সার্টিফিকেট বিক্রিসহ বিভিন্ন অপরাধে বন্ধ করে দেওয়া বেসরকারি দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সনদে বহু শিক্ষক এমপিওভুক্ত হয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ পেয়েও এমপিওভুক্তিতে ব্যর্থরা। মাঠ পর্যায়ে জেলা-উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক পরিচালক-উপপরিচালকরা মোটা অংকের টাকা নিয়ে তাদের এমপিওভুক্ত করেছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তারা। আদালতের নির্দেশে বন্ধ ঘোষিত প্রতিষ্ঠানটির সনদে এমপিওভুক্তি ‘গ্রহণযোগ্য’ করার দাবিতে আন্দোলনরতদের একজন সেই সনদেই ‘ঘুষ দিয়ে’ একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে এমপিওভুক্ত হয়েছেন মর্মেও অভিযোগ তুলেছেন তারা। সে সংক্রান্ত তথ্য প্রমাণও সরবরাহ করেছেন দেশের শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র জাতীয় প্রিন্ট পত্রিকা দৈনিক আমাদের বার্তা ও শিক্ষা বিষয়ক একমাত্র পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল পত্রিকা দৈনিক শিক্ষাডটকমকে।
গত সোমবার রাতে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকমের অফিসে এসে এসব অভিযোগ জানান দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরো কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সনদে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে নিয়োগপ্রাপ্তরা। এর আগে এদিন সকালে তাদের কয়েকজন ওইসব কথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে এমপিওভুক্তির আবদার জানিয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবে মানববন্ধন করেছেন বলেও দাবি করেছেন।
তারা জানান, দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রহণযোগ্য সনদে এমপিওভুক্ত হয়েছেন মোহাম্মদ ছিয়ামুল হক। এর আগে এমপিওভুক্তিতে ওইসব কথিত বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের গ্রহণযোগ্যতার আবদার জানিয়ে নানা সময় মানববন্ধন করেছেন তিনি। তবে প্রায় এক বছর আগে তিনি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার ও তথ্য বিজ্ঞান বিষয়ের সহকারী শিক্ষক পদে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। সংশ্লিষ্ট উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা-জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও আঞ্চলিক উপপরিচালককে ঘুষ দিয়ে তিনি অগ্রহণযোগ্য সনদ দিয়েই এমপিওভুক্ত হয়েছেন।
তাদের অভিযোগ, এর আগে মানিকগঞ্জের শিবালয় উপজেলার সাঁকরাইল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক ফারহানা আক্তার, টাঙ্গাইলের নাগরপুর উপজেলার আলহাজ্ব রমজান আলী হাই স্কুলের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. মজিবুর রহমান, রাজধানীর গুলশানের মদিনাতুল উলুম মডেল ইনস্টিটিউশন বালক কামিল মাদরাসার প্রভাষক মনোয়ার খোকন, মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখান উপজেলার মালাপৈয়া গার্লস হাই স্কুলের সহকারী গ্রন্থাগারিক মোহাম্মদ রেজাউল করিম, পটুয়াখালীর বাউফল উপজেলায় নওমালা মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কে এম নাসির উদ্দিন, সিলেটের কোতোয়ালি থানার রাজা জি সি হাই স্কুলের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আবদুল মুহিত, পঞ্চগড়ের দেবীগঞ্জে উপজেলার পামুলি বাইলেটারেল উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. বজলুর রশিদ, দিনাজপুরের বীরগঞ্জ উপজেলার সাহাবগঞ্জ আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক মো. সাফাতুল ইসলাম, নওগাঁর আত্রাই উপজেলার খানজৈড় জয়সাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক নাজমা আক্তার বানু, সাতক্ষীরার তালা উপজেলার দলুয় উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগরিক মাসুদুর জামান সরদার, সাতক্ষীরা সদর উপজেলার জি জি কে এইচ কে উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আশোক কুমার রায়, নারয়ণগঞ্জের সোনারগাঁ উপজেলার বৈদ্যের বাজার এন এ এম পাইলট হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষক মো. কামাল হোসেনসহ বহুজন দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অগ্রহণযোগ্য’ সনদে এমপিওভুক্ত হয়েছেন বলেও অভিযোগ তাদের। এছাড়া জাল সনদে টাকার বিনিময়ে টাঙ্গাইলের ঘাটাইলের ধলাপাড়া ছমির উদ্দিন পাবলিক উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারী গ্রন্থাগারিক আমেনা বেগমকে এমপিওভুক্ত করেছেন শিক্ষা কর্মকর্তারা।
দৈনিক শিক্ষাডটকম ও দৈনিক আমাদের বার্তার আর্কাইভে থাকা ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১১ জুন জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে তোলো একটি ছবিতে দেখা গেছে, মোহাম্মদ ছিয়ামুল হক কথিত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে এমপিওভুক্তি আবদার জানিয়ে মানববন্ধন করছেন।
