দৈনিক শিক্ষাডটকম ডেস্ক: ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে উপকূলীয় এলাকাসহ সারা দেশে অন্তত ২১ জনের প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। মঙ্গলবার (২৮ মে) সকাল পর্যন্ত ঢাকাসহ ১০ জেলায় এ প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছে।
এছাড়া ঝড়ে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বহু এলাকা। ভেঙে পড়েছে কাঁচা ঘরবাড়ি, দেয়াল ও গাছপালা। এছাড়া বিভিন্ন জায়গায় বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে জোয়ারের পানি।
রিমালের তাণ্ডবে কোন জেলায় কতজনের মৃত্যু
পটুয়াখালীতে ৩, চট্টগ্রামে ২, ঢাকায় ৪, ভোলায় ৩, বরিশালে ৩, খুলনা, সাতক্ষীরা, লালমনিরহাট, বরগুনা, কুষ্টিয়া ও কুমিল্লায় একজন করে মোট ২১ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে।
পটুয়াখালী
ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে পটুয়াখালীতে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার (২৬ মে) দুপুরের পর কলাপাড়ায় ফুফু ও বোনকে নিরাপদ স্থানে আনতে যাওয়ার পথে জোয়ারের পানিতে ভেসে গিয়ে মো. শরীফ (২৭) নামের এক যুবকের মৃত্যু হয়। ধূলাসর ইউনিয়নের কাউয়ার চর এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। মৃত শরীফ অনন্তপাড়া এলাকার আবদুর রহিমের ছেলে।
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, শরীফের ফুপু মাতোয়ারা বেগম কাউয়ারচর এলাকায় বসবাস করেন। ওই বাড়িতে তার বোনও ছিল। দুপুর ২টার দিকে অনন্তপাড়া থেকে শরীফ তার বড় ভাই ও ফুফাকে নিয়ে বোন ও ফুফুকে আনতে যায়। নৌকা না থাকায় সাঁতার কেটে তারা ফুফুর ঘরে যাওয়ার সময় ঢেউয়ের তীব্র স্রোতে শরীফ হারিয়ে যান। পরে ঘণ্টাখানেক পর শরীফের মরদেহ উদ্ধার করেন স্থানীয়রা।
এছাড়া দুমকি উপজেলায় ঝড়ো হাওয়ায় গাছচাপায় জয়নাল হাওলাদার নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। তিনি উপজেলার পাঙ্গাশিয়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড নলদোয়ানি স্লুইসগেট এলাকার বাসিন্দা।
বাউফলে ঝোড়ো হাওয়ায় একটি পরিত্যক্ত টিনশেড দোতালা ঘরের নিচে চাপা পড়ে আব্দুল করিম (৬৫) নামে এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাতে ঝড়ের সময় বৃদ্ধ করিম পরিত্যক্ত ওই ঘরে আশ্রয় নেন এবং রাতের যে কোনো সময় ঝোড়ো হাওয়ায় ঘর ভেঙে এ ঘটনা ঘটে। বাউফল থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) শোণিত কুমার গায়েন নিশ্চিত করেছেন।
চট্টগ্রাম
চট্টগ্রাম নগরীতে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। নগরীর বায়েজিদ এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের দেয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম হৃদয় (২৬) নামের এক যুবক মারা গেছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বায়েজিদের চন্দ্রনগর কলাবাগান এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। তিনি নির্মাণাধীন ভবনের পাশ দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় ধসে পড়া দেয়ালে চাপা পড়েন। পরে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের সিনিয়র স্টেশন অফিসার মো. কামরুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
এ ছাড়া নগরের কোতোয়ালি থানা এলাকায় খালের পানিতে ডুবে অজ্ঞাতনামা এক যুবক মারা গেছেন। একইদিন দুপুরে থানার আছাদগঞ্জ শুটকিপট্টি চাক্তাই খালে এ ঘটনা ঘটে।
ঢাকা
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে দেশের অন্যান্য জেলার মতো রাজধানী ঢাকাতেও ভারী বৃষ্টিপাত হয়েছে। আর এই বৃষ্টির মধ্যেই টিনের বেড়া, বৈদ্যুতিক খুঁটিতে স্পর্শ, বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চার্জ দিতে গিয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে। সোমবার (২৭ মে) রাতে রাজধানী ঢাকার খিলগাঁও, উত্তর বাড্ডায় ও যাত্রাবাড়ীতে বিদ্যুৎস্পৃষ্টের আলাদা চারটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারান তারা। মৃতরা হলেন- মরিয়ম বেগম (৪৫), লিজা আক্তার (১৫), মো. রাকিব (২৫) ও আলামিন (২২)।
রাজধানীতের বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে তিনজনের মৃত্যুর সত্যতা নিশ্চিত করেছেন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক বাচ্চু মিয়া। এদিকে উত্তর বাড্ডায় কাজ করে বাসায় ফেরার পথে রাস্তায় পড়ে থাকা বিদ্যুতের তারে জড়িয়ে আলামিনের মৃত্যু হয়েছে।
ভোলা
