পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে যে কৃষিবিজ্ঞানীদের অবদানে দেশ আজ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ, যাঁদের মেধার ফসলে ভরে উঠছে উত্তরাঞ্চলের মঙ্গাপীড়িত এলাকার শূন্য গোলা, যাদের উদ্ভাবিত লবণসহিষ্ণু ধান- প্রাণ জাগিয়েছে দক্ষিণের বিস্তীর্ণ লোনাভূমিতে; সেই কৃষিবিজ্ঞানীরা আজ হতাশ। পেশাজীবনে নানা বঞ্চনার শিকার হয়ে তাঁদের অনেকে পাড়ি জমাচ্ছেন বিদেশে। কেউ বা চাকরি ছেড়ে যোগ দিচ্ছেন অন্য পেশায় । আর যাঁরা সে রকম পারছেন না, তাঁরা ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস ।
এ-ভাবে দেশ ও জাতি হারাচ্ছে অনেক কাঠ-খড় পুড়িয়ে তৈরি করা সব সোনালি সম্ভাবনা। জানা গেছে, প্রতি মাসেই কোনো না কোনো বিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট, পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট, পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটসহ বিভিন্ন কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। কৃষিবিজ্ঞানীরা চাকরি ছাড়ার কারণে কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগটি কার্যত নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়েছে। যাঁরা চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁদের বিকল্প তৈরি হয়নি। গত মাসেও কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়েছেন তিন বিজ্ঞানী। ২০ বছর চাকরি করার পর তাঁরা মাত্র একটি পদোন্নতি পেয়েছেন। চাকরির বয়ঃসীমা ৫৭ বছর হওয়ায় তাঁরা ক্যরিয়ার নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। বেশি বেতনে তাঁরা যোগ দিয়েছেন সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক পদে। এছাড়া গত ১০ বছরে দুই শতাধিক কৃষিবিজ্ঞানী বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট ছেড়ে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। তাঁদের মধ্যে অনেকে বিভিন্ন ফসলের নতুন জাত বা প্রযুক্তি উদ্ভাবন করে দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে সহায়তা করেছেন।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের (বার্ক) নির্বাহী চেয়ারম্যান বলেছেন, ‘শুধু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট বা পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট নয়, চাকরি ছাড়ার এ-প্রবণতা সব কৃষি ইনস্টিটিউটে । জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কৃষি গবেষণা সেক্টরে নানা সহায়তা আসছে। কিন্তু সে-সব ব্যবহারের জন্যে যোগ্য লোক নেই। মেধাবী কৃষিবিজ্ঞানীদের আমরা ধরে রাখতে পারছি না। অনেকে প্রশিক্ষণ বা উচ্চশিক্ষার জন্যে বিদেশে গিয়ে আর ফিরছেন না। অনেকে চাকরি ছেড়েই বিদেশে যাচ্ছেন।'
সম্প্রতি যে-তিনজন কৃষিবিজ্ঞানী কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন, তাঁরা শুধু পদোন্নতি পাচ্ছেন না বলেই চাকরি ছেড়েছেন। নিজের চাকরি ছাড়া প্রসঙ্গে জনৈক বিজ্ঞানী বলেছেন ‘২১ বছর কৃষি গবেষণা-বিষয়ক চাকরি করে আমি সেই চাকরি ছেড়ে এসেছি। এত দিন চাকরি করার পর তা ছেড়ে দিয়ে নতুন পেশায় যোগ দেওয়ার যে-বেদনা, তা সংশ্লিষ্টদের বুঝতে হবে। বিশ্বের কৃষি প্রধান দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ, যেখানে কৃষিবিজ্ঞানীদের তাঁদের সামাজিক মর্যাদার জন্যে ধর্ণা দিতে হয়। ভারত, চীন, থাইল্যান্ডসহ কোনো কৃষিপ্রধান দেশে ৫৭ বছর বয়সে কৃষিবজ্ঞানীদের অবসরে যেতে হয় না। আমি ২১ বছর চাকরি করে মাত্র একবার পদোন্নতি পেয়েছি। অথচ আমার সঙ্গে যারা লেখাপড়া করেছে, তারা অনেকেই তাদের চাকরির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। কৃষি গবেষণায় না গিয়ে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছে তারা আজ অধ্যাপক। তারা চাকরিও করতে পারবে ৬৫ বছর বয়স পর্যন্ত। অথচ আমাকে ৫৭ বছর বয়সে বাড়ি চলে যেতে হবে । বর্তমান সরকারসহ সব সরকারই আমাদের চাকরির বয়সীমা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, পদোন্নতিসহ সব ধরনের সুযোগ দেওয়ার কথা বলেছে; কিন্তু কেউ কথা রাখেনি।'
