গোটা উচ্চশিক্ষাই আজ বেশ বড় দাগে প্রশ্নের সম্মুখীন

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটির ধার ও ভার উভয়ই যে অস্তগামী-একথা অনেক আগে থেকেই শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু দেখতে দেখতে তা যে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকে যাবে, এটা যে কারও কাছেই ভাবনার অতীত। আসলে বিশ্ববিদ্যালয় ও উপাচার্য যে কী জিনিস, সেটাই বোধকরি আজ পর্যন্ত সঠিকভাবে আমাদের উপলব্ধিতে আসেনি। অথচ দেশে দেড় শর বেশি বিশ্ববিদ্যালয়! 

‘সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে নানা অনিয়ম : আট উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্তে ইউজিসি : আরও ১৩ জনের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন জমা পড়েছে মন্ত্রণালয়ে : অধিকাংশের বিরুদ্ধে স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, নির্মাণ ও কেনাকাটায় দুর্নীতির অভিযোগ : ‘কমপক্ষে চারজনকে এখনই অপসারণ করা দরকার’- ইউজিসি সদস্য।’ 

 নিবন্ধে আরও জানা যায়, উদ্ধৃতিচিহ্নের ভেতরের বাক্য ও শব্দগুলো একটি পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম ও উপশিরোনাম। প্রতিবেদনে অভিযুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে রয়েছে খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ইসলামী আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।

প্রতিবেদনটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘এছাড়া আরও ১৩ উপাচার্যের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ করেছে ইউজিসি। মোট ২১ উপাচার্যের বিরুদ্ধে অভিযোগের বেশির ভাগই স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ, ভবন নির্মাণ ও কেনাকাটায় আর্থিক দুর্নীতিসংক্রান্ত। এছাড়া কারও বিরুদ্ধে স্বেচ্ছাচারিতা, নারী কেলেঙ্কারিসহ নানা অপরাধের অভিযোগও আছে।’ 

মোটামুটি বড় কলেবরের প্রতিবেদনটিতে ইউজিসির একজন সদস্য (পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়) অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগমের ভাষ্যটিও প্রণিধানযোগ্য। অধ্যাপক ড. দিল আফরোজা বেগম বলেন, দুর্নীতি করেও বিচারের মুখোমুখি হতে হবে না-এমন বিশ্বাস যদি থাকে, তাহলে বেপরোয়া হওয়াটাই স্বাভাবিক।

তিনি বলেন, ৮-১০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বিরুদ্ধে বর্তমানে আমরা তদন্ত করছি। আরও ১৩টি প্রতিবেদন গত ১৫ মাসেই জমা দিয়েছি। আমরা তদন্তে যে তথ্য পেয়েছি তাতে এ মুহূর্তে কমপক্ষে চারজন উপাচার্যকে অপসারণ করা দরকার। এটি হয়তো হবে না। কেননা এতে ভাবমূর্তির সমস্যা হতে পারে। প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে এদের উপাচার্য করা হলো কেন।’

প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে-‘শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, উদ্বেগের কারণ হচ্ছে নজিরবিহীনভাবে কয়েক উপাচার্যের একটি চক্র তৈরি হয়েছে। তারা একজন আরেকজনের বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য। ফলে তারা স্বাভাবিকভাবেই পরস্পরের অনিয়মের পাহারাদার।’

একটি দৈনিকের প্রথম পাতায় ৬ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত উল্লিখিত শিরোনাম ও উপশিরোনামের প্রতিবেদনটি পড়ে কার মনে কী প্রতিক্রিয়া হয়েছে বা হচ্ছে, তা আমার মতো সাধারণ ব্যক্তির জানার কথা নয়।

এর আগে ১৪ জানুয়ারি ওই দৈনিকের শেষ পাতায় একটি শিরোনাম দেখলাম-‘গভীর রাতে বাড়ি ছাড়লেন হাবিপ্রবির (হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়) উপাচার্য।’ মাঝে মাত্র একটি দিন গেল। ১৬ জানুয়ারি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হওয়া আরও একটি খবর চোখে পড়ল-‘পেছনের দরজা দিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়লেন রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ড. কলিমউল্লাহ।’

এমন লজ্জা লুকিয়ে বা ঢেকে রাখার নয়। এ লজ্জা আমার, আপনার-সবার। এমন অবাঞ্ছিত, অনভিপ্রেত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে বের করাটা অতীব জরুরি।

পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে কীসব ঘটে চলেছে? একের পর এক কীসব ঘটনার জন্ম দিয়ে চলেছেন একেকজন উপাচার্য? উপাচার্যের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদটির ধার ও ভার আজকাল কোথায় গিয়ে ঠেকেছে!

