আমাদের দেশে রাজনীতিবিদদের কথায় ক্রমশঃ মানুষের আস্থা কমে যাচ্ছে। এর পেছনে রাজনীতিকদের অদূরদর্শী চিন্তা, বাছবিচারহীন কথা, কথার মর্মার্থ বোঝার পূর্বে তার জবাব দেয়া দায়ী। আবার পরিস্থিতি অনুযায়ী কথা বলতে না পারার অযোগ্য সত্ত্বেও বাগ্মিতা প্রদর্শন করে সাধারণের আস্থায় আসার প্রচেষ্টা। আর এই অতিকথন দোষে দুষ্ট হয়ে মানুষ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হতে নিজের অযোগ্যতার দায় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে মুচকি হাসা। কাউকে ঠকিয়ে রাজ্য জয়ের আনন্দে বিভোর হওয়াকে তুলনা করা চলে ‘মাতালের সুখ’ বলে। যদিও রাজনীতিতে এর সংখ্যা বেশি নয়। তবে এই আঁতেল গোত্রীয় লোকদের কারণে পরিশীলিত রাজনীতিবিদ, গ্রহণযোগ্য সাদা মনের সরল রাজনীতিবিদ, পরিশ্রমী, ত্যাগী ও জনবান্ধব রাজনীতিকদের কদর ক্রমেই কমে আসছে। মূলত: ভাঁড়গোত্রীয় এসব রাজনীতিক মানুষের কাছে হাস্যরসের যোগান দিচ্ছে। এধরনের দেখা মেলে সাম্প্রতিক কিছু ওয়াজ-মাহফিলে বয়ানের নামে ‘ঢেলে দেই’ ‘মুরুব্বী উঁহু উঁহু’ এর মতো বিরক্তি উদ্রেক করা কিছু ডায়ালগ। পরবর্তীতে উপহাসের সেইসব ডায়ালগ দিয়ে আবার তারা নিজেরাই আনন্দ খোঁজেন। যাকে বলে ভাইরাল! যা ক্রমশঃ ভাইরাসের সংক্রমণ ছাড়িয়ে যাবার উপক্রম। সাবেক আওয়ামী লীগ সরকারের সেতুমন্ত্রী ও পার্টির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের সেই ডায়ালগ ‘পালাবো না’ ‘প্রয়োজনে ফখরুল সাহেবের বাসায় উঠবো’। এর জবাবে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরও কম যান না তাইতো বলে ওঠেন, ‘কাদের সাহেব তো আসলেন না’। পরিস্থিতি মানুষ দেখেছে। সেই কাদের সাহেব ঠিকই পালিয়েছে। সাথে তকমা জুটেছে ‘ফ্যাসিস্ট’। তারও আগে আলোচিত এক এগারো পরবর্তী সময়ে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান মুচলেকা দিয়ে রাজনীতি ছাড়ার ঘোষণা দিলেও অনেক গুজবের ডালপালা গজিয়েছে।
সারাদেশে চলছে গুজব। পাল্টা গুজব আর পাল্টাপাল্টি গুজব। এইসব গুজবের বিস্তার কখনো নিছক হেঁয়ালিপনা থেকে। আবার কখনো প্রতিপক্ষকে ঘায়েলে গোয়েবলসীয় এই নীতি যখন মানুষের ঘুম হারাম করে ছাড়ে তখন পরিত্রাণ পেতে গেলে প্রথম কাজ হচ্ছে গুজবের অংশ না হওয়া। অর্থাৎ গুজব নিজে রটনা না করে অন্যকেও নিরুৎসাহিত করা। আর কোনো খবর যখন বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলে একটু সচেতনতায় অবশ্যই চেক করে নিতে কেউ বাধা দিবে না। তাছাড়া অথেনটিক সোর্স অর্থাৎ ভেরিফাইড পেজ যেমন নিউজ চ্যানেলগুলো উক্ত বিষয়ে কি তথ্য প্রচার করছে সেদিকে নজর রাখা। যতটুকুই নিশ্চিত হোন না কেনো নিজে থেকে সংযোজন বিয়োজন করে বুঝিয়ে বলার চেষ্টায়ও শ্রোতার অপরিপক্ক কিংবা বিশ্লেষণী ক্ষমতা বুঝে কোনো কথার জবাব দেয়া। পারতপক্ষে কোনো রটনা সম্পর্কে শতভাগ নিশ্চিত হলেও