ঢাবির দর্শন বিভাগগবেষণা কাজে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর চৌর্যবৃত্তি

দৈনিক শিক্ষাডটকম, ঢাবি |

গবেষণায় চুরিতে থেমে নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। এবার দর্শন বিভাগের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে গবেষণা কাজে তথ্য চুরির অভিযোগ পাওয়া গেছে। এখন পর্যন্ত এই তালিকায় রয়েছেন তিন শিক্ষক ও এক শিক্ষার্থী। অধ্যাপক মো. দাউদ খান ও রেবেকা সুলতানার বিরুদ্ধে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। অভিযোগ পাওয়া গেছে, ওই বিভাগের অধ্যাপক জসিম উদ্দিনও গবেষণা প্রবন্ধে চৌর্যবৃত্তির আশ্রয় নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তার অধীনে এমফিল গবেষণায় নিয়োজিত শিক্ষার্থী তাসলিমা আক্তারের বিরুদ্ধেও একই অভিযোগ উঠেছে। এই শিক্ষার্থীকেই বিভাগের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করেছেন জসিম উদ্দিন। বিষয়টি নিয়ে দর্শন বিভাগের ভেতর ও বাইরে তুলকালাম চলছে বলে জানা গেছে।

সূত্র জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘দেব সেন্টার ফর ফিলোসোফিক্যাল স্টাডিজ’-এর ফিলোসোফি অ্যান্ড প্রগ্রেস জার্নালে অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের ‘দি মাধ্যমিকা ডায়ালেক্টিক: এন এনালাইসিস’ শিরোনামে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে। অভিযোগ রয়েছে, ২ হাজার ৪৬৪ শব্দের ওই প্রবন্ধে ফয়োডর ইপোলিটভিসের ‘দি কনসেপশন অব বুড্ডিস্ট নির্ভানা’ গ্রন্থ থেকে ২৫ শতাংশ (৬১২ শব্দ) এবং টি আর ভি মূর্তি’র ‘দি সেন্ট্রাল ফিলোসফি অব বুদ্ধিজম’ গ্রন্থ থেকে ২০ শতাংশসহ (৫০৭ শব্দ) মোট ৫৯ শতাংশ (১ হাজার ৪৫৩ শব্দ) বিভিন্ন বই থেকে হুবহু কপি করেছেন অধ্যাপক জসিম। তিনি চৌর্যবৃত্তিতে অভিযুক্ত একই বিভাগের আরেক শিক্ষক অধ্যাপক মো. দাউদ খানের পিএইচডি গবেষণার সুপারভাইজার।

পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থান করছেন অধ্যাপক জসিম উদ্দিন। হোয়াটসঅ্যাপে কল করা হলে তিনি এ অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, ‘আমি চাকরিতে যোগ দেওয়ার এক থেকে দুই বছর পর ওই প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। ৩৩ বছর পর এই প্রবন্ধে কী লেখা হয়েছে, কপি করা হয়েছে কি না—এসব প্রশ্ন করা হলে তো উত্তর দিতে পারব না। কে বা কারা এমন অভিযোগ করেছেন, তা আমি জানি। কিন্তু তার নাম বলব না। এত বছর পর কেন এই অভিযোগ তোলা হচ্ছে, সেটি সময়ই বলে দেবে।’

এর আগে অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের অধীনে পিএইচডি করা অধ্যাপক দাউদ খানের বিরুদ্ধে গবেষণায় চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠলে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করা হয়। একই অভিযোগে আরেক অধ্যাপক মোসা. রেবেকা সুলতানার বিরুদ্ধেও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।

এদিকে গবেষণা চৌর্যবৃত্তির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক মো. দাউদ খানকে গোবিন্দ দেব দর্শন গবেষণা কেন্দ্রের প্রকাশিতব্য ‘দর্শন ও প্রগতি’ জার্নালের সহযোগী সম্পাদক হিসেবে রাখা হয়েছে। আবার একই অভিযোগে অভিযুক্ত হয়েও উচ্চতর মানববিদ্যা গবেষণা কেন্দ্রের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক জসিম উদ্দিন। চৌর্যবৃত্তিতে অভিযুক্তদের বিভিন্ন গবেষণা কেন্দ্রের সঙ্গে যুক্ত রাখা নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয় বলে মন্তব্য করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক শিক্ষক।

সূত্র জানায়, গত বছর ঢাবির দর্শন বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক কাজী শোয়েবুর রহমান ও আবু সালেম সেখানে আবেদন করেন। কিন্তু নিয়োগের শর্তানুযায়ী তারা যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে আবেদন করেননি। তারপরও ওই পদের জন্য বিভাগ থেকে সালেমের নাম সুপারিশ করার জন্য জোর প্রচেষ্টা চালান অধ্যাপক জসিম উদ্দিন। দুজনের মধ্যে শোয়েবকে বিভাগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের মিটিংয়ে (সিঅ্যান্ডডি) বাদ দেওয়া হলেও আবু সালেমকে বিশেষ বিবেচনায় সুপারিশ করা হয় এবং সাক্ষাৎকারের জন্যও ডাকা হয়। ওই মিটিংয়ের অন্যতম সদস্য ছিলেন অধ্যাপক জসিম উদ্দিন ও অধ্যাপক মো. দাউদ খান।

