যে উদ্দেশ্য নিয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়েছিলো তা মাঝপথে গতিপথ পাল্টে ভিন্ন ধারায় প্রবাহিত হয়ে শক্তিশালী টর্নেডোর রূপ ধারণ করে। এতে দেশের সরকারকেই তারা উৎখাত করে ফেললো। এটা জনগণের কাছে অন্য একধরনের স্বাধীনতার স্বাদ এনে দিলো এতে কোনো সন্দেহ নেই। ছাত্রদের ভূমিকা প্রসংশিত হলো এবং ছাত্রদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে শান্তিতে নোবেলজয়ী প্রফেসর ড. ইউনূস তার উপদেষ্টামণ্ডলীকে নিয়ে দেশ পরিচালনার ভার নিলেন। কিন্তু দেশে কি তাৎক্ষণিক শান্তি ফিরে এলো? দেশের ভেতরে চলছে একের পর এক ঘটতে থাকলো চুরি, ডাকাতি, মসজিদ-মন্দিরে হামলা, মূর্তি ভাঙা, অগ্নিসংযোগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রধানদের জোর করে অপসারণ ও পদত্যাগে বাধ্য করা।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র হত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চোর সন্দেহে এক মানসিক রোগীকে নৃশংসভাবে হত্যা, মাজার ধ্বংসসহ নানারকম অপতৎপরতা চলছে দেশব্যাপী। দেশের এমন অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে উৎকণ্ঠিত সচেতন মহল সমকালীন বিভিন্ন সংস্কার-প্রস্তাবের সঙ্গে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র-রাজনীতি বন্ধেরও আহ্বান জানাচ্ছেন। ছাত্র-রাজনীতি নিষিদ্ধের এই দাবি কি আদৌ গ্রহণযোগ্য? সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজনীতি বন্ধ ঘোষিত হলে রাজনীতিবিদ তৈরি হবেন কীভাবে। দেশে কি রাজনীতিবিদ তৈরির আলাদা কোনো কারখানা আছে? রাজনীতিবিদদেরকে বাদ দিলে নেতৃত্ব দেবে কে, দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেবে কে?
উল্লিখিত প্রশ্নগুলোর যথাযথ উত্তর খুঁজতে আমরা একটু পেছনে ফিরে দেখি। পরাধীন বাঙালি জাতিকে স্বাধীন করবার প্রয়াসে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে যে গণ-আন্দোলন সংঘটিত হয়েছিলো তার বীজ রোপিত হয়েছিলো ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে। এ কথা অস্বীকার করবার উপায় নেই। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা একটি অবিস্মরণীয় দিন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আমাদের দামাল ছাত্র-সৈনিকরা ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত করেছিলো তাদের বুকের তাজা রক্তে। সেই রক্তধারা ধাপে ধাপে এগিয়ে দিয়েছে এ দেশের গণমানুষের চেতনাকে, বাঙালির রাজনৈতিক ও আর্থসামাজিক মূল্যবোধ ও চাহিদাকে। ভাষা আন্দোলনের শিক্ষাই বাঙালি জাতিকে প্রথম স্বাধিকার আন্দোলনের অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত করে, জনগণের মধ্যে জাতীয় চেতনা তথা বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়, অধিকারবঞ্চিত জাতির মনে সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বাধিকার অর্জনের আকাঙ্ক্ষা জাগ্রত করে এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে লিপ্ত হবার অনুপ্রেরণা যোগায়। তৎকালীন ছাত্র ঐক্যে পরিচালিত ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম এবং শ্রেষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক সোপান যার চূড়ায় অঙ্কিত হয়েছিলো স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়। ভাষাশহীদদের মহান ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে স্বাধীন বাঙালি জাতি আজ এক মহান গৌরবের অধিকারী। ’৬২ এর সামরিক শাসকের শিক্ষানীতি বিরোধী আন্দোলন, ’৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১ এর স্বাধীনতা আন্দোলনের সবকিছুতেই মূখ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন আমাদের ছাত্ররা।
