গ্যাসসঙ্কট নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ জরুরি

শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ |

রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্যাসের চাপ কম থাকার অভিযোগ করেছেন বাসিন্দারা। তিতাসের অভিযোগ কেন্দ্রেও অনেক অভিযোগ আসছে। মোহাম্মদপুর, মিরপুর, পাইকপাড়া, রামপুরা, হাতিরপুল, যাত্রাবাড়ী, ধানমণ্ডি, কল্যাণপুরসহ শহরের অধিকাংশ এলাকার বাসায় গ্যাসের সমস্যা দেখা যাচ্ছে। শিল্পকারখানার অবস্থাও প্রায় একই রকম। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে, তা দিয়ে কারখানা চালু করা দায়। পরিবহনে গ্যাস দিতেও হিমশিম অবস্থা। এর মধ্যেই গ্যাসের সরবরাহ আরও কমেছে। আগামী এক মাসে কাটবে না গ্যাস-সঙ্কট।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস, খনিজ সম্পদ করপোরেশন-পেট্রোবাংলা সূত্র বলছে, ডিসেম্বরের শুরু থেকেই তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানি কমেছে। সরবরাহ নেমে এসেছে অর্ধেকে। গ্যাসের উৎপাদনে চাপ কমে আসায় সম্প্রতি বিবিয়ানায় সংস্কারকাজ শুরু করেছে মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি শেভরন। এ কাজ আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহে শেষ হতে পারে। এটি বর্তমানে দেশের সবচেয়ে বড় উৎপাদন ক্ষেত্র। গ্রাহকদের সতর্ক করে সবচেয়ে বড় গ্যাস বিতরণকারী কোম্পানি তিতাস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়েছে, কারিগরি কারণে তিতাসের আওতাধীন ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ১২ থেকে ২১ জানুয়ারি গ্যাসের স্বল্প চাপ বিরাজ করবে। তবে তিতাসের দুজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, তিতাসের কারিগরি কোনো বিষয় নয়, গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে। পেট্রোবাংলা বলছে, দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুটের মতো। কয়েক মাস আগেও ৩২০ থেকে ৩৩০ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা গেছে। এখন সরবরাহ করা হচ্ছে ২৭০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এতে বিদ্যুৎ, সার কারখানা, সিএনজি স্টেশন, আবাসিক, শিল্পকারখানা—সব খাতেই গ্যাসের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর থেকে সিএনজি স্টেশন দিনে চার ঘণ্টা বন্ধ রাখা হচ্ছে।

এক খাত থেকে কমিয়ে আরেক খাতে সরবরাহ বাড়িয়েও (রেশনিং) পরিস্থিতি সামাল দেয়া যাচ্ছে না। জ্বালানি বিভাগ সূত্র বলছে, মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে নোঙর করা ভাসমান দুটি টার্মিনালের (এফএসআরইউ) মাধ্যমে দিনে ১০০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা আছে। গত ১৮ নভেম্বর বিকেলে সামিটের টার্মিনালের মুরিং লাইন ছিড়ে যায়। এরপর থেকে সরবরাহ বন্ধ। বর্তমানে এটি মেরামতের কাজ চলছে।

আগামী ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এটি চালু করা হবে বলে লিখিতভাবে জানিয়েছিল সামিট। তবে আরও এক সপ্তাহ বেশি সময় লাগতে পারে বলে সম্প্রতি মৌখিকভাবে ধারণা দিয়েছে কোম্পানিটি। এ টার্মিনাল বন্ধ থাকায় দিনে ৫০ কোটি ঘনফুট এলএনজি সরবরাহের সক্ষমতা কমে গেছে। অন্য টার্মিনাল দিয়ে দিনে বর্তমানে ৫০ থেকে ৫৫ কোটি ঘনফুট সরবরাহ করা হচ্ছে। এলএনজি আমদানি করে রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি রূপান্তরিত প্রাকৃতিক গ্যাস কোম্পানি লিমিটেড (আরপিজিসিএল)। এ কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, ৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা সামিটের। আগামী মাসের জন্য এলএনজি আমদানি করতে দরপত্রের প্রস্তুতি চলছে।

এদিকে কয়েক বছর ধরেই দেশের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমছে। একসময় দিনে ২৭০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হলেও বর্তমানে উৎপাদিত হচ্ছে ২৩০ কোটি ঘনফুটের মতো। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন করে শেভরন। বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে দিনে ১৩০ কোটি ঘনফুটের মতো করে উৎপাদন করে আসছিল তারা। এখন দিনে ১১৫ থেকে ১২০ কোটি ঘনফুট উৎপাদন করা হচ্ছে। দিনে ১০ কোটি ঘনফুটের মতো উৎপাদন কমে গেছে। 

