কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী জানিয়েছেন, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ে গণরুম সংস্কৃতি বন্ধের ব্যবস্থা হচ্ছে। ইনশাআল্লাহ, এই বছর থেকে গণরুম সংস্কৃতি বন্ধ হচ্ছে। সব হলের প্রভোস্টদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা হয়েছে। আমরা একটা সিদ্ধান্তে এসেছি।
আওয়ামী লীগের দীর্ঘ শাসনামলে সম্প্রতি নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের নেতৃত্বে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচটি হলের চারটিতেই চলছিল গণরুম সংস্কৃতি। গণরুম সংস্কৃতি চালু রেখে হলে সিট দেয়া নিয়ে চলত ছাত্রলীগের রাজনীতি। কোনো শিক্ষার্থীকে হলে উঠতে চাইলে তাকে অবশ্যই ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হতে হত। এছাড়া প্রথম বর্ষে শিক্ষার্থীদের ‘ম্যানার’ শিখানোর নাম করে হলগুলোতে রাতভর চলত শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন।
এছাড়া হলে বিভিন্ন নেতার রুমগুলো ছিল টর্চার সেল। চুন থেকে পান খসলেই চলত নির্যাতন।
সম্প্রতি দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আমূল পরিবর্তন ঘটেছে। এই ধারাবাহিকতায় বিশ্ববিদ্যালয়ে এরই মধ্যে বিভিন্নভাবে আবাসিক চারটি হলের সবগুলো গণরুমই বিলুপ্ত করেছে শিক্ষার্থীরা।
৫ আগস্টের পর গণরুমগুলোতে সিট না পাওয়া জুনিয়র শিক্ষার্থীরা নিজেরা সিট বণ্টন করে থাকা শুরু করে।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, নতুন প্রতিটা ব্যাচ আসার আগে এমনটা প্রতিবছরই শুনি। নতুন প্রশাসন কতটা কার্যকর করতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের এক আবাসিক শিক্ষার্থী জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শুরুর দিনগুলোতে আমার মতোই অসংখ্য শিক্ষার্থী গণরুম কালচার নামক নিপীড়নের শিকার হয়েছে। নতুন করে আরো একটি ব্যাচ এই জঘন্য কালচারের ভুক্তভোগী হোক, সেটা চাই না।
প্রতিটা হলের গণরুমগুলো চিরতরে নিষিদ্ধ করা হোক।
আবাসিক হলগুলোতে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলে গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত ২০৫ নম্বর কক্ষটিকে বর্তমানে ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের প্রার্থনা কক্ষে রূপান্তর করা হয়েছে। শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের ১০৪ নম্বর কক্ষটিতে আসনের ব্যবস্থা করে এটিকেও বিলুপ্ত করা হয়েছে। কাজী নজরুল ইসলাম হলে ১০৬ নাম্বার কক্ষটিকে তালাবদ্ধ করার মাধ্যমে গণরুমের ইতি টানা হয়েছে। নওয়াব ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী হলের গণরুম হিসেবে ব্যবহৃত ১০৭ নাম্বার কক্ষটিও আসন ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে নিয়মিত কক্ষে পরিণত করা হয়েছে।
এর মধ্যেই আবাসিক হলসমূহে গণরুম বন্ধসহ ছয়টি সিদ্ধান্তের কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। সিদ্ধান্তগুলো হলো- শিক্ষার্থীদের মধ্যে যাদের আবাসিক সিট বরাদ্দ নেই তারা হলে অবস্থান করতে পারবে না, শিক্ষার্থীরা অবশ্যই বরাদ্দকৃত হলে অবস্থান করবে, হলের কোনো কক্ষে হিটার থাকতে পারবে না, হলের কোনো কক্ষে মাদক দ্রব্য পাওয়া গেলে এবং প্রমাণিত হলে ওই কক্ষে অবস্থানরত শিক্ষার্থীর সিট বাতিল করা হবে, হলে কোনো গণরুম থাকতে পারবে না।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, গণরুম তৈরি হওয়ার পেছনে সময়মতো আবাসিক হলের আসন বরাদ্দ না দেয়া প্রধান কারণ। আসন বরাদ্দ পেতে তাদেরকে অপেক্ষা করতে পাঁচ থেকে ছয় মাসের মতো।
আবাসিক হলের সিট সংক্রান্ত সব সমস্যার সমাধানে গত ২৩ সেপ্টেম্বর একটি প্রভোস্ট কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে আহ্বায়ক হিসেবে আছেন শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের প্রাধ্যক্ষ মো. জিয়া উদ্দিন এবং সদস্য-সচিব হিসেবে আছেন কাজী নজরুল ইসলাম হলের প্রাধ্যক্ষ মোহাম্মদ নাসির হুসেইন। এ ছাড়াও কমিটিতে সদস্য হিসেবে রয়েছেন প্রক্টর ড. মো. আবদুল হাকিম, নওয়াব ফয়জুন্নেছা চৌধুরাণী হলের প্রাধ্যক্ষ সুমাইয়া আফরীন সানি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মোহাম্মদ মাহমুদুল হাসান খান, এবং শেখ হাসিনা হলের প্রাধ্যক্ষ ড. মোসা. শাহীনুর বেগম।
এ কমিটির কার্যক্রমের বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক ও শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত হলের প্রাধ্যক্ষ মো. জিয়া উদ্দিন বলেন‚ ‘আমরা এ বছর খুব দ্রুত সময়ে শিক্ষার্থীদের আসন বরাদ্দ দিয়ে দেব। যাতে লিগ্যালি তারা হলে উঠতে পারে। এবং হলে র্যাগিংসহ কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা যেন না ঘটে, আমরা হল প্রশাসন কঠোর অবস্থানে আছি।’
রেজিস্ট্রার মো. মুজিবর রহমান মজুমদার বলেন, ‘আবাসিক হলগুলোতে শিক্ষার পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে গণরুম গুলো বন্ধ করা হয়েছে। এখন থেকে কেউ হলে উঠতে হলে তাকে প্রশাসনের নিয়ম মেনে উঠতে হবে। এই বিষয়ে হল প্রশাসন যাবতীয় সবকিছু দেখবে।’
নতুন ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীদের হলে আসন বরাদ্দের ব্যাপারে তিনি জানান, তাদেরকে কিভাবে দ্রুত সময়ে হলে আসন বরাদ্দ দিয়ে হলে ওঠানো যায়, সেই বিষয়ে আমরা হল প্রশাসনের সাথে আলোচনা করব। আপাতত হলে কোনো সিট খালি থাকলে সেখানে নতুনদেরকে হল প্রভোস্টের মাধ্যমে উঠতে হবে। প্রভোস্টরা এখানে সুষ্ঠুভাবে বণ্টনের দায়িত্ব পালন করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে র্যাগিং ইস্যু নিয়ে প্রক্টর অধ্যাপক ড. আবদুল হাকিম বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিচয় পর্বের নামে আতঙ্কের পরিবেশ যেন সৃষ্টি না হয় সেজন্য আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। সিনিয়র শিক্ষার্থীদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে জুনিয়র শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিচয় হতে পারে কিন্তু এটি যেন আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি না করে।’
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. হায়দার আলী আরো বলেন, ‘আসন বরাদ্দের বিষয়ে আমরা ইতিমধ্যেই কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এবং সেগুলো বাস্তবায়নের জন্য হল প্রশাসনকে দায়িত্ব বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে।’