গবেষণাবিমুখ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ শিক্ষক

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। এ বিষয়ে দ্বিমত পোষণের কোনো সুযোগ নেই। আমরা সবাই জানি শিক্ষকরা হলেন জাতি গঠনের মূল কারিগর। প্রাইমারি থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত সব শিক্ষক দেশ পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় মানবসম্পদ তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। সুতরাং এই পেশায় যাঁরা রয়েছেন, তাঁদের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে যখন দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে আইন প্রণয়ন করেছিলেন, তিনি তখন শিক্ষকদের জাতির বিবেক হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি জানতেন শিক্ষকরা নিজেদের বিবেকের দ্বারা তাড়িত হবেন। আইন দিয়ে শিক্ষকদের আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান সমুন্নত রাখতে পেরেছি কি? প্রায় ২৪ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োজিত থেকে আমার যে উপলব্ধি হয়েছে, তা হলো সময়ের আবর্তে আমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নিজেদের সম্মান অনেকটা নিজেরাই ভূলুণ্ঠিত করেছি। বুধবার (৬ অক্টোবর) কালের কণ্ঠ পত্রিকায় প্রকাশিত উপসম্পাদকীয়তে এ তথ্য জানা যায়।

উপসম্পাদকীয়তে আরও জানা যায়, ১৯৯০ দশকের শেষের দিকে আমি যখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদান করি, তখন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমাজে অত্যন্ত সম্মানের সঙ্গে দেখা হতো। একটি গ্রামের কোনো পরিবারের সন্তান যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা করার সুযোগ পেতেন, তাহলে বিভিন্ন গ্রাম থেকে মানুষ তাঁকে দেখতে আসত। কিন্তু আমরা নিজেদের প্রশ্ন করলে দেখতে পাব যে এই মহান পেশার সেই সম্মান আজ আর নেই। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সম্মানই কমেনি, সব ক্ষেত্রেই শিক্ষকদের সম্মানহানি হয়েছে, যা এখন বাস্তবতা। এই অবনমনের অন্যতম মূল কারণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনীতির অধিক চর্চা। রাজনৈতিকীকরণের মাত্রা এমন একটি জায়গায় পৌঁছেছে যে শিক্ষকরা বিভিন্ন পদ-পদবি লাভের আশায় ছাত্রলীগ থেকে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাদের পদলেহন করতে ব্যস্ত থাকেন। এমনকি নিজেরা একে অন্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের কুৎসা রটাতেও পিছপা হন না। 

দেশে এমন একটি সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, যেখানে সব কিছুই নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক বিবেচনায়। রাজনীতির শক্তির কাছে মেধা সব সময় হেরে যাচ্ছে। এখানে যেসব শিক্ষক গবেষণার সঙ্গে জড়িত কিংবা আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিসম্পন্ন, তাঁদের মূল্যায়ন করা হয় না। পরিস্থিতি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত।  ফলে একজন শিক্ষক বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরিতে যোগদানের পর থেকে তদবির করতে ব্যস্ত থাকেন। পরিস্থিতি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছে যে বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকরা রাজনীতির কারণে কনিষ্ঠ শিক্ষকদের ব্যবহার করছেন, আবার কনিষ্ঠ শিক্ষকরা এই রাজনীতির কারণেই বয়োজ্যেষ্ঠ শিক্ষকদের অসম্মান করছেন। রাজনীতির এই ভয়াল থাবা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে যদি বের করে না নিয়ে আসা যায়, তবে আগামী দিনে পরিস্থিতি আরো খারাপের দিকে যাবে বলে আমি বিশ্বাস করি।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সরকারি চাকরির তুলনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়া অনেক সহজ। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগপ্রক্রিয়াকে বিসিএসের নিয়োগপ্রক্রিয়ার সঙ্গে তুলনা করি, তাহলে দেখব যে বিসিএসে একজন শিক্ষার্থীকে চূড়ান্তভাবে মনোনয়ন পেতে অনেক ধাপ অতিক্রম করতে হয়। প্রতিটি ধাপই প্রতিযোগিতামূলক। কিন্তু বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে যে প্রক্রিয়ায় নিয়োগ প্রদান করা হয়, তাতে দেখা যায় যে রাজনৈতিকভাবে শক্ত কোনো প্রতিযোগী তিনি যদি অন্য প্রতিযোগীদের তুলনায় মেধাক্রমে পিছিয়েও থাকেন, তাহলেও তিনি চাকরি পান। আমি আমার অনেক সহকর্মীকে জানি, যাঁরা কোনো প্রতিযোগিতামূলক চাকরিতে টিকতে না পারলেও ঠিকই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হয়েছেন। আমি কাউকে ছোট করার জন্য এই বিষয়টির অবতারণা করছি না, বরং এই উদাহরণের মাধ্যমে প্রকৃত অবস্থা তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ফলে যখন একজন প্রার্থী মেধার বিবেচনায় চাকরি না পেয়ে রাজনৈতিক বিবেচনায় চাকরি পান, সেই প্রার্থী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠন-পাঠন এবং গবেষণায় কতটা অবদান রাখতে পারবেন—সেটি অত্যন্ত সহজেই অনুমেয়।

চাকরি পাওয়ার স্বার্থে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় যোগদান করলে তাঁর পক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় এবং দেশের উন্নয়নে অবদান রাখার সুযোগ খুব কম থাকে। তবে পাশাপাশি এটিও ঠিক, এই বিষয়টিকে সব ক্ষেত্রে সাধারণীকরণ ঠিক হবে না। কারণ আমরা অনেক শিক্ষককে দেখেছি যাঁদের একাডেমিক রেজাল্ট হয়তো খুব ভালো নয়, কিন্তু পরবর্তী সময়ে নিজেদের সত্যিকারের গবেষক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।

ফলে আমাদের এই মুহূর্তে যেটি সবচেয়ে প্রয়োজন, সেটি হলো বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নিয়োগপ্রক্রিয়ায় আমূল পরিবর্তন আনা। পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোতে দেখেছি যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশায় নিয়োগ পাওয়ার ক্ষেত্রে গবেষণার অভিজ্ঞতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, এটি যোগ্যতা হিসেবে বিবেচিত হয়। একজন প্রার্থীকে অবশ্যই পিএইচডি ডিগ্রিধারী হতে হয়। এর অর্থ হচ্ছে এই যে একজন প্রার্থী পিএইচডি অর্জনের পর্যায়ে গবেষণা সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করেন, যা পরবর্তী সময়ে গবেষণার কাজে লাগান। কিন্তু বাংলাদেশে আমরা এমন এক ধরনের পদ্ধতিতে শিক্ষক নিয়োগ করি, যেখানে মাস্টার্স পাস করার পর একজন ছাত্রকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়; যাঁর নিজের কোনো গবেষণার অভিজ্ঞতা নেই তাঁকে ছাত্রদের গবেষণা শেখাতে হচ্ছে। এই প্রক্রিয়া থেকে আমরা যদি বের না হয়ে আসতে পারি, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব নয়।

আমাদের স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ১৯৭৩ সালের নিয়মে চলে। তখনকার প্রেক্ষাপটে একাধিক প্রকাশনা থাকা কোনো শিক্ষককে পরবর্তী পদে পদোন্নতি প্রদান করা হলেও বর্তমান প্রেক্ষাপটে এটি একেবারেই কাম্য নয়। আমি কয়েক দিন আগে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বোর্ডে বসেছিলাম। সেখানে দেখেছি কিভাবে নিম্নমানের অনলাইনভিত্তিক জার্নালের প্রকাশনা দিয়ে প্রার্থীরা রেয়াতের মাধ্যমে পদোন্নতি চেয়েছেন। এমন এক জার্নালে শিক্ষকরা তাঁদের গবেষণা প্রকাশ করেছেন, যেখানে গবেষণার শিরোনামই ভুলে ভরা। 

এ অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হলে আমাদের পদোন্নতির নীতিমালা পরিবর্তন করা দরকার। আমরা জানি যে ইউজিসি সব বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য পদোন্নতির একটি সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, চার বছরের অধিক সময় অতিক্রান্ত হলেও এই নীতিমালা এখনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কার্যকর হয়নি। এটি কার্যকর না করা হলে একই রকমভাবে শিক্ষকরা পদোন্নতি পাবেন, যেখানে মেধার কোনো গুরুত্বই থাকবে না। সহজেই পদোন্নতি পাওয়ার ফলে শিক্ষকদের মধ্যে গবেষণায় মনোনিবেশ করার প্রবণতা কমতে থাকে।

বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের অবনমনের জন্য শুধু শিক্ষকদের দোষারোপ করে লাভ নেই। কারণ অনেক ক্ষেত্রেই সরকারি তরফে একজন প্রার্থীর একাডেমিক, গবেষণা ও প্রশাসনিক সম্পর্কিত যোগ্যতাকে গুরুত্ব না দিয়ে রাজনৈতিক সুপারিশকে গুরুত্ব দিয়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ পর্যায়ে পদায়ন করা হচ্ছে। এই পদায়নের ক্ষেত্রে যদি যোগ্যতাসম্পন্ন প্রার্থীদের প্রাধান্য দেওয়া যেত, তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষার মানের ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন আসতে পারত।

তবে এ কথাও ঠিক যে সরকার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ্য ব্যক্তিকে পদায়ন করেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে শিক্ষকদের মূল কাজ শিক্ষার্থীদের শিক্ষাদান করা এবং গবেষণাকর্ম পরিচালনা করা, যার মাধ্যমে দেশ এগিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের একটি বড় অংশ গবেষণাবিমুখ। তাঁরা ব্যস্ত রাজনৈতিক কার্যক্রমে। তাঁদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে কিভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পদ-পদবি বাগিয়ে নেওয়া যায়। এই সংস্কৃতি থেকে যদি আমরা বের হয়ে না আসতে পারি, তাহলে আমাদের আগামী দিনগুলোতেও শিক্ষকদের সম্পর্কে এ ধরনের মন্তব্য শুনতে হবে। ফলে সরকার, শিক্ষক ও প্রশাসনকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার জন্য।

 লেখক :  ড. প্রণব কুমার পাণ্ডে, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের, লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0065150260925293