স্পর্শকাতর বিষয়গুলো এড়িয়ে চলাই সঙ্গত হবে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নাৎসি নেতা ও হিটলারের প্রচারমন্ত্রী ড. পল যোসেফ গোয়েবলস অপপ্রচারকে হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়ে টার্গেটেড পিপলের কাছে বিনামূল্যে রেডিও কিংবা ট্রাঞ্জেস্টার বিতরণ করে কোনো রকম দ্বিধা ছাড়াই মিথ্যা ও অবাস্তব তথ্য প্রচার করতেন বলে এই নীতিকে সবাই তারই নাম অনুসারে গোয়েবলসীয় নীতি বলে থাকে। কারণ গোয়েবলস বিশ্বাস করতেন একটা মিথ্যাকে ১০০ বার প্রচার করলে সেটা মানুষ সত্য বলে ধরে নেয়। আর এক্ষেত্রে গোয়েবলস অনেকাংশে সফলও হয়েছেন বলে ধরে নেয়া হয়ে থাকে। তার কাজের কারণেই মানুষের কাছে আজও সমালোচিত হয়ে রয়েছেন।
গোয়েবলসের আলোচিত উক্তি ছিলা, ‘আপনি যদি একটি মিথ্যা বলেন এবং সেটা বারবার সবার সামনে বলতে থাকেন তাহলে লোকজন একসময় সেটা বিশ্বাস করতে শুরু করবে।’ পরে অবশ্য তিনি সস্ত্রীক আত্মহত্যা করেন। সেই থেকে অদ্যাবধি গুজব নিয়ে যত কায়কারবার, ওঠে আসে তার নাম। জার্মানির হিটলারের ছিল আরেক অস্ত্র ‘গুজব মন্ত্রণালয়’। গুজব মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী থাকাকালীন তার যত কুকীর্তি আড়ল করতেই একের পর এক উদ্ভট তত্ত্ব নিয়ে হাজির হতে থাকেন তৎকালীন সময়ের ‘গুজব রাজা’ গোয়েবলস।
তবে সকল মানুষের মধ্যেই যেকোনো কিছুকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে তোলার একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। আবার ঘটে যাওয়া সত্যকে আড়াল করতেও শাসকগোষ্ঠী এমনটা করার নজিরও বেশ লক্ষণীয় ছিলো। আবার যুগে যুগে শাসকদের ঘুম হারাম করতেও এই একই হাতিয়ার ছিল ‘গুজব’। যা কখনো কখনো মারাত্মক আকার ধারণ করে দাঙ্গা বাধিয়ে দিতে দেখা গেছে। সকল ক্ষেত্রেই উৎস্যুক জনতার হেঁয়ালিপনাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দায়ী। তার আগে যা ঘটার ঘটে যায়। যা হওয়ার হয়ে যায়। যাতে প্রশাসনের কার্যত কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে। নিয়ন্ত্রণ করাও দুষ্কর।
সম্প্রতি বাংলাদেশে সরকার পতনের পর যে যেমন করে পারছে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে। এই গুজবের ফলে প্রাণ বিসর্জনের মতো ঘটনা ঘটছে অহরহ। এতে করে মব জাস্টিস, মব লিঞ্চিং, ফার্স্ট ডিগ্রি মার্ডার এর মতো ঘটনাও ঘটছে। ধারাবাহিকভাবে গুজব রটিয়ে যাচ্ছে তথাকথিত মিডিয়াও। যাদের প্রচুর ‘ভিউ’ দরকার। কে কার আগে এসব হটকেক সামনে এনে আমজনতার রসের খোরাক জুগিয়ে টাকা কামাইয়ের ধান্ধাবাজিতে ব্যস্ত। উপরন্তু সোস্যাল মিডিয়ার মতো সস্তা মাধ্যম দিয়ে প্রতিনিয়ত তৈরি হওয়া সেলিব্রিটি তো রয়েছেই।
