এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি যেনো অমাবস্যার চাঁদ। নানা জটিলতায় আটকা পড়ে তাদের স্বপ্নভঙ্গের ইতিহাস নতুন কিছু নয়। সাম্প্রতিক সময়ে পদোন্নতিতে কিছুটা সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। তবে নতুন আরেক কষ্টের সূচনা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে। একই গ্রেডে, একই সুযোগ সুবিধা নিয়ে কারো পদবি সহকারী অধ্যাপক আর কারো পদবি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় সরকারি ও বেসরকারি দুটি ধারা বিদ্যমান। তবে বেসরকারি ধারাটি ৯৭ শতাংশ হওয়া সত্ত্বেও তাদের সুযোগ সুবিধা অনেক কম।
এমপিওভুক্ত কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি দীর্ঘকাল যাবৎ অনুপাত প্রথার জালে আটকা পড়েছিলো। এমনই এক প্রথা ছিলো যে প্রথার কারণে বেশিরভাগ শিক্ষককেই সমগ্র চাকরি জীবনে প্রভাষক হিসেবে থাকতে হয়েছে এবং প্রভাষক হিসেবেই অবসরগ্রহণ করতে হয়েছে। অজগর সাপের প্যাঁচের মত এই অনুপাত প্রথা থেকে শিক্ষকরা মুক্তি পেলেও আরেক ধরণের সংকট তৈরি হয়েছে। সর্বশেষ এমপিও নীতিমালা ২০২১ (২৮ মার্চ প্রকাশিত) অনুযায়ী অনুপাত প্রথা তুলে দিয়ে এমপিওভুক্ত মোট প্রভাষকের ৫০ শতাংশকে পদোন্নতি দেয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। এ পদোন্নতিকে আবার দুটি পর্যায়ে নামকরণ করা হয়েছে। উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে প্রভাষক থেকে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক এবং ডিগ্রি কলেজে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক। পদোন্নতির নামকরণ কিছুটা হাসির খোরাক জোগায় এবং একইসঙ্গে মনোঃকষ্টেরও একটি বড় কারণ বটে। একই সুযোগ সুবিধা থাকবে অর্থাৎ ৬ষ্ঠ গ্রেডে উভয়ই বেতন ও অন্যান্য সুবিধা পাবে শুধু নামের বেলায় একজন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক আর অন্যজন সহকারী অধ্যাপক। সরকারি কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের পদোন্নতিতে জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের পদটি নেই। প্রভাষক, সহাকারী অধ্যাপক, সহযোগী অধ্যাপক, অধ্যাপক এভাবে পদোন্নতির ক্রম সাজানো। সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে যারা চাকরি করেন তাদের কি সিনিয়র লেকচারার পদবি দেয়া হয়? সমান সুযোগ, বেতন, ইনক্রিমেন্ট, উৎসব ভাতা, বাড়ি ভাড়া, অথচ নামকরণ হবে সিনিয়র লেকচারার ও সহকারী অধ্যাপক। পদবি একজন ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও সামাজিক মর্যাদার নির্ণায়ক হিসেবে কাজ করে। তাছাড়া উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে জ্যেষ্ঠ প্রভাষক দেয়াতে তারা উপাধ্যক্ষ ও অধ্যক্ষ হওয়ার সুযোগও হারিয়েছেন। ৪০ বছর ধরে চলে আসা বিধি সংশোধন করা হলো। কিন্তু সেই সংশোধন কেনো পুনরায় শিক্ষকদের মনোঃকষ্টের কারণ হলো? গ্রেড ৬ এ চাকরি করে কেনো একজন সহকারী অধ্যাপক এবং আরেকজন জ্যেষ্ঠ প্রভাষক? কি উদ্দেশ্যে এই নামকরণের ? যেসব বিজ্ঞজনরা এটি করেছেন তারা কি শিক্ষকদের মনোঃকষ্টের আওয়াজটি শুনতে