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বরে বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের এক অনিবার্য বাস্তবতা যার স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন সেই সময়ের ছাত্রনেতারা। পাক হানাদার শাসকগোষ্ঠী ধর্মের নাম ভাঙিয়ে বহুকাল ধরে পূর্ববাংলার ধর্মভীরু, শান্তিপ্রিয় সাধারণ মানুষের ওপর চালিয়েছিলো অবর্ণণীয় সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক নিষ্পেষণ, নির্যাতন, অত্যাচার ও জুলুম যার শুরু হয়েছিলো রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাবকে কেন্দ্র করে এবং যবনিকাপাত ঘটে ১৯৭১ এর এই দিনটিতে। স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশকে স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের এক দলীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধেও রুখে দাঁড়িয়েছিলো তৎকালীন ছাত্রসমাজ। দীর্ঘ দশ বছরের স্বৈরশাসন থেকে দেশকে মুক্ত করতে পুলিশের বুলেটে প্রাণ দিয়েছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা শাহজাহান সিরাজ, বুলেটবিদ্ধ হয়ে এখনো প্রায় পঙ্গুজীবন যাপন করছেন তখনকার জাতীয়তাবাদী ছাত্রনেতা রুহুল কবীর রিজভী। তখন প্রাণ হারিয়েছেন ডাক্তার মিলনসহ আরো অনেক ছাত্র। তীব্র আন্দোলনের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন সামরিক জান্তা এরশাদ, বিজয় সূচিত হয় ছাত্র-জনতার তথা গণতন্ত্রের।
ছাত্ররাজনীতির এতো গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস থাকা সত্বেও, দেশ রক্ষায় ছাত্রদের এতো অবদান থাকা সত্বে কেনো এখন শিক্ষাঙ্গন থেকে রাজনীতিকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করতে চাচ্ছেন অনেকেই? হ্যাঁ, এর পেছনে অবশ্যই যৌক্তিক কারণ আছে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে সামরিক এবং গণতান্ত্রিক উভয় সরকারের আমলেই ছাত্ররাজনীতিকে কলুষিত করা হয়েছে। ছাত্রদেরকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে নোংরা অপরাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য, আর ছাত্ররাও রাজনীতিবিদদের হাতে ক্রীড়নক হয়ে ব্যবহৃত হয়েছে তারা নিজেরা না বুঝেই। অস্ত্রবাজি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ-কোথায় নেই ছাত্ররা! ছাত্রলীগ, জাসদ ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, ছাত্রশিবির কেউ পিছিয়ে ছিলো না যখন যারা সুযোগ পেয়েছে। ছাত্ররাজনীতি মানেই যেনো প্রতিপক্ষের বুকে ছুরি মারা, গুলি করা, হাতে-পায়ের রগ কাটা, চাঁদাবাজি আর হলে ছিট দখল করা। গভীর রাতে টর্চার-সেলে ডেকে নিয়ে প্রতিপক্ষকে নির্যাতন করা যেনো নিত্যনৈমিত্তিক অভ্যাসে পরিণত হয়েছে ছাত্রনেতাদের। ছাত্রনেতারা এখন দামি গাড়ি হাঁকিয়ে চলেন, ছাত্রদের হেলমেট বাহিনী পুলিশের ছত্রছায়ায় তাদের পাশাপাশি প্যারামিলিশিয়া হিসেবে পিস্তল-বন্দুক-কাটারাইফেল ও বোমা হাতে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করে। এর জন্য কি ছাত্ররাজনীতিকে দায়ী করা যাবে? অবশ্যই না। এর দায়ভার সম্পূর্ণরূপে বহন করতে হবে সরকার এবং বিরোধীদলকে। তারা উভয়েই কোমলমতি ছাত্রদের হাত্রে অস্ত্র ও টাকা-পয়সা তুলে দিয়ে তাদেরকে বিভ্রান্ত করেছে। অস্ত্র ও টাকাপয়সা-এ দুটোর মহিমা ও শক্তি অসীম। এ দুইয়ের খপ্পরে পড়লে মানবতা ও বিবেকবোধ হারাতে খুব বেশি সময় লাগে না। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখন গণতান্ত্রিক চর্চা নেই, ছাত্র-সংসদে কোনো নির্বাচন নেই, আছে শুধু টাকার খেলা ও পেশি শক্তি। কাজেই অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মতোই ছাত্র সংগঠনগুলোও এখন বিপথগামী এবং জনগণের আস্থা ও বিশ্বাসহীনতার শিকার। এখন উপায় কী?
ছাত্ররাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা, বিশ্বাস ও সম্মানবোধের হৃত জায়গাটি ফিরিয়ে আনা এখনো সম্ভব। এজন্য গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে ছাত্র-সংসদের নির্বাচন হতে হবে এবং শুধু নির্বাচিত প্রতিনিধিরাই নেতৃত্ব গ্রহণ করবেন। সরকার ও বিরোধীদলকে এসব ছাত্রনেতাদেরকে অবৈধ অস্ত্র ও অর্থদান থেকে বিরত থাকতে হবে এবং বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজের প্রক্টরিয়াল বডিকে সজাগ থেকে এদের ওপর কড়া নজর রাখতে হবে যেনো তারা কোনোভাবেই কোনো অনৈতিকতার সঙ্গে জড়িয়ে না পড়ে। বুয়েটের মতো অন্যান্য বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠানকে রাজনীতি থেকে মুক্ত রাখতে হবে তবে সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্ররাজনীতি বহাল রাখতে হবে, নইলে ভবিষ্যৎ নেতার জন্ম হবে কোথায়, ভবিষ্যতে দেশ পরিচালনায় হাল ধরবে কে?
লেখক: যুগ্মপরিচালক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়