চিকিৎসা ভিসায় বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি রোগী

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক |

দৈনিকশিক্ষা ডেস্ক: শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা চিকিৎসা ভিসায় বাংলাদেশে আসা প্রথম এক রোগীর সফল অস্ত্রোপচার করেছেন। ভুটানের এই রোগীর নাক গহ্বরে ক্যানসার হয়েছিল। ভারতের টাটা মেমোরিয়ালে চিকিৎসায় ক্যানসারমুক্ত হলেও রেডিওথেরাপিজনিত কারণে নাকে পচন ধরে ও নাক নষ্ট হয়ে যায়। এই রোগী আবার নাক তৈরির জন্য টাটা মেমোরিয়ালে ভর্তি হন। কিন্তু দুবার অস্ত্রোপচার করেও নাক পুনর্গঠনে ব্যর্থ হন সেখানকার চিকিৎসকরা। পরে রোগী বাংলাদেশে আসেন। ইনস্টিটিউটের সার্জনরা জটিল অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে নাক পুনর্গঠন করেন। 

কারমা দেমা নামক ২৩ বছর বয়সী এই রোগী ভুটানের কলেজছাত্রী। বর্তমানে তিনি হাসপাতালের ১৩-তলায় ১৩৬৪ নম্বর কেবিনে চিকিৎসাধীন রয়েছেন। তিনি গত বছরের ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে চিকিৎসার জন্য আসেন এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে ভর্তি হন। চিকিৎসক দলের পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর গত ৯ জানুয়ারি দীর্ঘ ৮ ঘণ্টার অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কারমা দেমার নাকের পুনর্গঠন করা হয়। বর্তমানে তিনি সুস্থ আছেন। 

এই রোগীর ব্যাপারে গতকাল বৃহস্পতিবার হাসপাতালে কথা হয় দুই অস্ত্রোপচার দলের একটির প্রধান হাসপাতালের মাইক্রো সার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘একবার অপারেশন করেছি। একটা অপারেশন দিয়ে পুরো নাক তৈরি সম্ভব নয়। আরও কয়েকটা অপারেশন লাগবে। একবার অস্ত্রোপচার করে একটা অঙ্গ পরিপূর্ণভাবে রিকন্সট্রাকশন করা যায় না ও অঙ্গের পুরোপুরি সৌন্দর্য আসে না। এই রোগীর এখন একটা স্ট্রাকচার দাঁড় করিয়েছি। আরও দু-একটা অপারেশন লাগবে।’

অস্ত্রোপচার সফল হয়েছে জানিয়ে এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক বলেন, রোগী খুশি ও রোগীর সঙ্গে আসা তার ভাইও খুশি। কারণ তারা দুবার অপারেশন করিয়ে ব্যর্থ হয়ে বাংলাদেশে এসেছে। তারাও জানেন এটা কত কঠিন।

বাংলাদেশে প্রথম বিদেশি রোগী: ভুটানের কারমা দেমা চিকিৎসা ভিসায় বাংলাদেশে চিকিৎসা নিতে আসা প্রথম বিদেশি রোগী বলে জানান ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে মেডিকেল ভিসায় অন্য দেশের নাগরিক এসে চিকিৎসা নেননি। বর্ডার বা পাহাড়ি এলাকায় বর্ডার পার হয়ে এখানে-ওখানে চিকিৎসা নেয়। কিন্তু মেডিকেল ভিসায় সরকার স্বীকৃত কোনো বিদেশি রোগী বাংলাদেশে এটাই প্রথম।

কী হয়েছিল এই রোগীর: চিকিৎসকরা জানান, কারমা দেমার ৮-১০ বছর আগে নাকের গহ্বরে ক্যানসার হয়েছিল। ক্যানসারের চিকিৎসার জন্য তিনি ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে ভর্তি হন ও সেখানে তাকে কেমোথেরাপি ও রেডিওথেরাপি দেওয়া হয়। এতে তিনি ক্যানসারমুক্ত হলেও তার নাকের ভেতরে রেডিওথেরাপিজনিত পচন হয় এবং নাক নষ্ট হয়ে যায়। তিনি আবার নাক তৈরি করার জন্য টাটা মেমোরিয়ালে ভর্তি হন এবং পরপর দুবার অপারেশন করার পরও নাক পুনর্গঠনে ব্যর্থ হন সেখানকার চিকিৎসকরা। এ অবস্থায় তিনি ভারতের বাইরে উন্নত চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করছিলেন।

এ ব্যাপারে ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস বলেন, কারমা দেমা পরিবারের একমাত্র মেয়ে ও তার দুই ভাই। মা মারা গেছেন অনেক আগেই। নিম্ন আয়ের পরিবারটি মেয়ের এই জটিল চিকিৎসার জন্য ভুটান সরকারের শরণাপন্ন হয়েছিলেন।

এই চিকিৎসক আরও বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে ভুটানের রাজার খুব ভালো সম্পর্ক। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে অনুরোধ জানিয়েছেন এই রোগীর ব্যাপারে। পরে বর্তমান স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেনকে প্রধানমন্ত্রী এই রোগীর ব্যাপারে বলেন। আমরা তখন বলেছি, আমরা এই ধরনের রোগীর অস্ত্রোপচার করি। আগে অনেক অপারেশন করেছি। আমাদের সামর্থ্য আছে। এরপর সেই রোগীকে দেশে আনা হয়।’