পেয়েছেন? জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের বদলে সহকারী অধ্যাপক লিখলে কি ক্ষতি হতো? দুটোরই গ্রেড, মর্যাদা এবং সুযোগ সুবিধাতো সমান। যদি গ্রেড ভিন্ন হতো সেটা মেনে নেয়া যেতো। সরকারি-বেসরকারি এই বৈষম্যে শিক্ষার যে অপূরণীয় ক্ষতি হচ্ছে সেদিকে আমাদের নজর কতটুকু? বেসরকারি কলেজের শিক্ষকদের সারা জীবনে একটিই পদোন্নতি আর সেটা হলো সহকারী অধ্যাপক। কিন্তু এটাকেও কেন কাটাছেঁড়া করা হলো? বাংলাদেশের এমন বহু উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ আছে যাদের শিক্ষার মান, অবস্থান, অবকাঠামো, শিক্ষকদের যোগ্যতা অনেক সমৃদ্ধ। তাহলে তাদেরকে কেন নামে খাটো করে রাখা হলো? প্রভাষকের তকমা থেকে কেনো তারা বের হতে পারলো না? জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদ সৃষ্টি করা মানেই প্রভাষকের তকমা থেকেই গেলো। ২৫ বছর চাকরি করার পর জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পরিচয় দেয়াটাও কি স্বস্তির? মোটেও না। কাউকে গ্রেড বুঝানো যায় না। পদবি জানতে চায় মানুষ। ২৫ বছর চাকরি করে প্রভাষক বলাটা অবশ্যই সংকোচবোধ হয়। তাই কর্তৃপক্ষের প্রতি সবিনয় আহবান পদবির নামকরণে সমতা নিয়ে আসুন। এতে আপনাদের কোন ক্ষতি হবে না বরঞ্চ আপনাদের মর্যাদা আরো বাড়বে। একই গ্রেড এবং একই সুবিধা দিচ্ছেন অথচ পদবিতে বৈষম্য কেনো রাখবেন? নামকরণের সৌন্দর্য বলেওতো একটি বিষয় আছে। গ্রেড যখন ৬ দিচ্ছেন তখন সহকারী অধ্যাপক নামটি দিতে অসুবিধা কোথায়? ৪০ বছর ধরেতো সেটাই ছিলো। আপনারা হয়তো বলবেন ডিগ্রি কলেজে সহকারী অধ্যাপক দেয়া হচ্ছে। যদি তাই হয় তবে ডিগ্রি আর উচ্চ মাধ্যমিক শিক্ষক নিয়োগে কেন সমান যোগ্যতা চাওয়া হয়? নিয়োগে যদি সমতার বিষয়টি এত গুরুত্বপূর্ণ হয় তবে পদবির ক্ষেত্রে কেনো তারা গুরুত্বহীন হয়ে পড়লো? এনটিআরসিএ থেকে যখন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে তখনতো ডিগ্রি আর উচ্চমাধ্যমিক পৃথক করে বিবেচনা করা হচ্ছে না। তাহলে পদোন্নতিতে এসে নামকরণে কেন এই বিড়ম্বনা? খুবই সামান্য একটি বিষয় কিন্তু যিনি ভূক্তভোগী তার কাছে এটি পাহাড়সম অস্বস্তির কারণ। মনোঃকষ্ট নিয়ে কি কখনো ভাল বা মানসম্মত শিক্ষা দেয়া সম্ভব? তাই অনভিপ্রেত এই বৈষম্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দূর করে পদবির নামকরণে সমতা ( সহকারী অধ্যাপক) বাস্তবায়ন করা হোক।
অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলোতে ডিগ্রি এবং অনার্স খোলার সুযোগ নেই। তবে তারা কি পদবি বঞ্চিত হবে ? কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির যে প্রতিষ্ঠিত নীতিমালা ৪০ বছর যাবত অব্যাহত ছিলো সেটাই বহাল রাখা উচিত। সিনিয়র লেকচারারের পদটি বিলুপ্ত করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপকের বিধানটি পুনর্বহাল করা হোক। এ ধরণের পদবি বৈষম্য শিক্ষকতা পেশার প্রতি এক ধরণের অবিচার যা শিক্ষকদের মানসিকভাবে দুর্বল করে ফেলবে। প্রতিবেশী দেশ ভারতে যখন শিক্ষাকত পেশার মর্যাদা বৃদ্ধি করা হচ্ছে সেখানে আমরা কেন পিছিয়ে যাচ্ছি। পলিসি মেকারদের উদারতায় এত ঘাটতি কেনো?
