ছাত্রলীগের তিন নেতাকে থানা হেফাজতে আটকে রেখে মারধরের অভিযোগ ওঠে পুলিশের বিরুদ্ধে। বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতীম সংগঠনটির বর্তমান ও সাবেক ছাত্রনেতারা তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং নিন্দা জানান। দেশজুড়ে ব্যাপক আলোচনায় আসে এ ঘটনা। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাজধানীর শাহবাগ থানার এ ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত হিসেবে সামনে আসে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) রমনা জোনের সাবেক অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) হারুন অর রশিদের নাম।
এরপর দ্রুত সময়ে ঘটনার তদন্তে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কিন্তু প্রায় দেড় মাস পেরিয়ে গেলেও কোনো কমিটিই তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করেনি। এরই মধ্যে দফায় দফায় প্রতিবেদন দাখিলের সময় বাড়ানো হয়েছে। প্রতিবেদন দাখিলে বিলম্ব নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। তবে তদন্ত কমিটির সদস্যরা বলছেন, কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নয়, তদন্তকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যতটা সময় দরকার ততটাই দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে ডিএমপি কমিশনার জানিয়েছেন, আগামী ২৩ অক্টোবর তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার তারিখের পরই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা তদন্ত কমিটির পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তদন্তকাজ চলমান। তবে তা শেষ হতে সময় লাগবে। খুব শিগগির প্রতিবেদন তৈরি করা যাবে তেমনটি এখনই বলা যাচ্ছে না।
এ অবস্থায় ঠিক কবে নাগাদ প্রতিবেদন দাখিল হবে তা নিয়ে এক ধরনের ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। আর প্রতিবেদন তৈরিতে বিলম্ব বা দীর্ঘসূত্রতায় ভুক্তভোগীরা মামলার প্রস্তুতি নিতে পারেন। সহসা প্রতিবেদন দাখিলের কোনো আলামত না থাকায় এরই মধ্যে মারধরের শিকার ছাত্রলীগের ভুক্তভোগী একজন নেতা সাবেক এডিসি হারুন-অর-রশীদের বিরুদ্ধে মামলা করার কথা ভাবছেন।
ঘটনার বিষয়ে যা বলেন সংশ্লিষ্টরা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আনোয়ার হোসেন নাঈম, ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় বিজ্ঞানবিষয়ক সম্পাদক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ হলের সাধারণ সম্পাদক শরীফ আহমেদ মুনিম এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বঙ্গবন্ধু হল শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি মাহবুবুর রহমানকে মারধরের ঘটনার সূত্রপাতের বিষয়ে রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব (এপিএস) আজিজুল হকের স্ত্রী ডিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) সানজিদা আফরিন এক সাক্ষাৎকারে দাবি করেন, ৯ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় তিনি চিকিৎসা নিতে বারডেম হাসপাতালে গিয়েছিলেন। চিকিৎসকের সাক্ষাৎ পেতে সহকর্মী হিসেবে এডিসি হারুনের সহায়তা নেন। এসময় কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে হাসপাতালে এসে এডিসি হারুনকে মারধর করেন তার স্বামী আজিজুল।
