অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেছেন, শুধুমাত্র মতাদর্শের কারণে শিক্ষককে নাজেহাল মেনে নেয়া হবে না। দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে। এর আগেও তিনি বলেছেন, শিক্ষকদের বলপ্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন পরবর্তী সবচেয়ে আলোচিত ও সমালোচিত ঘটনা হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানকে বল প্রয়োগ করে পদত্যাগে বাধ্য করা। যদিও এর পূর্বে আসিফ মাহমুদের আদর্শ শিক্ষকেও ঠিক একই পথ অবলম্বন করা হয়েছিলো। আসিফ মাহমুদের মতো শিক্ষকের পদত্যাগ যেমন আমরা চাই না, তেমনি জাফর ইকবালের মতো দলীয় লেজুড়বৃত্তিক কর্মকাণ্ড ও সমর্থন করি না। শিক্ষাঙ্গন হচ্ছে আদব কায়দা ও সভ্যতা বিকাশের সূতিকাগার আর সেই সূতিকাগারের ধাত্রী হচ্ছেন একজন আদর্শ শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক বলতে যা বুঝি এর সিকিভাগও অনেকেই আমরা হতে পারিরি। এর পেছনেও রয়েছে বিস্তর কারণ, যা একক কোনো কারণ বলে উল্লেখ করা যাবে না। প্রায়ই একটা কথা শুনতে হয়, শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করতে হবে। আমার কথা হলো কোনো মানুষই নিরপেক্ষ বা কোনো মতের বাইরে না। আমরা অনেকের মুখ থেকেই কথাটা শুনি ‘পাগল আর শিশু ছাড়া কেউ নিরপেক্ষ না’। বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মূল কথাই ছিলো বৈষম্য নিরসন তাহলে কেনো শুনতে হয় যে, তখন সুশীল সমাজ কোথায় ছিলো? এখন আপনারা কেনো এতো সোচ্চার? তাহলে কি বৈষম্য নিরসন এটা নাকি পাল্টা প্রতিশোধ?
অবাক করা বিষয় এই যে, নেটিজেনরা শিক্ষকদের রাজনীতি বন্ধ করার আহ্বান জানাচ্ছেন সেই প্রধান উপদেষ্টা কিন্তু একজন শিক্ষক তা ছাড়া যিনি আইন প্রণয়ন করে এটা বাতিল করবে সেই আইন উপদেষ্টা বর্তমানে চলমান একজন শিক্ষক ড. আসিফ নজরুল। আমাদের একটা কথা মনে রাখতে একজন শিক্ষক কোনো প্রতিষ্ঠানের একক কোনো সিদ্ধান্তে ছোটখাটো কাজ ব্যতীত তিনি করতে পারেন না। স্কুলে ম্যানেজিং কমিটি কলেজে গর্ভনিং বডি তাদের কোরাম পূর্ণ হলেই একটা সিদ্ধান্ত পাশ হয়, যা আমাদের দেশের তথা রাষ্ট্রের একটা সিস্টেম সেই সিস্টেমের বাইরে কোনো শিক্ষক এককভাবে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারে না। তবে যে শিক্ষক নীতিগতভাবে অসৎ তাকে আমরা কেউ সমর্থন করি না। তাই বলে একজন শিক্ষকের বিচারক হবেন ছাত্র সেটাও সমর্থনযোগ্য নয়। বিভাগীয় তদন্ত সাপেক্ষে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যম সেটা সমাধান হলে দেশে ও বিদেশে আমাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে না।
ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক সাধারণ সম্পাদক, ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান খানের একটি লেখা নিম্নে হুবহু তুলে ধরা যায়। ‘বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা আজ নানামুখী সংকটের আবর্তে নিমজ্জিত। পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁস আজ যেনো স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়েছে। এক কথায় বলতে গেলে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংস করার সব আয়োজনই চলছে। এ অবস্থায় শিক্ষাব্যবস্থার প্রধানতম উপাদান ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার সম্পর্কোন্নয়ন এবং এর মাধ্যমে শিক্ষাব্যবস্থার অধোগতি রোধ করা ভীষণ জরুরি। শিক্ষাব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নতির স্বার্থে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের ভিত্তি মজবুত ও দৃঢ় হওয়া প্রয়োজন। পশ্চিমা দুনিয়ায় ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কে আদব-কায়দার খুব একটা গুরুত্ব নেই। কিন্তু আমাদের দেশে আছে এবং তা থাকা অবশ্যই প্রয়োজন। এটি আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যেরই অংশ। এ ঐতিহ্য বজায় রাখতে হবে। ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যকার স্নেহ-ভালোবাসা আর শ্রদ্ধা-সম্মানের যে পবিত্র সম্পর্কের ঐতিহ্যে আমরা বিশ্বাসী, তা রক্ষায় সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। কারণ এর ফলে কেবল ছাত্র-শিক্ষক নয়, সমগ্র জাতি উপকৃত হবে।’
বিশ্ব সাহিত্যে কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বরাবরই শিক্ষকদের অধিকার ও সম্মান নিয়ে লেখেন ও বলেন। তার শ্লোগান ‘আলোকিত মানুষ চাই’। আর সেই আলোকিত মানুষ গড়ার কারিগর হচ্ছে একজন শিক্ষক। স্যারের স্বপ্ন ছাত্রছাত্রীরা একদিন সবাই আলোকিত মানুষ হবে। কারো দ্বারা প্রভাবিত না হয়ে নিজের মেধা-মনন ও প্রজ্ঞা খাটিয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। স্যারের মতো আমরাও তাই চাই।
শিক্ষকদের সঙ্গে এসব অসভ্যতা কোনোভাবেই কোনো সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ মেনে নিতে পারবেন না। সৎ, যোগ্য শিক্ষকের ঘাটতি এ সমাজে সব সময়ই ছিলো। কোনো শিক্ষক যদি অযোগ্য, অপদার্থ কিংবা দুর্নীতিবাজ হন তাহলে স্বাভাবিক নিয়মেই তিনি ছাত্রছাত্রীদের কাছ হতে স্বতঃস্ফূর্ত সম্মান পাবেন না। কিন্তু তাকে বা তাদের অপসারণ করতে হলে তার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ আছেন। এটা কোনোভাবেই ছাত্রছাত্রীদের এখতিয়ারের মধ্যে পড়ে না। এভাবে পুরো শিক্ষক সমাজের জন্য ভীতিকর অবমাননাকর উন্মত্ত উদাহরণ আমাদের একেবারে আক্ষরিক অর্থেই আরো নিঃস্ব করে দেবো।
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারকে আমরা সবাই চিনি। মাত্র ২২ বছর বয়সে প্রথমে মাস তিনেক বেসরকারি মুন্সীগঞ্জ হরগঙ্গা কলেজ এবং পরে রাজশাহী সরকারি কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন ১৯৬২ খ্রিষ্টাব্দে। ৩০ বছর পর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেন। তার শিক্ষকতা জীবনের নানা স্মৃতি নিয়ে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দে একটি বই বের করেন। নাম ‘নিস্ফলা মাঠের কৃষক’। এই বইয়ে স্যারকে অপদস্ত করার একটি প্রচেষ্টার বর্ণনা আছে। ঘটনাটি এ রকম।
স্যার তখন একটি টেকনিক্যাল কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। মাধ্যমিকের রেজাল্ট বেরোবার পর ওই ব্যক্তি স্যারের কলেজে এলেন তার ছেলেকে ভর্তির তদবির নিয়ে। সমস্যা হলো তার ছেলে কলেজে কর্তৃক ভর্তির জন্য নির্ধারিত নম্বরের চেয়ে বোর্ড পরীক্ষায় ২ নম্বর কম পেয়েছে। স্বাভাবিকভাবেই স্যার রাজি হলেন না। কারণ, তাকে নিতে গেলে ওরকম আরো ৪০/৫০ জনকে নিতে হবে। অনেক অনুরোধ উপরোধ করে যখন কাজ হলো না তখন লোকটি স্যারকে শাসিয়ে গেলেন কীভাবে ভর্তি না করে থাকা যায় তিনি দেখে নেবেন।
