ঘুষকাণ্ডে শিক্ষাখাতে ছি-ছিক্কার, অভিযুক্ত সাংবাদিকরা গ্রেপ্তার আতঙ্কে!

এনামুল হক প্রিন্স, দৈনিক শিক্ষাডটকম |

কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতি ও অবৈধ বাণিজ্যের ঘটনায় ঘুষকাণ্ডে অভিযুক্ত সাংবাদিকদের নামে ছি-ছিক্কার চলছে শিক্ষা পরিমণ্ডলে। এসব সাংবাদিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও তার অধিনস্ত অধিদপ্তরসহ শিক্ষাসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন অফিসগুলোতে নিয়মিত তদবির ও তোলাবাজি করতেন বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। জানা গেছে, তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে তদবিরে সহায়তাকারী কর্মকর্তারাও এখন নিজেদের বাঁচাতে অভিযুক্তদের নামে দুয়ো দিচ্ছেন। শিক্ষার অপর কয়েকটি দপ্তরেও তারা তোলাবাজি করতেন মর্মে নানা তথ্য-প্রমাণ সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছেছে। 

শরীফুল আলম সুমন (বামে), সাব্বির নেওয়াজ (মাঝে), নিজামুল হক (ডানে)

এদিকে অভিযুক্তরা গ্রেফতার আতঙ্কে ভুগছেন বলে জানিয়েছেন তার একাধিক ঘনিষ্ট ব্যক্তি। তাই যথাসম্ভব ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা সরানো, আলামত নষ্ট, ৪৬ কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউর পঞ্চম তলার নিবন্ধিত অফিসের আলামত সরানোর কাজে ব্যস্ত সময় পার করছেন। ডিবি প্রধান হারুন অর রশিদ অভিযুক্ত সাংবাদিকদের কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানের মুখোমুখি হওয়ার আহ্বান জানানোর পর থেকে অভিযুক্তদের আতঙ্ক আরো বেড়েছে বলে জানিয়েছেন তাদের একাধিক ঘনিষ্ঠ সাংবাদিক। গত শনিবার সংবাদ সম্মেলনে ওই আহ্বান জানান ডিবি প্রধান। কিন্তু, তারপর চার দিন পেরিয়ে গেলেও অভিযুক্ত কোনো সাংবাদিক সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামসুজ্জামানের মুখোমুখি হওয়ার সাহস করেননি।

বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিক মহলেও চলছে নানা কানাঘুষা। অধিকাংশ সাংবাদিক এমন কাণ্ডে লজ্জিত। তারা অভিযুক্তদের উপযুক্ত শাস্তির মাধ্যমে ঢালাওভাবে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ থেকে মুক্তি চান। ডিবি প্রধান নিশ্চিত করেছেন যে, সুনির্দিষ্ট অভিযোগ গুটিকয় সাংবাদিকের বিরুদ্ধে।   

ওদিকে দ্বিতীয় দফার রিমান্ডে শামসুজ্জামান গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, কোন সাংবাদিককে কখন কোথায় কীভাবে তার কছ থেকে টাকা দিয়েছেন, কোন সাংবাদিকরা সার্টিফিকেট ও মার্কশিট বিক্রিতে জড়িত ছিলেন তিনি সব ডিজিটালি দেখিয়ে দেবেন।

এর আগে আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবাবনবন্দি দিয়ে নিজের দোষ স্বীকার করেন শামসুজ্জামান।

প্রসঙ্গত, জাল সার্টিফিকেট প্রিন্ট ও বিক্রির অভিযোগে গত ৩১ মার্চ রাতে বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট প্রকৌশলী এ কে এম শামসুজ্জামানকে আটক করে গোয়েন্দা পুলিশ।

তাকে গ্রেফতারের পর মহানগর পুলিশ জানায়, বিপুল সংখ্যক অবৈধ সার্টিফিকেট ও মার্কশিটসহ শামসুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। রাজধানীর পীরেরবাগে তার বাসায় অবৈধ সার্টিফিকেট ও মার্কশিট তৈরির কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে।

পরদিন ১ এপ্রিল বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানের সই করা অফিস আদেশে শামসুজ্জামানকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়। তারপর অবৈধ সনদ বিক্রির সঙ্গে আর কেউ জড়িত কিনা তার তদন্ত শুরু হয়। সনদ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মো. আলী আকবর খানকে পদ থেকে সরিয়ে দেয়া হয়। সনদ বাণিজ্যের প্রমাণ পেয়ে তার স্ত্রী সেহেলা পারভীনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। এর কিছু দিন পর সংবাদমাধ্যমে শামসুজ্জামানকে জিজ্ঞাসাবাদের একটি ভিডিয়ো ভাইরাল হয়। মেধাবী ও গুরুত্বপূর্ণ পুলিশ কর্মকর্তার লাগাতার জেরার মুখে অবৈধ সনদ বাণিজ্যের খবর চাপা দিতে ঘুষ নেয়া সাংবাদিকদের নাম প্রকাশ করেন শামসুজ্জামান। 