ভোলার তিন উপজেলায় শিশুসহ তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। এর মধ্যে লালমোহন উপজেলার পশ্চিম উমেদপুরে ঘর চাপা পড়ে আব্দুল কাদেরের স্ত্রী মনেজা খাতুন (৫৫), দৌলতখান পৌরসভার মনির হোসেনের চার বছরের মেয়ে মাইশা ও বোরহানউদ্দিন উপজেলার সাজড়া ইউনিয়নে গাছের ডাল পড়ে জাহাঙ্গীর হোসেন (৫০) মারা গেছেন। ভোলার জেলা প্রশাসক আরিফুজ্জামান ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেছেন।
বরিশাল
বরিশালে রিমালের প্রভাবে তিনজনের মৃত্যু হয়েছে। নগরের রুপাতলী এলাকায় সোমবার ভোর ৪টার দিকে একটি ভবনের ছাদের ওপরের নির্মাণাধীন দেয়াল ধসে পাশের খাবারের হোটেলের ওপর পড়ে দুইজনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- হোটেলের মালিক লোকমান হোসেন ও কর্মী মোকসেদুর রহমান। এ ঘটনায় শাকিব নামে এক হোটেলকর্মী আহত হয়েছেন। তাকে বরিশাল শেরে বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। এছাড়া বাকেরগঞ্জ উপজেলার চর দাড়িয়ালের বাসিন্দা জালাল সিকদার (৫৫) গাছের ডাল পড়ে মারা গেছেন বলে জানা গেছে।
লালমনিরহাট
জেলার আদিতমারী উপজেলায় ঝড়ে গাছচাপায় রেজিয়া বেগম (৭২) নামের এক বৃদ্ধার মৃত্যু হয়েছে। সোমবার রাতে উপজেলার ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের মহিষতুলি গ্রামে এ দুর্ঘটনা ঘটে। তিনি ওই গ্রামের তাহের উদ্দিন মুন্সির স্ত্রী।
ভেলাবাড়ি ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জমসের আলী জানান, সোমবার সন্ধ্যার পর বৃষ্টির সঙ্গে ঝড় শুরু হয়। পরে ভুট্টার শুকনো মোচা আনার জন্য ঘরের বাইরে বের হন বৃদ্ধা রেজিয়া বেগম। এ সময় একটি সুপারিগাছ ভেঙে বৃদ্ধার শরীরে পড়লে ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
খুলনা
খুলনায় ঘূর্ণিঝড় রিমালের প্রভাবে তীব্র বাতাস ও বৃষ্টিতে গাছ উপড়ে ঘরের ওপর পড়লে লালচাঁদ মোড়ল (৩৬) নামের একজনের মৃত্যু হয়েছে। রোববার রাতে উপজেলার সুরখালী ইউনিয়নের ২ নম্বর ওয়ার্ডের গাওঘরা গরিয়ারডাঙ্গা গ্রামে এ ঘটনা ঘটে। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. নাজমুল হুসেইন খাঁন ঘটনাটি নিশ্চিত করেছেন।
সাতক্ষীরা
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার পথে শওকাত মোড়ল (৬৫) নামের এক বৃদ্ধের মৃত্যু হয়েছে।
মৃত শওকাত মোড়ল গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের বাসিন্দা। গাবুরা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিএম মাসুদুল আলম এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
কুমিল্লা
কুমিল্লা নগরীতে নির্মাণাধীন একটি ভবনের দেওয়াল ধসে সাইফুল ইসলাম সাগর (১২) নামে এক শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয়েছে। সোমবার বেলা ১১টার দিকে নগরীর শাকতলা এলাকায় নূর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে এ ঘটনা ঘটে। সাগর শাকতলা এলাকার অলী আহমেদের ছেলে। সে ওই প্রতিষ্ঠানের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র ছিল। কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানা পুলিশের পরিদর্শক (তদন্ত) খাদেমুল বাহার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
কুষ্টিয়া
ঘূর্ণিঝড় রিমালের তাণ্ডবে কুষ্টিয়ার মিরপুরে টিনের চালার নিচে পড়ে বাদশা মল্লিক (৬০) নামের এক বৃদ্ধ নিহত হয়েছেন। সোমবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দাসপাড়া এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। নিহত বাদশা মল্লিক চিথলিয়া ইউনিয়নের তিন নম্বর ওয়ার্ডের দাসপাড়া এলাকার বাসিন্দা। চিথলিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এনামুল হক বাবলু বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বরগুনা
বরগুনা জেলার সদর উপজেলায় ঘরের ওপর পড়া গাছ সরাতে গিয়ে আব্দুর রহমান বয়াতি (৫৬) নামে একজনের মৃত্যু হয়েছে। তিনি আয়লা পাতাকাটা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের লেমুয়া গ্রামের বাসিন্দা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শামীম মিঞা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
উল্লেখ্য, বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট প্রবল ঘূর্ণিঝড় রিমাল উপকূলে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়েছে। গত রোববার বিকেলে ঝড়টির তাণ্ডব শুরু হয়, আর রাতে উপকূলে আঘাত হানা শুরু করে। এরপর গতিপথে রিমাল ঘরবাড়ি-গাছপালা উপড়ে ফেলে। ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে জলোচ্ছ্বাসের সৃষ্টি হয়। ফলে অনেক এলাকায় বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন প্রায় তিন কোটি মানুষ। ইন্টারনেট সংযোগের বাইরে কয়েক লাখ মানুষ। রিমালের তাণ্ডবে মোট ১৯টি জেলার ১০৭ উপজেলার এবং ৯১৪ ইউনিয়ন ও পৌরসভা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।