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টার জ্বালানিবিষয়ক সহকারী ম. তামিম সাংবাদিকদের বলেন, বিবিয়ানার ওপর একক নির্ভরতা দীর্ঘদিনের। এলএনজি ব্যয়বহুল। তবু গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেয়া হয়নি। আরও আগেই এগুলো ভাবা উচিত ছিল। এ মুহূর্তে জরুরি কিছু করারও নেই রেশনিং ছাড়া। ইতোমধ্যেই শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়ে যেতে শুরু করে। এরই মধ্যে ৪০টি বস্ত্র কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিদ্যমান গ্যাস সঙ্কট সমাধান না হলে আরো শতাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যাওয়ার শঙ্কার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা বলছেন, কাঁচপুর পয়েন্টে হরিপুর গ্যাস ট্রান্সমিশন কোম্পানির গ্যাস রেগুলেশন অ্যান্ড ট্রান্সমিশন সেন্টার থেকে ৩০ ইঞ্চি ব্যাসের মেইন ট্রান্সমিশন লাইন হয়ে প্রচুর পরিমাণে গ্যাস উড়ে যাচ্ছে। ফলে নারায়ণগঞ্জ ও নরসিংদীর শত শত শিল্পপ্রতিষ্ঠানে গ্যাসসঙ্কট দেখা দেয়। হরিপুর পয়েন্টের গ্যাস ভাল্ব লিকেজ হওয়ার কারণেই এ সমস্যা দেখা দিয়েছে। লিক সারানোর জন্য ব্যবসায়ী নেতা ও কারখানা মালিকরা বারবার তিতাসের শরণাপন্ন হয়েও কোনো সমাধান পাননি। ব্যবসায়ী নেতারা বলেন, তিতাস গ্যাস ডিস্ট্রিবিউশন লিমিটেডের কাছে বারবার অনুরোধ করার তারা জিটিসিএলের কাছে যেতে বলে। জিটিসিএলের সঙ্গে যোগাযোগ করলে সেখান থেকে বলা হয়, গ্যাসের সঙ্গে প্রচুর ময়লা আসছে, এ কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ আছে। গ্যাস পাইপের ভাল্ব এবং ফিল্টারিংয়ের সমস্যার কারণে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে বলেও জানিয়েছেন জিটিসিএলের কর্মকর্তারা। পাইপে ছিদ্র থাকার ফলে প্রচুর গ্যাস উড়ে যাচ্ছে। ফলে হরিপুর পয়েন্টে যেকোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনারও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

রাজধানী ঢাকায় গ্যাস সরবরাহের জন্য ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে গঠিত হয় তিতাস গ্যাস ট্রান্সমিশন এন্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেড। লাকড়ির চুলা বা কেরোসিনচালিত স্টোভের পরিবর্তে গ্যাসের চুলায় রান্নার সুযোগ পেয়ে খুব স্বস্তিবোধ করেছিলেন ঢাকাবাসী। পরে এই সুযোগ নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরে বিস্তৃত হলেও তিতাস গ্রাহকদের সে স্বস্তি আর থাকেনি। দিনে দিনে অনিয়ম ও দুর্নীতির আখড়া হয়ে উঠেছে রাষ্ট্রায়ত্ত এই প্রতিষ্ঠানটি। বছর বছর গ্যাসের মূল্য বাড়ানো হলেও গ্রাহক সেবার মান যাচ্ছেতাই। আমলে নেয়া হয় না গ্রাহকদের গুরুতর সব অভিযোগও। তিতাসের এনফোর্সমেন্ট টিম গ্যাস লাইনের সমস্যা অনুসন্ধান ও সমাধানের দিকে নজর না দিয়ে বরং প্রকৃত বিল গোপন করা, অবৈধ সংযোগ, মিটার টেম্পারিং ও নানা অনৈতিক কর্মকাণ্ডের পেছনেই বেশি সময় ব্যয় করে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দুর্নীতির ২২টি উৎস চিহ্নিত করে। তখন দুদকের প্রতিবেদনে ১২ দফা সুপারিশ করা হয়। কিন্তু একটি সুপারিশও এখন পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়নি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, তিতাসের অসাধু কর্মকর্তারা প্রতি মাসে মোটা অঙ্কের ঘুষের বিনিময়ে মিটার টেম্পারিং করে থাকে। তদন্ত কমিটির সদস্যরা রাজধানীর পার্শ্ববর্তী ৫টি এলাকায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৪৫৫টি অবৈধ গ্যাস সংযোগেরও সন্ধান পায়।