জটিল অস্ত্রোপচারে ভারতও ব্যর্থ হয়: এ ধরনের অস্ত্রোপচার খুব জটিল বলে জানান ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, রেডিওথেরাপিজনিত যখন কোনো পচন হয়, এটা রিকন্সট্রাকশন জটিল। পচে যাওয়া অঙ্গের আশপাশের মাংস দিয়েই ওই অঙ্গ তৈরি করতে হয়। কিন্তু যাদের রেডিয়েশনের কারণে নষ্ট হয়, সেগুলো আশপাশের মাংস দিয়ে তৈরি করা যায় না। কারণ ওই মাংসগুলোতে রক্ত চলাচলের ব্যবস্থা থাকে না, সেঁক দেওয়ার কারণে নষ্ট হয়ে যায়। ভারতের টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে দুবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। আশপাশের মাংস দিয়ে একবার করার চেষ্টা করেছে। আরেকবার ফ্রি টিস্যু ট্রান্সফার, অর্থাৎ আরেক জায়গা থেকে মাংস তুলে এনে মাইক্রোস্কোপের মাধ্যমে রক্তনালি জোড়া দিয়ে করার। এভাবে দুবার অপারেশন করে তারা ব্যর্থ হয়েছে।

খোঁজ রাখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী: কারমা দেমার নিয়মিত খোঁজ রাখছেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী। দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনই সচিবালয়ে অফিস শেষে বিকেলে তিনি ছুটে যান ইনস্টিটিউটে। সেখানে অন্য রোগীদের পাশাপাশি ভুটানের কারমা দেমারও খোঁজ নেন তিনি। এ সময় রোগীর মাথায় হাত রেখে স্বাস্থ্যমন্ত্রী অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন বলেন, ‘তোমার মুখমণ্ডল তুমি দেখেছো? ঠিক আছে? কোনো চিন্তা করো না, আমরা আরও সার্জারি করব এবং সব ঠিক হয়ে যাবে। তোমাকে আরও সুন্দর লাগবে।’

বাংলাদেশের চিকিৎসার মূল্যায়ন বাড়বে: ভুটানের এই রোগীর জটিল চিকিৎসা সফল হওয়ায় বাংলাদেশের চিকিৎসার মূল্যায়ন বাড়বে বলে মনে করেন ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস। তিনি বলেন, ‘ভুটানে আমরা ১৬টা অপারেশন করে ভুটানের রাজাকে বলে এসেছি যেন তাদের রোগীদের আমাদের এখানে পাঠান। অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন ও ভুটানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত শিবনাথ রায়, তারা দুজনই মহামান্য রাজাকে বলেছেন, তাদের স্বাস্থ্য সেক্টরে বাংলাদেশ অংশীজন হতে চায়। তিনি সেটা খুব আগ্রহ নিয়ে মূল্যায়নের আশ্বাস দিয়েছেন। আমরা আশা করছি এই রোগী সুস্থ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের চিকিৎসাব্যবস্থার সেই মূল্যায়ন বাড়বে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভারতের চেয়েও বাংলাদেশে চিকিৎসা ব্যয় কম।’

চিকিৎসক দলে যারা ছিলেন: ইনস্টিটিউটের চিকিৎসকরা জানান, কারমা দেমার চিকিৎসায় অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন ও ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ক্যানসার বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. অখিল রঞ্জন বিশ্বাস এবং শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের সমন্বয়ে একটি উচ্চপর্যায়ের চিকিৎসক টিম গঠন করা হয়। পরে ৯ জানুয়ারি অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে কারমা দেমার নাকের পুনর্গঠন করা হয়। অস্ত্রোপচারে কারমা দেমার বুকের পাঁজরের তরুণাস্থি ও হাতের চামড়া/টিস্যু দিয়ে ফ্রি ফ্ল্যাট করে মাইক্রোসার্জারির মাধ্যমে সম্পন্ন করা হয়। অধ্যাপক ডা. সামন্ত লাল সেন, শেখ হাসিনা বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রায়হানা আওয়াল, অধ্যাপক ডা. নওয়াজেশ খান ও সহকারী পরিচালক ডা. মামুন খানের সার্বিক তত্ত্বাবধানে দুটি অভিজ্ঞ মাইক্রো সার্জারি টিমের একটির প্রধান ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. প্রদীপ চন্দ্র দাস ও অন্য টিমের প্রধান ছিলেন সহযোগী অধ্যাপক ডা. হাসিব রহমান। অস্ত্রোপচারের সময় অবেদনবিদ হিসেবে ছিল অধ্যাপক ডা. মো. আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে একটি দল।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা - dainik shiksha পেছালো জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্স ১ম বর্ষের পরীক্ষা প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের মামলায় ১০ জনের কারাদণ্ড, খালাস ১১৪ শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা - dainik shiksha শিক্ষা ভবনের সেই বিপুলকে বদলি, গ্রেফতার চান এমপিও শিক্ষকরা পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি - dainik shiksha পলাতক ফাহিমার ক্যাশিয়ার কামালকে গ্রেফতারের দাবি দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি - dainik shiksha দীপু মনির ক্যাশিয়ার পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের সচিব নাজমাকে বদলি ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস - dainik shiksha ঢাকা কলেজের নতুন অধ্যক্ষ অধ্যাপক ইলিয়াস রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা - dainik shiksha রাষ্ট্র পুনর্গঠনে যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তা চাইলেন প্রধান উপদেষ্টা শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না - dainik shiksha শিক্ষা কমিশন কেনো হলো না ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে - dainik shiksha ১৫ এলাকায় ৬০ কিলোমিটার বেগে ঝড় হতে পারে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বন্যায় ক্ষতির পরিমাণ ও সবুজায়নের তথ্য আহ্বান please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0056488513946533