রাবি পুনর্মিলনীতে ‘আগুনপাখির’ কথাকারছাত্রের কাছে পরাজিত হওয়াও শিক্ষকের জন্য গৌরবের

নিজস্ব প্রতিবেদক |

`আজ এখানে একটা মহা সমাবেশ ঘটেছে। ঘটিয়েছে মনোয়ারুল হক। তাকে আমরা হক বলে জানি এবং মনোয়ার একটু আগে বলেছে, সে একা নয়, তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক ছাত্র-ছাত্রী। তারা তাকে সহযোগিতা করেছে। তবুও সব জিনিসের তো একটা মুখপাত্র থাকে তো...আর সেই মুখপাত্র বলতে গেলে কিন্তু প্রথমেই মনোয়ারুল হকের নামটা আমাকে করতে হবে। বোধ হয় প্রথমেই এই ধারণা গজিয়েছে মনোয়ারের মধ্যেই, তারপর সে অন্যান্যের সাথে যোগাযোগ করেছে। যা যা দরকার সব কিছু করেছে। কিন্তু এখনো সে দৃঢ়হাতে মাস্তুলটা ধরে আছে।

আমি কিছুকাল আগে যখন সিলেটে গিয়েছিলাম, তখন একবার মনোয়ারের সঙ্গে আমার টেলিফোনে কথা হয়েছিল। মনোয়ার তখন বলল, আমরা এ রকম কিছু একটা করার চেষ্টা করছি। সে যে এতো তাড়াতাড়ি এতো সুচারুরূপে সুন্দর করে যে করেও ফেলতে পারবে, এটা অকল্পনীয় ব্যাপার। বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এই জাতীয় পুনর্মিলনী হয়নি। অনেকগুলো বিশ্ববিদ্যালয় তো রয়েছে, কোথায়ও এটা হয়নি। সে জন্যে আমি মনোয়ারের সত্যি সত্যি জয় ঘোষণা করছি। সে এই কাজটা যে করতে পেরেছে, আমি অসম্ভব আনন্দিত। কারণ, সে আমাদের একটা আনন্দের খনিতে নিয়ে এসেছে। যে খনিতে অঢেল আনন্দ পাওয়া যায়। যাদের মুখ গত ত্রিশ বছর দেখি না, তাদের চেহারা দেখতে পারছি, তারা সামনে আসছেন। কারও ক্ষয় হয়েছে শরীরে, কারও বার্ধ্যকের চিহ্ন এসেছে। যাদের যুবক দেখেছি, তাদের এখন বৃদ্ধ দেখছি। তাতে বুঝতে পারছি সময় তো কাউকে ক্ষমা করে না। সময় তার কাজ ঠিক করে যাবে এবং এটা ঠিক মনোয়ার যদি এই সময় বেছে না নিত, তাহলে হয়তো আমাদের মতো মানুষরা আজ এখানে হয়তো যোগদান করতে পারত না।

সে জন্যে আমি অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে মনোয়ারকে এবং তার সহযোগী যারা, যারা তাকে সাহায্য করেছে, তাদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। ধন্যবাদ জানানো খুব শুকনো একটা কথা, কী বললে যেন বলা যাবে, ভালোবাসা জানাই… তাও যথেষ্ট হলো না। মোটামোটি যথেষ্ট হওয়ার নয়। কারণ এইটুকু আমরা জানি কিছু কিছু ভাণ্ডার অফুরন্ত থাকে। সেটা হচ্ছে ছাত্রের জন্য শিক্ষকের স্নেহ। এই স্নেহ কখনো ফুরায় না। জীবনের সব লেনদেন শেষ হয়ে গেলেও এই সম্পর্ক কখনো ফুরায় না। মৃত শিক্ষকও ছাত্রের মনে শিক্ষক হিসেবেই অধিষ্ঠিত থাকেন। সে জন্যেই আজ এই মহা সমাবেশ ঘটেছে। আমি তো এখন সব দিক থেকেই প্রাক্তন, সব দিক থেকেই প্রাক্তন, আমি অনেক দূরে থাকি, তেমন কোনো যোগাযোগ আমার কারো সাথে নেই। অথচ এ কথা ঠিক আমি রাজশাহী কলেজের ছাত্র। আমি দৌলতপুর কলেজ থেকে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা নিগৃহীত হয়ে শেষ বছর থেকে রাজশাহী কলেজে পড়েছি। তারপর রাজশাহী কলেজেই দেখছি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস হচ্ছে, ইতিহাস বিষয়ের ক্লাস হচ্ছে, দর্শন বিষয়ের ক্লাস হচ্ছে।