দারুলের সনদে এমপিওভুক্তি বিষয়ে জানতে গত সোমবার রাতে মোহাম্মদ ছিয়ামুল হকের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয় দৈনিক আমাদের বার্তা ও দৈনিক শিক্ষাডটকমের পক্ষ থেকে। তিনি এমপিওভুক্ত হওয়ার বিষয়টি অকপটে স্বীকার করেন। তবে তিনি দাবি করেন দারুলের সনদে নয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদে তিনি এমপিওভুক্ত হয়েছেন। তবে কোন বছর তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই সনদটি অর্জন করেছেন সে বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো মন্তব্য করতে পারেননি। তিনি বলেন, মনে হয় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে পরীক্ষা হয়েছিলো (করোনার বছর)।
তবে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ ছিয়ামুল হক ওই স্কুলে নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে জানা গেছে। নিয়োগের পরে অর্জন করা সনদ এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য হবে কি-না জানতে চাইলে তিনি সুস্পষ্ট কোনো জবাব দেননি। তিনি বলেন, পরে সনদ অর্জন করে এমপিওভুক্ত হয়েছি, এতো দোষের কিছু নেই। এমপিওভুক্ত হতে কাকে কতো টাকা ঘুষ দেয়া হয়েছে তা জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করেননি তিনি।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে বক্সনগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শফি উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি সহকারী গ্রন্থাগারিক পদে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে মোহাম্মদ ছিয়ামুল হক নিয়োগ পেয়েছিলেন বলে নিশ্চিত করেছেন। তার এমপিওভুক্তি বিষয়ে প্রধান শিক্ষক বলেন, তিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধীনস্ত কলেজ থেকে পরে আবার ডিপ্লোমা সনদ নিয়ে এমপিওভুক্ত হয়েছেন। এক সনদে নিয়োগ নিয়ে পরে আরেকটি সনদে এমপিওভুক্ত হওয়া বা তার আবেদন অগ্রায়ণ করা যাবে কি-না জানতে চাইলে প্রধান শিক্ষক কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। তিনি বলেছেন, সেসময় কারা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ সংশ্লিষ্ট দায়িত্বে ছিলেন সে সংক্রান্ত তথ্য আমি মঙ্গলবার আপনাকে দেবো।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এমপিও বিশেষজ্ঞ ও মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষার ঢাকা অঞ্চলের সাবেক উপপরিচালক ড. সাধন কুমার বিশ্বাস দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, জাল ও ভুয়া সনদে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া সহকারী গ্রন্থাগারিকদের শর্ত সাপেক্ষে তিন বছর পর্যন্ত সনদ অর্জনের সুযোগ দিয়েছিলো সরকার। ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর জারি করা ওই পরিপত্রে বলা ছিলো, ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত নিয়োগ পাওয়া সহকারী গ্রন্থাগারিকদের জন্য শুধু ওই সুপারিশ কার্যকর থাকবে। পরে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ২২ নভেম্বর জারি করা অপর এক আদেশে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের বদলে ওইসময় দশ মাস ২২ দিন বাড়িয়ে ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের ২২ অক্টোবর করা হয়। অর্থাৎ ২০১৩ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসের পর কোনো দারুল/সিট ফাউন্ডেশনসহ কয়েকটি ভুইঁফোড় প্রতিষ্ঠানের সনদে সহকারী গ্রন্থাগারিক নিয়োগ পেলে তার জন্য পরে সনদ অর্জনের বিধান প্রযোজ্য হবে না।
ঘুষ নিয়ে এমপিওভুক্ত করার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকার জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আব্দুল মজিদ দৈনিক আমাদের বার্তাকে বলেন, তিনি যদি ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে এমপিওভুক্ত হয়ে থাকেন তাহলে পরে সনদ অর্জন করলেও তা গ্রহণযোগ্য হওয়ার কথা নয়। অভিযোগ খতিয়ে দেখবেন এবং সত্যতা পেলে অভিযুক্ত গ্রন্থাগার শিক্ষকের এমপিও বাতিল বা ইনডেস্ক ডিলেটের ব্যবস্থা করবেন বলে জানান।
সার্টিফিকেট বিক্রিসহ বিভিন্ন অভিযোগে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম বন্ধ করে হাইকোর্ট। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল হলে রায় বহাল রেখে রায় দেয় আপিল বিভাগ। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ১০ জুলাই শিক্ষা মন্ত্রণালয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের কাছে দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদের বৈধতার বিষয়ে জানতে চায়। ২৫ জুলাই ইউজিসির কর্মকর্তারা মতামত দিয়ে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠান। তাতে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগ হাইকোর্টের ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ১৩ এপ্রিলের রায় বহাল রেখে ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দের ৮ ফেব্রুয়ারি একটি রায় দিয়েছেন। তাতে পর্যবেক্ষণে বলেছেন, আইনের দৃষ্টিতে দারুল ইহসান কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায়ে পড়ে না।
দৈনিক শিক্ষাডটকমের ইউটিউব চ্যানেল SUBSCRIBE করতে ক্লিক করুন।