সংবাদটি বড় হলেও প্রণিধানযোগ্য। এরকম অন্যান্য গবেষণা ক্ষেত্রেও একই চিত্র। একবার তো এক আমলের সরকারকে বলতে শোনা গেল - 'বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও শিল্প গবেষণা পরিষদ' রেখে লাভ কী? এখানকার বিজ্ঞানীরা তো কোনো অবদান রাখতে পারে না । অবশ্য পরবর্তী সরকার এসে গবেষণায় তাদের কিছু অর্থ বরাদ্দ দিল। এ-ভাবেই অবহেলিত হয়ে আসছে আমাদের দেশের রিসার্চ এ্যান্ড ডেভেলাপমেন্ট সেক্টর তার সঙ্গে শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষাও। ১৯৯১ সালে গণতান্ত্রিক পন্থায় বিজয়ী সরকার ক্ষমতায় এসে প্রথম একনেক সভায় ভেঙে দিয়েছিল শিক্ষা উপকরণ বোর্ডটি। প্রায় ১০ কোটি টাকায় শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার উপকরণ তৈরির যে-কারখানাটি নির্মিত হয়েছিল এবং তারা উপকরণ সরবরাহের পর্যায়ে ছিল তা বন্ধ করে সহজলভ্য দ্রব্যগুলোকে দুষ্প্রাপ্য করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষা ও বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যয়ভার বাড়িয়ে তুলল।
এবার সরেজমিনে দেখা একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশের বর্ণনা দেয়া যাক। যার নাম মাঝিগাছা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। কুমিল্লা জেলার কোতওয়ালী থানার শ্রীপুর গ্রামে অবস্থিত । দেখা গেল শিশুশ্রেণিতে ১৫০ জন ভর্তি করা হয়েছে, সম্প্রতি সরকারের নির্দেশনায় । কিন্তু ওরা বসবে কোথায় স্থান হলো একচিলতে খোলা আকাশের নিচে । প্রথম শ্রেণিতে পড়ে ১৪৭ জন, দ্বিতীয় শ্রেণিতে ২টি শাখায় ১৭০ জন, তৃতীয় শ্রেণিতে ১২০ জন, ৪র্থ শ্রেণিতে ৩টি শাখায় ১৪৫ জন ও ৫ম শ্রেণিতে ৯২ জন। ঘর ৫টি ছোট ছোট, শিক্ষক সংখ্যা ৫ জন। ৫টি কক্ষে কী ভাবে এতগুলো শাখা চলে স্কুলে - প্রশ্ন করলে উত্তর আসে সত্যিকার অর্থে চলে না। তবু চালাতে হয় অতিশয় কষ্ট করে খুড়িয়ে খুড়িয়ে। এমন অবস্থা বহু প্রাইমারি স্কুলের। শুধু প্রাইমারি কেন – সরকারি, বেসরকারি বহু স্কুল ও কলেজের। কোথায়ও শিক্ষার্থী আছে তো শিক্ষক নেই, কোথাও শিক্ষক আছে- শিক্ষার্থী নেই। সরকারি ডিগ্রি কলেজে সাধারণত দেখা যায় গণিত, অর্থনীতি এমন কিছু বিষয়-এ- শিক্ষার্থী আছে ১-৫ জন এবং শিক্ষকও ৫ জন। আবার এর বিপরীতে বিষয় ভিত্তিতে ভয়াবহ চিত্রও আছে।
স্বাধীনতার ৪০ বছরে আজও এদেশের সংসদ সদস্যদের সংসদে উত্থাপন করতে হয় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকদের অবমাননাকর বাড়ি ভাড়া ১০০/- ও চিকিৎসাভাতা ১৫০/- টাকার কাহিনী। এমপিও ভুক্তির জন্য শিক্ষকদের করতে হয় শহীদ মিনারে ঈদ পালনের অঙ্গীকার। সংসদে দাঁড়িয়ে এমপিদের বলতে শোনা যায় - মেয়েদের স্কুল কলেজের প্রাচীর নেই, প্রাইমারি স্কুলের প্রয়োজনীয় শ্রেণি কক্ষ নেই ইত্যাদি। আর খোদ শিক্ষামন্ত্রীর মুখে শুনতে হয় আর্থিক সীমাবদ্ধতার কথা; সংসদে ও সংসদের বাইরে। শিক্ষানীতি ২০১০ পাশ হয়েছে কিন্তু তা কার্যকরী করার অর্থ-বরাদ্দ নেই। তাই সেমিনার করে তার দাবি জানাতে হয়। তারপরও কী বলা যাবে না – এদেশে গবেষণা ও শিক্ষাখাত অবহেলিত! তাই প্রয়োজন এ খাতে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার।
বি: দ্র: ২০১১ খ্রিষ্টাব্দে শিক্ষাবার্তা পত্রিকায় প্রকাশিত।