যাহোক উচ্চ মাধ্যমিক কলেজ ও ডিগ্রি কলেজে প্রভাষকদের ৬ গ্রেড প্রাপ্তিকে তুচ্ছ করে দেখার সুযোগ নেই। নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো। নীতিমালা করা হয়েছে বেশ কয়েক মাস আগে। সেখানে বলা হয়েছে একটি কমিটি গঠনের মাধ্যমে প্রভাষকদের পদোন্নতি নীতিমালা বাস্তবায়ন করা হবে। । ইতোমধ্যে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়াটি চূড়ান্ত পর্যায়ে। নীতিমালার ১১.৪ ধারায় বলা হয়েছে ৮ বছর চাকরির সন্তোষজনক পূর্তিতে মোট প্রভাষকের ৫০ শতাংশ পদোন্নতি পাবেন অর্থাৎ কোনো একটি উচ্চ মাধ্যমিক কলেজে যদি ১২ জন এমপিওভুক্ত প্রভাষক থাকেন তবে নতুন নীতিমালা অনুযায়ী ৬ জন পদোন্নতি পাবেন। ডিগ্রি কলেজেও ঠিক একই নিয়ম। শুধু জ্যেষ্ঠ প্রভাষকের স্থলে সহকারী অধ্যাপক প্রাপ্য হবেন। নীতিমালায় আরো বলা হয়েছে যে অন্যান্য প্রভাষকরা ১০ বছর চাকরির সন্তোষজনক পূর্তিতে নবম গ্রেড থেকে অষ্টম গ্রেডে উন্নীত হবেন এবং পরবর্তী ৬ বছর চাকরি পূর্তিতে অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে ১৬ বছর চাকরি সম্পন্ন হলে ৬ গ্রেড প্রাপ্য হবেন। তার মানে কোনো প্রভাষক যদি ১৬ বছর একটানা চাকরি করে থাকেন তবে তার গ্রেড ৬ পেতে কোন বাধা নেই। সে হিসেবে যাদের চাকরি ১৬ বছর পূর্ণ হয়েছে এমপিওভুক্ত হিসেবে তাদের সবাই এ সুযোগটি পাবেন। ১১.৪ ধারায় বলা হয়েছে পদোন্নতির বিষয়টি চাকরির নির্দিষ্ট মেয়াদ পূর্ণ করা ছাড়াও আরো কিছু শর্তের ওপর নির্ভর করবে। এক্ষেত্রে ১০০ নম্বরের একটি মূল্যায়ন পর্ব রাখা হয়েছে। চাকরির বয়স, দক্ষতা, সৃজনশীল কাজ, গবেষণা, কোনো মামলা না থাকা, একাডেমিক রেজাল্ট, ক্লাসে উপস্থিতিসহ আরো কিছু শর্ত। সবই ঠিক আছে। শিক্ষকরাও চান তারা তাদের যোগ্যতার মাধ্যমে পদোন্নতি পাক। ১০০ নম্বরের এই মূল্যায়নের কাজটি করবে একটি কমিটি। কিন্তু আমাদের উদ্বেগের জায়গাটি হলো যোগ্যতা নির্ধারণ সূচকের অপব্যবহার নিয়ে। সূচকের যে মানদণ্ডগুলো দেয়া হয়েছে সেটার অপব্যবহার করে জুনিয়রকে বাইপাস করে সিনিয়র বানানো সম্ভব।
বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতি সমগ্র চাকরি জীবনে একবার। সেক্ষেত্রে সিনিয়রিটি বজায় অত্যাবশ্যক। সূচকের যে কয়টি ক্যাটাগরিতে নম্বর রাখা হয়েছে তা খুব একটা যৌক্তিক মনে হয়নি। কেননা কোনো শিক্ষক অনেক সিনিয়র হওয়া সত্বেও যদি গর্ভনিংবডির সুনজরে না থাকতে পারে তবে তিনি সিনিয়রিটি নির্ধারণের যোগ্যতায় পিছিয়ে পড়বেন। সিনিয়র হয়েও তিনি পদোন্নতি থেকে ছিটকে পড়বেন এবং তার জুনিয়ররা