এরপর স্যারকে একেএকে ফোন করলেন শিক্ষা বিভাগের ডিপিআই শামসুল হক এবং প্রাদেশিক পরিষদের স্পিকার আবদুল হামিদ চৌধুরী। ওনারা কোনোভাবে ভর্তি করানো যায় কি না সে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু স্যারের ব্যাখ্যা শুনে নিবৃত হন। পরে ফোন এলো সরাসরি তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী মফিজউদ্দীনের। এবার কোনো অনুরোধ নয় সরাসরি বলা হলো ভর্তি করানোর জন্য। জবাবে আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ বিনীতভাবে বললেন, আপনি বললে অবশ্যই নেবো। আপনি ওর দরখাস্তের ওপরে আমাকে লিখিত নির্দেশ দিন। এ কখা শুনে মন্ত্রী চুপ হয়ে গিয়েছিলেন।
ব্যাপারটি ওখানেই শেষ হয়ে যেতে পারতো। কিন্তু হলো না। ওই হোমরাচোমরা আবার এসেছিলেন স্যারের কাছে ওনার পুত্রসহ। রুমে ঢুকেই ধমক দিয়ে বলেছিলেন, জানেন আপনার মতো একশোটা মাস্টারকে আমি কিনতে পারি। স্যারও ছেড়ে দেননি। বলেছিলেন, আপনি কি জানেন আপনার মতো একশোটা অশিক্ষিতকে আমি পড়ালেখা শেখাতে পারি।
এরপর তিনি অনেক বকাবকি করেছিলেন স্যারকে। সেদিন স্যার খুব তাৎপর্যপূর্ণ একটি কথা বলেছিলেন লোকটিকে। ওই কথাটি বলার জন্যই এতো লম্বা কাহিনি বলা। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার লোকটিকে বলেছিলেন, আপনি আমার মতো কতোজন শিক্ষককে কিনতে পারেন জানি না। কিন্তু যে ছেলের জন্য আপনি এতোসব করতে চাচ্ছেন তাকে স্বাচ্ছন্দ্যে বাড়িতে ফেরত নিয়ে যেতে পারেন। ওর পড়ালেখা হবে না। যে ছাত্র একবার জানতে পারে তার শিক্ষকেরা তার বাবার টাকায় কেনা চাকর। সে আর মানুষ হয় না। বিষয়টি এরকমই। যে ছাত্রছাত্রীরা জেনে যায় তারা শিক্ষককে কলার ধরে পদত্যাগ করাতে পারে তারা ভবিষ্যতে আর যাই করতে পারুক পড়ালেখা করতে পারবে না। ওটা তাদের হবে না।
শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির সমর্থন আমি করি না। সায়ীদ স্যার তার বইতে ১৯৯৯ খ্রিষ্টাব্দেই লিখেছেন, সেদিন শিক্ষক সত্তার অহংকারে গলা উঁচু করে তাকে কথাগুলো বলেছিলাম, কিন্তু আজ পেছনের দিকে তাকিয়ে মনে হয়; আমার নয়, সারা দেশে সবখানে তার দম্ভই আজ জয়ী হয়ে গেছে। জাতির শিক্ষকেরা আজ ছাত্রদের বাবার পয়সায় কেনা ব্যক্তিগত ভৃত্যের কাতারে নাম লিখিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু ছাত্রছাত্রীদের উলঙ্গ বেয়াদবিকে প্রশ্রয় দিয়ে নয় বরং প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলার মধ্য দিয়ে।
‘কাজী কাদের নেওয়জ এর ভাষায় বলতে চাই,
উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ আলমগীর।’
বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকারের কাছে সকলেরই কেবল চাওয়া আর পাওয়ার হিসাব নিয়ে শাহবাগ চত্বর হয়ে উঠেছে যেনো ‘আবদার চত্বর’। তবে এটাও আমাদের ভাবতে হবে বর্তমানে বাংলাদেশের বন্যা পরিস্থিতির যে অবস্থা সে হিসেবে পরিবেশটা আমাদের অনুকূলে নয়। তবু আমরা আশায় বুক বেঁধে স্বপ্ন দেখি ড. মুহাম্মদ ইউনূস যেনো মুঘল আমলের বাদশাহ আলমগীরের মতো এ যুগের বাদশাহ আলমগীর হয়ে ছাত্র ও শিক্ষকের মধ্যে শিক্ষা গুরুর মর্যাদা স্থাপনের নজীর সৃষ্টি করেন।
লেখক: শিক্ষক, ভাওয়াল মির্জাপুর কলেজ, গাজীপুর