এদিকে রাজধানীর শাহবাগ থানায় পুলিশের হাতে মারধরের শিকার তিন ছাত্রলীগ নেতার মধ্যে গুরুতর আহত আনোয়ার হোসেন নাঈম সাংবাদিকদের কাছে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সেসময় দাবি করেন, রাষ্ট্রপতির সহকারী একান্ত সচিব আজিজুল হকের বাড়ি তার এলাকায় হওয়ায় তার ফোন পেয়ে বারডেম জেনারেল হাসপাতালের চারতলায় যান। সেখানে গিয়ে আজিজুল হক ও হারুনের মধ্যে বাগবিতণ্ডা দেখতে পান। তাদের নিবৃত্ত করার চেষ্টার একপর্যায়ে শাহবাগ থানার ওসিকে (তদন্ত) ফোন করে হাসপাতালে ডেকে নেন এডিসি হারুন। পুলিশ গিয়ে আজিজুল, ছাত্রলীগের শরীফ আহমেদ মুনিম এবং মাহবুবুর রহমানকে মারধর করে। পরে হাসপাতাল থেকে পুলিশ জোর করে আজিজুলসহ তিন-চারজনকে গাড়িতে তুলে থানায় নিয়ে যায়।
থানায় মারধরের বিষয়ে এই ছাত্রলীগ নেতা বলেন, আমি শাহবাগ থানায় গিয়ে দেখি ওসির (তদন্ত) কক্ষে সবাইকে আটকে রেখে মারধর করা হচ্ছে। ওসির কক্ষের দরজা টেনে ভেতরে ঢুকতেই ১০ থেকে ১৫ জন আমার ওপর হামলা করেন। আমার মুখে কিলঘুষি মারেন। একপর্যায়ে আমাকে নিচে ফেলে পা দিয়ে লাথি মারেন। এডিসি হারুন এবং ওসিও মারধর করেন।
বারডেম জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যাওয়া এডিসি সানজিদা আফরিনের রোগী নিবন্ধন তথ্য ফর্ম রয়েছে হাতে। ফর্মটিতে দেখা গেছে, ৯ সেপ্টেম্বর ৩০৯০৮৩০ নম্বর সিরিয়ালের রোগীর আইডি নম্বরে নিবন্ধন করেন সানজিদা। ফর্মটিতে বাবা বা স্বামীর নামের জায়গায় আজিজুল হকের নাম না থাকলেও মো. হোসাইন আলী নামের একজনের নাম রয়েছে। সানজিদার মোবাইল ফোন নম্বর দেওয়া থাকলেও নেই অন্য কোনো তথ্য। তবে ঘটনার পরদিন ১০ সেপ্টেম্বর সকাল ১০টা ৫৬ মিনিটে হাসপাতাল ছেড়ে যাওয়ার তথ্য রয়েছে রোগী নিবন্ধন তথ্য ফর্মটিতে।
বরখাস্ত ও বদলি-কাণ্ড
ছাত্রলীগ নেতাদের থানা হেফাজতে নির্যাতনের ঘটনার পরদিন পুলিশ সদরদপ্তরের অতিরিক্ত ডিআইজি (পার্সোনেল ম্যানেজমেন্ট-১) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন সই করা এক প্রজ্ঞাপনে এডিসি হারুন অর রশিদকে ডিএমপির রমনা জোন থেকে বদলি করে ডিএমপির দাঙ্গা দমন বা পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট বিভাগে সংযুক্ত করা হয়। পরে পৃথক এক আদেশে তাকে আর্মড পুলিশ ব্যাটালিয়নে (এপিবিএন) অতিরিক্ত পুলিশ সুপার হিসেবে সংযুক্ত করা হয়।
কিন্তু তার বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে তুমুল সমালোচনার জেরে ১১ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের (পুলিশ- শাখা) সিনিয়র সচিব মো. মোস্তাফিজুর রহমান সই করা এক প্রজ্ঞাপনে হারুনকে সরকারি চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। এর ২৪ ঘণ্টা না পেরোতেই ১২ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের (পুলিশ- শাখা) সিনিয়র সহকারী সচিব মো. মাহাবুর রহমান শেখ সই করা পৃথক প্রজ্ঞাপনে হারুনকে রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি কার্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার পদে সংযুক্ত করা হয়।
অন্যদিকে এ ঘটনায় শাহবাগ থানার পুলিশ পরিদর্শক (অপারেশন) মো. গোলাম মোস্তফাকে ডিএমপির কেন্দ্রীয় সংরক্ষণ দপ্তরের লাইনওআর পদে বদলি করা হয়।
তদন্ত প্রতিবেদন
ছাত্রলীগের তিন নেতাকে শাহবাগ থানায় মারধরের ঘটনার একদিন পরই ১০ সেপ্টেম্বর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে ডিএমপি। আইন প্রয়োগকারী এই সংস্থাটির তৎকালীন কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক এ কমিটি করেন। কমিটির সভাপতি করা হয় ডিএমপির উপ-পুলিশ কমিশনার (অপারেশনস) মো. আবু ইউসুফকে। আর সদস্য করা হয় অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার (নিউমার্কেট জোন) শাহেন শাহ্ ও অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিবি-মতিঝিল) মো. রফিকুল ইসলামকে। কমিটিকে দুদিনের মধ্যে ডিএমপি কমিশনার বরাবর প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়।