খানিকটা পেছনে ফিরে তাকানো যাক। নানা ইস্যুতে ২০১৫ সালের প্রথমদিকে রংপুরে অবস্থিত বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়টি উত্তপ্ত হয়ে উঠে। ভর্তি কার্যক্রমসহ সবকিছু একেবারে অচল হয়ে পড়ে। ২০১৫ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি একই পত্রিকায় প্রকাশিত এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়: ‘মূলত দুর্নীতির অভিযোগে অব্যাহতিপ্রাপ্ত সাবেক ভিসির সুবিধাভোগী শিক্ষক, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মচারী, সাবেক ভিসির নিয়োগপ্রাপ্ত ভাই, ভায়রা, ভাতিজি, ভাগ্নি, শ্যালিকা, নাতি-নাতনি, মেয়ে, জামাতাসহ ৪০ জন নিকটাত্মীয় ও স্থানীয় কিছু জনপ্রতিনিধি এ আন্দোলনের নেপথ্যে রসদ জোগাচ্ছেন।’

একই বছর (২০১৫) শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের অনিয়ম-দুর্নীতি নিয়ে অন্য একটি পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের শিরোনাম দেওয়া হয়-‘উপাচার্য়ের আত্মীয়স্বজন পুনর্বাসন কেন্দ্র শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় : ইউজিসির প্রতিবেদন’। উল্লেখ্য, এ খবরটি দৈনিকটির প্রথম পাতার প্রধান শিরোনাম।

নানা অপকর্মের দায়ে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একের পর এক সাংঘাতিকরূপে সংবাদপত্রের গুরুত্বপূর্ণ শিরোনাম হয়ে উঠছে। দিন, সপ্তাহ, মাস- চলছে তো চলছেই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনিয়ম, অব্যবস্থা, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির ঘটনা কোনোরকমে ফয়সালা বা ধামাচাপা দিতে না দিতেই অন্যটি সামনে চলে আসছে।

বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এসব কিছুর জন্য এককভাবে অথবা যৌথভাবে দায়ী উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ বা রেজিস্ট্রারের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদাধিকারী ব্যক্তিরা। অভিযুক্তদের তালিকায় থাকে অনুষদের ডিন, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নাম। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় তথা গোটা উচ্চশিক্ষাই আজ বেশ বড় দাগে প্রশ্নের সম্মুখীন।

সবচেয়ে মারাত্মক ও উদ্বেগের বিষয়টি হলো আইন ও নিয়মনীতিমালা না মানা ও লঙ্ঘনের বিষয়টি। পারস্পরিক সংশয়, অনাস্থা ও অবিশ্বাসের মাত্রাটি দিনে দিনে এমন স্তরে এসে দাঁড়িয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, এমনকি নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষকেই যেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছেন একেকজন। মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চ্যান্সেলরকে পর্যন্ত ব্যবহার করতে চেষ্টা চালিয়ে যান যার যার স্বার্থে।

উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে সমস্যা যেমন রয়েছে নানাবিধ, তেমনই উন্নয়ন-অগ্রগতি ও সম্ভাবনাগুলোকেও খাটো করে দেখার কোনো অবকাশ নেই। দেশে ৫৪টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়। বেসরকারি আছে ১০৭টি। সরকারি মেডিকেল কলেজ ৩৭টি; বেসরকারি ৭১টি। বিভাগীয় পাঁচ শহরে রয়েছে পাঁচটি মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।

এতকিছু থাকা সত্ত্বেও দুর্নীতি, অনিয়ম আর অব্যবস্থার কারণে উচ্চশিক্ষা নিয়ে সার্বক্ষণিক উদ্বেগ-উৎকণ্ঠায় থাকতে হয় গোটা জাতিকে। স্বাধীনতর পঞ্চাশ বছরের মাথায় এর চেয়ে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় আর কী হতে পারে! তাহলে প্রতিকার কী? সর্বাঙ্গে ব্যথা ওষুধ দেব কোথা অথবা ঠগ বাছতে গেলে যে গাঁ উজাড় হওয়ার উপক্রম হবে!

লেখক : বিমল সরকার, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

[মঙ্গলবার (১৬ ফেব্রুয়ারি) যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত]


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ - dainik shiksha প্রাথমিকের শিক্ষকদের ফের অনলাইনে বদলির সুযোগ তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার - dainik shiksha তীব্র তাপপ্রবাহের ভেতরই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলছে রোববার দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা - dainik shiksha নতুন শিক্ষাক্রম ও কিছু কথা কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার - dainik shiksha স্কুলে দুই শিফটের ক্লাস চালু রাখার সভা রোববার শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য - dainik shiksha শিক্ষা কর্মকর্তার আইডি ভাড়া নিয়ে প্রধান শিক্ষকের বাণিজ্য শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন - dainik shiksha নিষিদ্ধ, মৌলবাদী সংগঠনের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্যবস্থা নিন please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0025110244750977