গ্রাহকদের প্রকৃত বিল গোপন করা, সংযোগ নীতিমালা অনুসরণ না করা, সিস্টেম লস দেখিয়ে গ্যাস চুরিসহ নানা অপরাধের প্রমাণ মেলে তদন্তে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, অবৈধ সংযোগ বাণিজ্য তিতাসের অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে। এখানেই বেশি দুর্নীতি হয়। রাজধানীর ভেতরে এবং নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার, আশুলিয়া, নরসিংদীতে হাজার হাজার শিল্প প্রতিষ্ঠান অবৈধ গ্যাস সংযোগের মাধ্যমেই চলছে। ঘুষের বিনিময়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ দিয়ে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাতারাতি ধনী হয়ে যাচ্ছেন। ঘুষ পেয়ে তিতাসের অসাধু লোকজন আবাসিকে নিরবচ্ছিন্নভাবে গ্যাস সরবরাহ না করে শিল্প প্রতিষ্ঠানের প্রতি বেশি যত্নবান হন। টাকার অঙ্কে শিল্প-কারখানায় গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানো ও কমানো হয়। কোনো কোনো এলাকায় দিনের বেশির ভাগ সময় একেবারেই গ্যাস সরবরাহ করা হয় না। আর এভাবেই সিস্টেম লস তিতাসের নিয়মে পরিণত হয়েছে।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) একবার তাদের এক গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগের কারণেই তিতাসে ৬ শতাংশের বেশি সিস্টেম লস হয়। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ গ্যাস সংযোগে তিতাসের লোকজনের আগ্রহের কারণে বৈধভাবে সংযোগ পাওয়া গ্রাহকদের জন্য এখন কষ্টসাধ্য। চোরাই লাইনেও গ্যাস সংযোগ দেয়া হচ্ছে। সাধারণত রাতের আঁধারে ‘অবৈধ ও চোরাই’ সংযোগগুলো দেয়া হয় যা তিতাসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারাও জানেন না। ঠিকাদার এবং নিম্ন-মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তাদের চাহিদা মতো ঘুষ দেয়া হলেই সংযোগ মেলে বলে অভিযোগ করেছেন গাজীপুরের এক শিল্প প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ। বৈধ সংযোগ নিতে গেলে তিতাসের কর্মকর্তারাই অবৈধ সংযোগের প্রস্তাব দেয় বলেও জানিয়েছে তারা। এছাড়াও রয়েছে পুনঃসংযোগ ও মিটার টেম্পারিং। মিটার টেম্পারিং তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের আরেকটি বড় বাণিজ্য। ভ্রাম্যমাণ আদালত যখন গ্রাহকের গ্যাস সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে, তখন অসাধু তিতাস কর্মীরা কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ঘুষ নিয়ে রাতের আঁধারে আবার পুনঃসংযোগ দিয়ে দেয়। এই দুর্নীতি দেখতে তিতাসের এনফোর্সমেন্ট টিমেরও কোনো মনিটরিং নেই। গ্যাসের মিটার টেম্পারিং করার ক্ষেত্রেও বিভিন্ন সময়ে দুর্নীতির অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে। তিতাসের লোকজন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মিটার টেম্পারিংয়ের মাধ্যমে বাণিজ্য করছে। তারা মিটার টেম্পারিং করে গ্রাহকের গ্যাসের প্রকৃত বিল গোপন করে এবং কম বিল রিডিং নেয়। জানা গেছে, অবৈধ সংযোগ, মিটার টেম্পারিং, অবৈধ উপায়ে পুনঃসংযোগসহ তিতাসের সব ধরনের দুর্নীতি টঙ্গী, গাজীপুর, নরসিংদী, ফতুল্লা, জিনজিরা, সোনারগাঁও এলাকায় সবচেয়ে বেশি।  
 
লেখক : শুভাশিস ব্যানার্জি শুভ, সাংবাদিক ও কলামিস্ট।।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী - dainik shiksha প্রাথমিকে ১০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ জুনের মধ্যে: প্রতিমন্ত্রী পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের - dainik shiksha পূর্ণাঙ্গ উৎসব ভাতা দাবি মাধ্যমিকের শিক্ষকদের ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার - dainik shiksha ঝরে পড়াদের ক্লাসে ফেরাতে কাজ করছে সরকার প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার - dainik shiksha প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় জালিয়াতি, ভাইবোন গ্রেফতার ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি - dainik shiksha ভিকারুননিসায় ৩৬ ছাত্রী ভর্তিতে অভিনব জালিয়াতি শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় - dainik shiksha শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অসদুপায় অবলম্বন প্রায় শূন্যের কোটায় ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে - dainik shiksha ‘চার আনা’ উৎসব ভাতা: প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষামন্ত্রী সমীপে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059800148010254