সে মোতাবেক ১২ সেপ্টেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিলের সময় নির্ধারিত থাকলেও নির্দিষ্ট তারিখে তা জমা দিতে পারেনি তদন্ত কামিটি। ১৩ সেপ্টেম্বর সময় বাড়িয়ে পাঁচ কার্যদিবসে তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর সময়সীমা শেষ হলেও তখনো প্রতিবেদন জমা দিতে পারেনি তদন্ত কমিটি। ২৪ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় দফায় সময় বাড়িয়ে তিন কার্যদিবস পর ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হলেও সেবারও ব্যর্থ হয় তদন্ত কমিটি।
আলোচিত এ ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের স্বার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় পৃথক তদন্ত কমিটি গঠন করে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের যুগ্ম সচিব (পুলিশ-১ অধিশাখা) আবুল ফজল মীর বাদলকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যসচিব করা হয় জননিরাপত্তা বিভাগের উপসচিব (পুলিশ-৩ শাখা) নূর-এ-মাহবুবা জয়াকে আর সদস্য হন ডিএমপির যুগ্ম পুলিশ কমিশনার (লজিস্টিকস) মোহাম্মদ জায়েদুল আলম।
তদন্তের বিষয়ে কমিটির আহ্বায়ক আবুল ফজল মীর বাদল বলেন, তদন্ত চলছে। আমাদের সময় লাগবে। খুব শিগগির প্রতিবেদন তৈরি হবে কি না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটা বলা যাচ্ছে না।
ডিএমপির তদন্ত কমিটির সময় নিয়ে ভিন্ন বক্তব্য
গত ২৭ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও তা জমা দেয়নি ডিএমপির তদন্ত কমিটি। তবে নতুন করে তৃতীয় দফায় সময় বাড়ানো হয়েছে কি না, সেটি জানানো হয়নি। এতে অনেকটা আড়ালে পড়ে যায় তদন্ত প্রতিবেদন তৈরি এবং তা দাখিলের বিষয়টি।
এ নিয়ে কথা বলতে গত বৃহস্পতিবার (১৯ অক্টোবর) কমিটির সভাপতি আবু ইউসুফের মোবাইল ফোন নম্বরে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। পরে তদন্ত কমিটির সদস্য শাহেন শাহ্ বলেন, ২৭ সেপ্টেম্বরের পর তদন্ত কমিটির সময় আরও বাড়ানো হয়েছে।
তৃতীয় দফায় কতদিন সময় বাড়ানো হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো নির্দিষ্ট তারিখ নেই। তদন্তকাজ সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যতটুকু সময় প্রয়োজন ততটুকুই বাড়ানো হয়েছে। আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি।
তদন্ত কমিটির মেয়াদ ও তদন্ত প্রতিবেদন তৈরির অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চাইলে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথমে বলেন, এ বিষয়ে একটু জেনে বলতে হবে। এর কিছুক্ষণ পর তিনি বলেন, তদন্ত কমিটি আরও সাত কার্যদিবস সময় বাড়িয়ে নিয়েছে। আগামী ২৩ অক্টোবর এসময় শেষ হবে। তদন্ত প্রতিবেদন পাওয়ার পর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
২৩ অক্টোবর সাত কর্মদিবস ধরলে মাসের ১০ কিংবা ১১ তারিখেও প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা ছিল। গত ২৭ সেপ্টেম্বরের পর থেকে একাধিকবার তদন্ত প্রতিবেদন জমার তারিখ পরিবর্তন করা হয়েছে। ডিএমপি কমিশনার প্রতিবেদন জমা দেওয়ার সুনির্দিষ্ট তারিখ বললেও তদন্ত কমিটি বলছে ‘নির্দিষ্ট কোনো তারিখ নেই। তদন্ত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করতে যতটা সময় লাগা দরকার ততটাই লাগবে।’
এদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনও শিগগির হচ্ছে না। অন্যদিকে ডিএমপির কমিটি গঠনের দুদিনের মধ্যে তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা থাকলেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে তা দীর্ঘায়িতই হচ্ছে। প্রায় দেড় মাস হতে চললেও এখনো প্রতিবেদন তৈরির বিষয়ে অগ্রগতিই জানা যায়নি। ফলে এসব প্রতিবেদন কবে জমা দেওয়া হবে কিংবা আদৌ সেরকম প্রস্তুতি চলছে কি না, তা নিয়ে বাড়ছে অনিশ্চয়তা।