তিনি বলেন, খবর প্রকাশের হুমকি দিয়ে দৈনিক কালের কণ্ঠের শিক্ষা রিপোর্টার শরীফুল আলম সুমন নিয়েছেন ৮ লাখ টাকা। দৈনিক ইত্তেফাকের শিক্ষা সাংবাদিক নিজামুল হক নিয়েছেন ৬ লাখ। দৈনিক সমকালের শিক্ষা সাংবাদিক সাব্বির নেওয়াজ নিয়েছেন ৫ লাখ টাকা ঘুষ।

এ ছাড়া বেসরকারি স্যাটেলাইট চ্যানেল মাছরাঙ্গার মাহমুদ সোহেল সাড়ে ৪ লাখ, এশিয়ান টিভির জাকির হোসেন পাটোয়ারি ২ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন। অন্যান্য সাংবাদিকদের মধ্যে হাসমত বিভিন্ন সময়ে মোট ২ লাখ টাকা নিয়েছেন, রুবেল নামে আর এক সাংবাদিক বিভিন্ন সময়ে বিজ্ঞাপন দেয়ার কথা বলেও টাকা নিয়েছেন বলে স্বীকার করেছেন কারিগরি বোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট।

এ ছাড়াও আবু জাফর সূর্য নামে এক সাংবাদিক নেতা ১০ লাখ টাকা ঘুষ নিয়েছেন দাবি করে জিজ্ঞাসাবাদে শামসুজ্জামান আরো বলেন, এসব সাংবাদিক রিপোর্ট করে দেয়ার ভয় দেখিয়ে আমার কাছ থেকে টাকা আদায় করতেন তিনি। তাদের টাকা দেয়ার পর রিপোর্ট হতো না। তারা অন্য সাংবাদিকদেরও ম্যানেজ করতেন।

শামসুজ্জামানের স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে রাজধানীতে কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের জাল সনদ ও মার্কসশীট তৈরির কারখানার সন্ধান পায় গোয়েন্দা পুলিশ।   

অভিযুক্ত শিক্ষা সাংবাদিকদের দায় নেবে না ইরাব 

 সনদ বাণিজ্যের খবর চাপা দিতে কারিগারি শিক্ষাবোর্ডের সিস্টেম এনালিস্টের কাছ থেকে ঘুষ নেয়ার অভিযোগ ওঠা সংবাদ কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষা সাংবাদিকদের মূল সংগঠন এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইরাব এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে বিষয়টি স্পষ্ট করেছে ইরাব।  ইরাব সভাপতি অভিজিৎ ভট্টাচার্য দৈনিক ভোরের কাগজের সিনিয়র রিপোর্টার এবং সাধারণ সম্পাদক আক্তারুজ্জামান বাংলাদেশ প্রতিদিনের স্টাফ রিপোর্টার।  

সংগঠনটির সাধারণ সম্পাদক আখতারুজ্জামান সাক্ষরিত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের সনদ জালিয়াতি ও ঘুষ লেনদেনের সংবাদ ও ভিডিও প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। এ ঘটনায় সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে কতিপয় সাংবাদিকদের বিরুদ্ধেও অভিযোগ উঠেছে। মূল অভিযুক্ত কারিগরি শিক্ষাবোর্ডের সিস্টেম এনালিস্ট একেএম শামছুজ্জামান গোয়েন্দা পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছেন, এসব সাংবাদিক খবর চাপা দেয়ার কথা বলে তাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। 

বিবৃতিতে আরো বলা হয়, এই ঘূষকাণ্ডে অভিযুক্ত শিক্ষা বিটের তিন সাংবাদিকের পক্ষে এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন, বাংলাদেশ (ইরাব) নামে একটি সংগঠন বিবৃতি দিয়েছে।  অভিযুক্তদের পক্ষে বিবৃতি দানকারী সংগঠনটির দাবি, ওই তিন সাংবাদিক তাদের সংগঠনের সাবেক ও বর্তমান সভাপতি। কিন্তু, ওই সংগঠনটির নাম শিক্ষা সাংবাদিকদের মূল সংগঠনের কাছাকাছি হওয়ায় জনমনে বিভ্রান্তি তৈরি হতে পারে। কিন্তু, ঘুষ নেয়া সাংবাদ কর্মীদের সঙ্গে শিক্ষা সাংবাদিকদের মূল সংগঠন এডুকেশন রিপোর্টার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ইরাব এর কোনো সম্পৃক্ততা নেই। ওই তিন অভিযুক্তের কোনো দায়-দায়িত্ব মূল সংগঠন ইরাব নেবে না।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে - dainik shiksha ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য - dainik shiksha ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত - dainik shiksha উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস - dainik shiksha যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি - dainik shiksha এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক - dainik shiksha মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক - dainik shiksha ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0053188800811768