এদিকে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অধ্যাপক জসিম উদ্দিনের বিরুদ্ধে নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের এটিই প্রথম অভিযোগ নয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে বিভাগের প্রভাষক নিয়োগে আবেদনের শর্তপূরণ না করলেও তোফায়েল আহমেদ নামে একজনকে প্রভাষক পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে তিনি প্রভাব বিস্তার করেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়। এ নিয়োগে প্রভাব বিস্তারের কারণে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ বোর্ডে তাকে না রাখা হলেও অদৃশ্য কারণে ২০২৪ খ্রিষ্টাব্দের নিয়োগ বোর্ডে আবারও অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ ছাড়া তার বিরুদ্ধে অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ড থেকে আর্থিক লেনদেন, নিজ বিভাগে ক্লাস না নিয়ে বেসরকারি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বেশি সময় দেওয়া, পরীক্ষায় পক্ষপাতিত্ব, মিডটার্ম পরীক্ষার নম্বর প্রকাশ না করে চূড়ান্ত পরীক্ষার সময় নয়ছয় করা, শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বাজে ব্যবহার করাসহ বিভিন্ন অভিযোগ পাওয়া গেছে।

এ ছাড়া গত ২৫ ফেব্রুয়ারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের ৩ জন শিক্ষককে সহযোগী অধ্যাপক পদে পদোন্নতির সুপারিশ করেন অধ্যাপক জসিমসহ বোর্ডের অন্য সদস্যরা। যদিও তাদের বিরুদ্ধে গবেষণা চৌর্যবৃত্তির সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছিল। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ফরিদ আহমেদের লিখিত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তপূর্বক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ইউজিসির চেয়ারম্যানকে চিঠি দেয় শিক্ষা মন্ত্রণালয়। পরবর্তী সময়ে উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটে তা ত্রুটিপূর্ণ বলে বাতিল করেন।

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে দর্শন বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. শাহ কাওসার মুস্তাফা আবুল উলায়ী কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. সীতেশ চন্দ্র বাছার বলেন, রেবেকা সুলতানাকে ৭ দিনের মধ্যে লিখিত জবাব দিতে বলেছি। এরপর আরও কিছু প্রসিডিউর শেষে প্রতিবেদন জমা হবে। এ ছাড়া দাউদ খানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিষয়েও কমিটি কাজ করছে। তিনি আরও বলেন, গবেষণার ক্ষেত্রে প্যারেন্টিং নেই, সবাই একলা গবেষণা করতে চায়। অনেক আগে যারা গবেষণা করেছেন তারা গবেষণার অনেক নিয়ম জানেন না—এসব কারণে চৌর্যবৃত্তির অভিযোগ উঠছে। সেজন্য আমরা ওয়েবসাইটে রিসার্চ ইন্টিগ্রিটি ফ্রেমওয়ার্ক দিয়েছি। ক্রমান্বয়ে তা আপডেট করা হচ্ছে। আমরা সবার মধ্যে সততা, স্বচ্ছতা দেখতে চাই। আশা করছি, আগামী ৫ বছরের মধ্যে নতুন করে গবেষণায় কোনো চৌর্যবৃত্তির মতো বিষয় আসবে না। তবে বিগত গবেষণায় কোনো অভিযোগ এলে তা নিশ্চয়ই খতিয়ে দেখা হবে। শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এমন কোনো অভিযোগ শুনিনি। তবে ঐকমত্যে পৌঁছাতে না পারায় নিয়োগ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা যায়নি।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের - dainik shiksha হামলায় মোল্লা কলেজের ৩ শিক্ষার্থী নিহত, দাবি কর্তৃপক্ষের সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস - dainik shiksha নৈরাজ্যকারীদের প্রতিহত করা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রধান কাজ: সারজিস মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! - dainik shiksha মিনিস্ট্রি অডিটরদের গরুর দড়িতে বাঁধবেন শিক্ষকরা! সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা - dainik shiksha সোহরাওয়ার্দী কলেজ বন্ধ ঘোষণা সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত - dainik shiksha সাত কলেজের অনার্স ৪র্থ বর্ষের পরীক্ষা স্থগিত কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর - dainik shiksha অনতিবিলম্বে প্রতিবন্ধী বিদ্যালয় এমপিওভুক্ত করতে হবে: নুর কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক - dainik shiksha কওমি মাদরাসা একটি অসমাপ্ত প্রকাশনার কপিরাইট সত্ত্ব পেলেন লেখক দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0055811405181885