছে অচলাবস্থা। পছন্দের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দিতে হুমকি দেন সরকারঘনিষ্ঠ এক প্রভাবশালী। সেটি সহ্য করতে না পেরে হাসপাতাল ছেড়েছেন পরিচালক ও উপপরিচালক। তত্ত্বাবধায়কও কর্মস্থলে অনিয়মিত। প্রশাসনিক শূন্যতায় দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সবচেয়ে বড় হাসপাতালের কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে।
জানা যায়, ৯ জুলাই থেকে হাসপাতালে অনুপস্থিত পরিচালক ডা. গৌতম কুমার পাল। ছুটি নিয়ে তিনি রাজশাহী আছেন। উপপরিচালক ডা. হুসাইন শাফায়াত ১৭ জুলাই ঝিনাইদহ মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস) অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার দায়িত্ব হস্তান্তর করেছেন তিনি। হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. আকতারুজ্জামান ছুটিতে।
সূত্রের দাবি, প্রভাবশালীর চাপেই উপপরিচালক তদবির করে বদলি হয়েছেন। একই চেষ্টা করছেন পরিচালক ও তত্ত্বাবধায়ক। এজন্য তারা হাসপাতালে অনিয়মিত।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম খুমেক হাসপাতালে আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগ শুরু হয়। দরপত্রের মাধ্যমে চার দফায় ৩০৬ জন নিয়োগের কাজ পায় ‘কন্ট্রাক্ট ক্লিনিং সার্ভিসেস লিমিটেড’ ও ‘মাছরাঙ্গা সিকিউরিটি সার্ভিসেস’। প্রতিষ্ঠান ভিন্ন হলেও মালিক হেমায়েত হোসেন ফারুক। জনবল নিয়োগে প্রতিবছর নতুন দরপত্র আহ্বানের নিয়ম থাকলেও গত চার বছর তা হয়নি। প্রতিবছর মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে মেয়াদ বাড়িয়ে এনেছেন ঠিকাদার।
দীর্ঘদিন একই প্রতিষ্ঠান কাজ করায় বিভিন্ন সময় ঠিকাদারের বিরুদ্ধে জনবল নিয়োগের জন্য এককালীন অর্থগ্রহণ, কাজ করিয়ে বেতন না দেওয়া, নিয়োগ করা কর্মীর কাছ থেকে অগ্রিম চেক রেখে টাকা উত্তোলন, একই ব্যক্তির নাম একাধিক তালিকায় রেখে বেতন তোলাসহ নানা অভিযোগ রয়েছে। এর মধ্যে ২৮ কর্মীর নামে একাধিকবার বেতন উত্তোলনের অভিযোগের তদন্ত চলছে।
সূত্র জানায়, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর ১০০ এবং গত ৩০ জুন ২০৬ কর্মী নিয়োগের মেয়াদ শেষ হয়েছে। ১০০ জনবলের খাত নবায়ন বন্ধ রেখেছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নতুন অর্থবছরের জন্য ২০৬ জন নিয়োগে নতুন দরপত্র আহ্বান এবং আগেরজনকে বাদ দিয়ে নতুন ঠিকাদার নিয়োগে দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতাল প্রশাসনকে চাপ দিয়ে আসছেন সরকারঘনিষ্ঠ এক প্রভাবশালী। প্রতি কর্মীর বেতন মাসে ১৬ হাজার ৬২০ টাকা ধরে বছরে প্রায় ৪ কোটি ১০ লাখ টাকা। আর ১০ শতাংশ কমিশন যোগ করে দরপত্রের আকার দাঁড়ায় সাড়ে ৪ কোটি টাকা।
এ দরপত্র পছন্দের ঠিকাদারকে দিতে গত ৯ জুলাই হাসপাতালের পরিচালক ও উপপরিচালককে ডেকে নিয়ে হুমকি দেন ওই প্রভাবশালী। বিষয়টি মন্ত্রণালয় ও সেন্ট্রাল প্রকিউরমেন্ট টেকনিক্যাল ইউনিটের (সিপিটিইউ) হাতে থাকায় নিজের অপারগতা প্রকাশ করেন তারা। কিন্তু তিনি এসব শুনতে নারাজ। এরপর হুমকির দিনই রাজশাহী চলে যান পরিচালক। উপপরিচালক ঢাকা গিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার উপায় খোঁজ করেন। ব্যর্থ হয়ে তদবির করে বদলির আদেশ নিয়ে আসেন।
হাসপাতাল সংশ্লিষ্টরা জানান, আউটসোর্সিংয়ে জনবল নিয়োগে দেশজুড়ে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট রয়েছে। লাভজনক ও বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতবদল হওয়ায় মন্ত্রণালয় বরাবরই ঠিকাদারের পক্ষে থাকে। হাসপাতাল প্রশাসনের পক্ষে তাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়ার সুযোগ থাকে না। এ ছাড়া নতুন যে প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেওয়ার চাপ ছিল, সেটি যোগ্য নয়। এরই মধ্যে ২০৬ জনবল নিয়োগের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়িয়ে এনেছেন ঠিকাদার। এখন তাদের বিল না দিতে চাপ দেওয়া হচ্ছে। এসব অন্যায্য দাবি মানা সম্ভব নয় বুঝতে পেরে হাসপাতাল প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিরা চলে যাচ্ছেন।
পরিচালক ৯ জুলাইয়ের ঘটনা নিয়ে কথা বলতে চান না। তিনি বলেন, ‘আমি অসুস্থ, হাসপাতালে ছিলাম। এখন বাড়িতে বিশ্রাম করছি। সুস্থ হওয়ার পর হাসপাতালে যাব কিনা, সে সিদ্ধান্ত পরে নেব।’ বিদায়ী উপপরিচালক বলেন, ‘চেষ্টা করেও পারিনি। এর বেশি কিছু বলার নেই।’ তত্ত্বাবধায়ক বলেন, ‘ব্যক্তিগত কারণে ছুটিতে আছি। কাজে যোগ দিলেও আর্থিক ব্যবস্থাপনার কোনো দায়িত্ব নেব না।’
বর্তমান ঠিকাদার হেমায়েত হোসেন বলেন, ‘কর্তৃপক্ষ আমার কাজে সন্তুষ্ট বলে প্রতিবছর মেয়াদ বাড়ে। যেসব অভিযোগ এসেছে, তা সঠিক নয়।’