আবার কখনো দেখা যাচ্ছে পূর্বের ন্যয় কল রেকর্ড ফাঁস। তার ওপর রয়েছে চ্যাটিং সাইটের স্ক্রিনশট ফাঁস। সেই ফাঁস হওয়া নিয়েও চলে তুঘলকি কাণ্ড। এতে শিকার হয়েছেন সরকারের উচ্চ পর্যায়ের আমলা থেকে শুরু করে হাল আমলের সমন্বয়ক। তবে গুজব নিয়ে বেশ ট্রল আর রোস্টিংয়ের শিকার হচ্ছেন কেউ। আবার নিজেও অন্যদের বিরুদ্ধে গুজব রটিয়ে ফায়দা তুলতেও ব্যস্ত রয়েছেন অনেকে। এতে আর যাই হোক ভালো কিছু হয় না সেটা সহজেই অনুমেয়। কারণ একপক্ষ যখন প্রচার করছে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সেনাপ্রধানের দ্বন্দ্বের কথা। আবার কেউ প্রচার করছেন, যে কোটার কারণে এতবড় আন্দোলন আবার সেই কোটা ভিন্ন রূপে ফিরিয়ে আনলো আন্দোলনকারীরা। আন্দোলনে হতাহতদের কোটায় চাকরি, ভাতা, পরিবারের সদস্যদের চাকরি ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধা দিতে দাবি জানানো পূর্বের অবস্থাকেই ফিরিয়ে আনা নয়তো! তাহলে কি বঞ্চিত মানুষজন এমন করে প্রতি ধৈর্য্যকাল সীমা পেরিয়ে আবার আন্দোলন করে একই অবস্থা ফিরিয়ে আনতে চাইবে? যদি না হয়ে থাকে তবে এখন সহনীয় পর্যায়ে রাখা সমীচীন হবে। নচেৎ একদিকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা অন্যদিকে ২৪ অভ্যুত্থান পরবর্তী কোটা। সবমিলিয়ে সাধারণ মানুষ অর্থাৎ কোটার বাহিরে থেকে যাচ্ছে সিংহভাগ মানুষ। যারা কোনো কোটা না পেয়ে আবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠাও সময়ের আলামত।
সেই গুজব থেকে পরিত্রাণের উপায় হচ্ছে, যা-ই কিছু ঘটুক না কেনো, যদি জানতে হয় অথেনটিক সোর্স থেকে জানা। অথবা যে সোর্স থেকেই জানবেন সেইসব সোর্সকে ফ্যাক্টচেকের মাধ্যমে যাচাই করা। আজকাল অনেক ফ্যাক্টচেক প্রতিষ্ঠান নিজে থেকেই জানিয়ে দেয় কোনটা আসল আর কোনটা নকল মানে ভুয়া। এজন্যে ভেরিফায়েড সোর্স থেকে জানা তথ্য অনেকাংশে নিশ্চিত হওয়া যায়। তবে সেক্ষেত্রেও জটিলতা দেখা যায়। প্রথমেই একটা নিউজ করে পরে ডিলিট করে দিতেও দেখা গেছে। আবার যারা গুজব রটনায় লিপ্ত তারা বিভিন্ন নিউজ চ্যানেলের স্টিকার বানিয়েও প্রচার করে থাকে। এতে সাধারণ জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে থাকে। তাছাড়া বিভিন্ন টিভি মিডিয়ার নিউজ চ্যানেলের আদলে অনেকেই অনলাইন নিউজ চ্যানেল গড়ে তুলে বা আইপি টিভিতে নিউজ প্রচার করে। কোনরূপ সত্যতা যাচাই না করেই।
এখন অবাধ তথ্যপ্রবাহের যুগ। যে যার যার অবস্থান থেকে নিজস্ব বিশ্লেষণী ক্ষমতা প্রয়োগের মাধ্যমেও মনগড়া তথ্য প্রচার করায় কিছুটা হলেও মানুষের জীবন অনাকাঙ্ক্ষিত হুমকিতে পতিত হচ্ছে। কেউই ভাবে না তার একটা অহেতুক তথ্য ছড়ানোতে তার নিজের যদি না-ও হয় কোনো নিকটাত্মীয় ঠিকই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যেতে পারে। গুজব এখন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। আমরা সেই ব্যাধিতে ভুগছি। যদি এর মহামারি আকার ধারণ করে তবেই কি ঘুম ভাঙবে নীতিনির্ধারকদের?
মিথ্যা, ভুল তথ্য, বানোয়াট তথ্য দিয়ে গুজব রটানো হয়ে থাকে। এতে মানুষে মানুষে বিদ্বেষ বাড়ে। সমাজে হিংসাত্মক মনোভাব তৈরি হয়ে হানাহানি বাড়ে। এসব হয় সামাজিক রীতিনীতি, প্রথা, রাজনীতিক বিশ্বাস, ধর্মীয় কুসংস্কার, বিদেশি অপসংস্কৃতি, সংবেদনশীল তথ্য, অজ্ঞানতা, গোঁড়ামি, কুসংস্কার থেকে। এতে মানুষের কল্যাণ তো নেই-ই রয়েছে অকল্যাণ। গুজব থেকে মানুষের পরিত্রাণ পেতে সচেতনতার বিকল্প নেই।
সমাজবিজ্ঞানের ভাষায়, গুজব হলো এমন কোনো বিবৃতি যার সত্যতা অল্প সময়ে কিংবা কখনোই নিশ্চিত করা সম্ভব হয় না। তবে গুজবের ভিতর এমন কিছু চটকদারিত্ব থাকে, যা সহজে মানুষকে প্রলুব্ধ বা আকৃষ্ট করে। যেহেতু সত্য মিথ্যা সহজে নির্ণয় করা যায় না তাই এটি মানুষকে দ্বিধাগ্রস্ত করে।
এতে করে সমাজের গোষ্ঠীতে গোষ্ঠীতে দ্বন্দ্ব হয়। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। ধর্মীয় মতাবলম্বীদের মধ্যে দ্বন্দ্ব হয়। বিভ্রান্তিকর তথ্যের ঢালাও বা একচেটিয়া প্রচারের ফলেও গ্রামে গ্রামে দ্বন্দ্ব হয়।
অনিশ্চিত পরিস্থিতি, উদ্বেগ, তথ্যের গুরুত্ব, অস্পষ্টতা, নিজের ভাবমূর্তি রক্ষা, নিছক ভালো লাগা, প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে, নিজের সামাজিক অবস্থানের কারণে এর প্রবাহ বাড়ে। যা কোনভাবেই কাম্য নয়।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিশেষ করে ফেসবুক, ইউটিউব কিংবা যেকোনো পত্রিকা শেয়ার না করা। কমেন্ট না করা। লাইক না দেয়া। আর নিজে থেকে কোনো বক্তব্য নিশ্চিত না হয়ে দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিবিদদের মতো লাগামহীন কথা বলা থেকেও বিরত থাকতে হবে। কারণ রাজনীতিকরা মঞ্চে ওঠে যা ইচ্ছে তা-ই বলে বেড়ানোর ফলে সীমিত চিন্তার অধিকারী এসবে বিশ্বাস করেন। আর এতেই যত সমস্যার সূত্রপাত। সেইসব ব্যক্তি নিজে যতটুকু ধারণ করতে পারে তার বেশি প্রচার করে। প্রচারের কোনো নিয়ম নীতি তার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয় মনে করে এসব করে।
শেষে, দরকার আত্মোপলব্ধি। নিছক একটা কথায় চলে যেতে পারে প্রাণ। ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দাঙ্গা। আমরা সামাজিক জীব। প্রতিনিয়ত প্রতিকূল পরিস্থিতির সঙ্গে লড়তে হচ্ছে আমাদের। তার ওপর গুজব নির্ভরতার সঙ্গে লড়ে যেতে হচ্ছে। একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি। অন্যদিকে অর্থনৈতিক মূল্যস্ফীতি। তার ওপর অর্থ পাচার, বেকারত্ব। সবমিলিয়ে একটা জাতি যখনই উঠে দাঁড়াতে চায় তখনই কোনো না কোনো দুর্যোগ। প্রাকৃতিক হলে সেটা সৃষ্টিকর্তা রক্ষা করেন ভিন্নভাবে পুষিয়ে দিয়ে। কিন্তু মানবসৃষ্ট দুর্যোগ গুজব কাটিয়ে ওঠার কার্যকর উপায় কি? আদৌ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব?
লেখক: অ্যাডভোকেট, জেলা ও দায়রা জজ আদালত, ফেনী।