পদোন্নতি পেয়ে যাবেন। আর এমনটি হলে সেটা হবে একটি বুমেরাং। চরম অস্বস্তি বিরাজ করবে শিক্ষকদের মধ্যে। তাই বেসরকারি কলেজ শিক্ষকদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে সিনিয়রিটিকেই মূখ্য ধরতে হবে। আমি সিনিয়রিটি বলতে সূচকের নম্বরের ভিত্তিতে সিনিয়রিটিকে বুঝাচ্ছি না। যিনি যোগদানে এবং এমপিওভুক্তির তারিখ থেকে এগিয়ে থাকবেন তাকেই সিনিয়র বলতে হবে। কোনমতেই সূচকের নম্বরের ভিত্তিতে সিনিয়র বানানো ঠিক হবে না। যিনি আগে যোগদান করবেন তিনি আগে পদোন্নতি পাবেন এমন বিধান রেখে অন্যান্য যোগ্যতা নির্ধারণ করা যেতে পারে।
অনুপাত প্রথার জাল থেকে মুক্ত হয়ে শিক্ষকরা একটি নতুন স্বপ্নজাল বুনতে শুরু করেছে মাত্র কিন্তু সেটাও যদি কালক্ষেপণের ফাঁদে পড়ে যায় তবে আর এত কিছুর আয়োজন করে কি লাভ! শিক্ষকরা নীতিমালার আলোকে নিয়ম অনুযায়ী পদোন্নতি নিতে চায়। কিন্তু তা পেতে যেনো তাদের আর নতুন করে গলদঘর্ম হতে না হয় সেদিকে সংশ্লিষ্টদেরকে সুনজর রাখতে হবে। পদোন্নতিটি যেন মরিচীকা না হয় প্রভাষকদের জন্য, সেটা যেন নিয়মের মধ্য থেকে সহজে তারা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। সমগ্র চাকরি জীবনে একটি মাত্র পদোন্নতি। আর সেটা পেতেও যদি পরতে পরতে ধাক্কা খেতে হয় তবে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আসার আগ্রহ হারাবে। যতটুকু প্রাপ্তি আছে ততটুকু যেন প্রভাষকরা সুন্দরভাবে পায় সেটা কর্তৃপক্ষকে নিশ্চিত করতে হবে। শিক্ষকরা এমনিতেই নানা সমস্যায় জর্জরিত, তার ওপর পদোন্নতি নিয়ে যদি তাদের দুশ্চিন্তা করতে হয় তবে সেটা হবে মরার ওপর খাঁড়ার ঘা। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে পদোন্নতি কোনো করুণা নয় এটা চাকুরিজীবিদের অধিকার।
বাংলাদেশ তার সুবর্ণজয়ন্তী পার করেছে। একই সঙ্গে মুজিব শতবর্ষ বাঙালিরা গর্বের সঙ্গে উদযাপন করেছে। স্বাধীনতার এই সুবর্ণজয়ন্তীতে শিক্ষকরা যেনো তাদের প্রাপ্যটুকু পান সেটাই সবার কাম্য। বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের এক রোল মোডেল। সব ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এত কিছুর পরও শিক্ষকদের বিভিন্ন দাবি আদায়ে প্রায় সারা বছরই প্রেসক্লাবে দেখা যায়। শিক্ষকরা তাদের প্রাপ্যটুকু বুঝে পেলে প্রেসক্লাব নয় তারা শ্রেণিকক্ষেই নিজেদেরকে নিয়োজিত রাখবেন। জাতি গড়ার এই সব কারিগরদের নায্য প্রাপ্যটুকু যেন যথাসময়ে নিশ্চিত করা হয় সেটাই হোক আমাদের ব্রত।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক