গাইড বই-কোচিং সেন্টার বন্ধ হচ্ছে না, থাকছে অন্য নামে

নিজস্ব প্রতিবেদক |

গাইড বই মুদ্রণ ও কোচিং সেন্টার বন্ধ হচ্ছে না। বরং আইনি কাঠামোর মধ্যে কোচিং সেন্টার স্থাপন এবং নোট ও গাইড বইয়ের আদলে সহায়ক পুস্তক প্রকাশের সুযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার। এমন বিধান রেখে শিক্ষা আইনের খসড়া মোটামুটি চূড়ান্ত করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। অনুমোদনের জন্য শিগগিরই তা মন্ত্রিসভা বৈঠকে তোলা হবে।

খসড়া আইনে গাইড বই প্রকাশ ও কোচিং সেন্টার স্থাপনের সুযোগ রাখায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন শিক্ষাবিদেরা। তাঁরা বলছেন, কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ না করে তা স্থাপনে আইনি অনুমোদন দিলে শিক্ষকদের মনোযোগ সেখান থেকে ফেরানো যাবে না। আর বাজারে গাইড বই থাকলে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট হবে।

জাতীয় শিক্ষানীতি পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে ২০১১ সাল থেকে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে সরকার। ২০১৩ সালে একটি খসড়া করা হলেও তা বেশি দূর এগোয়নি। এরপর ২০১৬ সালের শেষে শিক্ষা আইনের খসড়া করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হলেও তা ফেরত দেওয়া হয়। ২০১৭ সালের সেপ্টেম্বরে দ্বিতীয়বার মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এই আইনের খসড়া পাঠানো হলে বেশ কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দিয়ে তা ফেরত দেওয়া হয়। এরপর অংশীজনদের সঙ্গে একাধিক বৈঠক করে শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা (মউশি) বিভাগ।

খসড়া আইনে প্রাক্-প্রাথমিক থেকে পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত প্রাথমিক স্তর, ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত মাধ্যমিক, একাদশ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত উচ্চ মাধ্যমিক এবং স্নাতক ও এর ওপরের স্তরের শিক্ষাকে উচ্চশিক্ষা স্তর হিসেবে ধরা হয়েছে। এই আইন পাস হলে সরকার সময়-সময় প্রাক্-প্রাথমিক, প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণ এবং কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা কার্যক্রমের মানোন্নয়নে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পারবে।

খসড়া আইনে বলা হয়েছে, কোনো ধরনের নোট বই বা গাইড বই মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে না। এই বিধান লঙ্ঘন করলে তিন বছরের কারাদণ্ড বা পাঁচ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা

উভয় দণ্ড দেওয়া হবে। কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নোট বা গাইড বই কিনতে ও পড়তে বাধ্য করলে বা উৎসাহ দিলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য করে সংশ্লিষ্ট শিক্ষক, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধান বা পরিচালনা কমিটির সদস্যদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। সরকারের অনুমোদন সাপেক্ষে সহায়ক পুস্তক মুদ্রণ, বাঁধাই, প্রকাশ বা বাজারজাত করা যাবে। তবে কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা কোনো শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সহায়ক পুস্তক ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করতে পারবে না। ক্রয় বা পাঠে বাধ্য করলে তা অসদাচরণ হিসেবে গণ্য হবে।

এই আইন পাস হলে সরকারের অনুমোদন ছাড়া পাঠ্যপুস্তকের বিষয়বস্তু এবং এর আলোকে বিভিন্ন পরীক্ষার সম্ভাব্য প্রশ্নাবলির উত্তর পত্রিকায় মুদ্রণ বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে না। খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে প্রাইভেট টিউশনের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পিছিয়ে পড়া শিক্ষার্থীদের শনাক্ত করে সংশ্লিষ্ট অভিভাবকদের লিখিত সম্মতি নিয়ে স্কুল সময়ের আগে-পরে সরকারের নীতিমালা, পরিপত্র বা নির্বাহী আদেশ অনুসরণ করে অতিরিক্ত ক্লাসের ব্যবস্থা করা যাবে। কোনো শিক্ষক নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে অর্থের বিনিময়ে ইলেকট্রনিক বা অনলাইন পদ্ধতিতে প্রাইভেট টিউশন বা কোচিংয়ের মাধ্যমে পাঠদান করতে পারবেন না।

খসড়ায় বলা হয়েছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের প্রাইভেট টিউশনির মাধ্যমে পাঠদানের উদ্দেশ্যে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করা বা কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা এই আইনের অধীনে নিষিদ্ধ হবে না। তবে শর্ত থাকবে যে, কোচিংয়ের শিক্ষক বা শিক্ষার্থীর নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ক্লাস চলাকালে কোচিং কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করতে পারবে না। এটা করলে ওই শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে। কোচিং সেন্টারের অনুমোদন ও নিবন্ধন বাতিলযোগ্য হবে। কোচিং সেন্টারে কোনো শিক্ষক তাঁর নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থীকে পাঠদান করাতে পারবেন না। এটা করলে তা শাস্তিযোগ্য হবে। কোচিং সেন্টারে শিক্ষকতা করা, পাঠদান করা এই আইনের অধীন নিষিদ্ধ বা দণ্ডনীয় হবে না।

সরকারের কাছ থেকে নিবন্ধন নিয়ে কোচিং সেন্টার পরিচালনা করতে হবে। তবে একই কোচিং সেন্টারে দেশি শিক্ষাক্রম ও বিদেশি শিক্ষাক্রমের পাঠদান করা যাবে না। এই নিয়ম না মানলে তিন বছর কারাদণ্ড বা ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড দেওয়া হবে।

সরকারের অনুমতি না নিয়ে কোনো বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান করা যাবে না। কোনো এলাকা বা অঞ্চলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পরিচালনার প্রয়োজনীয়তা নেই বলে সরকার মনে করলে সেগুলো বিলুপ্ত, পার্শ্ববর্তী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত বা অন্যত্র স্থানান্তর করা যাবে। জনসংখ্যার ঘনত্ব, ভৌগোলিক গুরুত্ব, অনগ্রসরতা, দূরত্ব, প্রতিকূল যোগাযোগব্যবস্থা, নদীভাঙন বিবেচনায় নিয়ে সরকার নতুন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করবে।

এই আইন পাস হলে সরকারের অনুমতি পাওয়া শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিদেশি শিক্ষাক্রমে পরিচালিত স্কুল, বিদেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশ শাখা ও কিন্ডারগার্টেনগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে নিবন্ধন করতে হবে। বাংলা, ইংরেজি ভার্সনসহ বিদেশি শিক্ষাক্রমে পরিচালিত সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের বেতন, টিউশন ও অন্যান্য ফি অযৌক্তিকভাবে উচ্চহারে আদায় করা হলে সরকার ব্যবস্থা নিতে পারবে।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (নিরীক্ষা ও আইন) খালেদা আক্তার বলেন, শিক্ষা আইনের খসড়া চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের এ-সংক্রান্ত কমিটি কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছে। সেগুলো পূরণ করে শিগগিরই তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা জানান, শিক্ষা আইনের খসড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে এলে তা মন্ত্রিসভায় তোলা হবে।

নিষিদ্ধ হোক গাইড বই, কোচিং সেন্টার

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ‘আইনে কোচিং সেন্টার স্থাপনের সুযোগ রাখা ঠিক হবে না। এই কোচিং সেন্টারেই আমাদের সব থেকে বেশি আপত্তি। কোচিং সেন্টার নিষিদ্ধ করা উচিত। কারণ, শিক্ষকদের নজর সেদিকে থাকে। কোচিং সেন্টারের আইডিয়াটাই যথার্থ নয়। আইন করা উচিত, যাতে ক্লাসেই সব পড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়। শিক্ষকেরা যাতে যথার্থ মর্যাদা পান, তা-ও নিশ্চিত করতে হবে।’

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক অধ্যাপক ফাহিমা খাতুন বলেন, ‘এটা মেনে নেওয়া যায় না। যেসব জিনিস নিষিদ্ধের জন্য এত দিন কথা বললাম, সেটা আইনের খসড়ায় কীভাবে থাকে? এসব বিষয়কে আইনি স্বীকৃতি দিলে শিক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা নষ্ট হবে।’

২০১১ সাল থেকে শিক্ষা আইনের খসড়া প্রণয়নের কাজ শুরু করে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে দুটি খসড়া করা হলেও নানা বিতর্কের কারণে তা আলোর মুখ দেখেনি। সেই প্রসঙ্গ তুলে অধ্যাপক ফাহিমা বলেন, এসব যদি আইনের খসড়ায় রাখা হয় তাহলে কেন এত সময়ক্ষেপণ করা হলো? এটা খুবই দুঃখজনক।

অভিভাবক ঐক্য ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, ‘কোচিং-বাণিজ্য ও নোট বই নিষিদ্ধের জন্য আমরা দীর্ঘদিন থেকে দাবি জানিয়ে আসছি। এর পরও শিক্ষা আইনে কোচিং-বাণিজ্যকে স্বীকৃতি দেওয়া হচ্ছে। নোট বই ও কোচিং নিষিদ্ধ করে আইনের খসড়া সংশোধনের দাবি জানাচ্ছি।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা - dainik shiksha দেড় মাস পর ক্লাসে ফিরছেন বুয়েট শিক্ষার্থীরা, স্থগিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার - dainik shiksha অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত স্কুলের সংখ্যা বাড়াতে চায় সরকার চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা - dainik shiksha চাকরির বয়স নিয়ে শিক্ষামন্ত্রীর চিঠির পর সমাবেশের ডাক দিলো ৩৫ প্রত্যাশীরা স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? - dainik shiksha স্কুলে গ্রীষ্মের ছুটি কি এপ্রিলে এগিয়ে আনা দরকার? কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার - dainik shiksha কলেজের শিক্ষকদের ডিজিটাল বদলির আবেদন শুরু রোববার বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha বুটেক্সের প্রথম সমাবর্তন ৭ সেপ্টেম্বর শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় - dainik shiksha শুক্রবার স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত হয়নি: শিক্ষা মন্ত্রণালয় দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী - dainik shiksha দুর্যোগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছুটিতে বিশেষ কমিটি গঠনে নীতিমালা হবে: শিক্ষামন্ত্রী দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0037519931793213