তারপর শহরের ভিতরে টিচার্স ট্রেনিং কলেজের পাশে দুটো ঘর নিয়ে ফিলোসপি ডিপার্টমেন্ট খোলা হয়েছে। আর এদিকে কিছুই আসে না, কতোগুলো টিন শেড ছিল ওই টিন শেডে অল্প সংখক ছাত্র, বিশেষ করে যারা অর্থনীতি পড়ত এমন কিছু ছাত্র ওখানে থাকত। আর থাকত প্রচুর পরিমাণে গোখরা সাপ এবং সেই সঙ্গে দু-চারটা অজগরও মিলত আর কি। এই যে সম্পূর্ণভাবে পতিত পুরো জায়গাটা, সাড়ে সাতশ’ একর জায়গা, এইটাকে পূর্ণ করা এখনো সম্ভব নয়, হয়ওনি। হয়তো তা এক-চতুর্থাংশ পূর্ণ হয়েছিল কিন্তু তাতেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখা-প্রশাখা মিলে বিরাট  একটা বিস্তার লাভ করছে, একটা গৌরবের জায়গায় পৌঁছে গেছে। আর সেই গৌরবচিহ্নই এখন ধারণ করছে আমাদের ছাত্ররা, আমাদের গর্বরা। আমি রাতদিন বলি, একমাত্র দুই জায়গায় পরাজয় স্বীকার করা ঠিক যায় এবং পরাজয় স্বীকার করলে সেটা আসলে জয়। পিতা যদি পুত্রের কাছে পরাজিত হয় তাহলে সেটা পিতার গৌরব এবং শিক্ষক যদি ছাত্রের কাছে পরাজিত হয় তাহলে সেটাও শিক্ষকের গৌরব। এটা আমাদের মনে রাখতে হবে। কাজের এই ছাত্রদের নিয়ে আমরা অহংকার করছি, গর্ব করছি, খুবই আকাঙ্ক্ষা করছি যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও অন্যত্র যে ক্ষয় প্রবেশ করেছে, এই ক্ষয় যেন একেবারে ধ্বংস করে না ফেলে আমাদের।

আজকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি কিন্তু প্রায় একজন অপরিচিত ব্যক্তি, দু-চারজন মাত্র চেনে। আর সেইভাবে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি যেতেও চাই না, যাইও না এবং অনেক কথা শুনি এতে আমার মনে হয় যে তাহলে যক্ষ্মারোগ, যে কীট প্রবেশ করছে রাষ্ট্রে-সমাজে সেই একই যক্ষ্মা, একই ক্ষয় রোগ আমাদেরকে জাতিগতভাবে আক্রমণ করল। আমাদের কি শেষ করে একেবারে ঝাঁজরা করে দেবে? রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে তাকালে এমন সন্দেহ কখনও কখনও হয়। অথচ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে বলা যায় বাংলাদেশের সমস্ত বড় বুদ্ধিজীবী এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হয় শিক্ষক নয় ছাত্র এবং তারাও প্রায় আর অবশিষ্ট নেই। এখানে জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী, এখানেই বদর উদ্দিন উমর, এইখানেই মুস্তাফা  নূরউল ইসলাম  … সবাই এখানের তো। এখানে ইতিহাসের সালাহউদ্দিন আহমদ। যারা বড় মানুষ সবাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছে। মনে হয় রাজশাহী শূন্যতার মানে বাংলাদেশের মুখমণ্ডল শূন্য, তার বুকের ভাষা নেই। এখনও তাই এবং আমি আশা করি আমাদের যারা ছাত্র, যাদের নিয়ে আমরা গর্ব করি আমরা যেন এই গর্ব  আকাশ পর্যন্ত উঁচু করতে পারি। যে এরা আমার ছাত্র ছিল এই কথায় বলতে পারি এরা আমাদের অতিক্রম করে গেছে, এরা আমাদের ছাড়িয়ে গেছে। আমরা যেখানে ছিলাম, সেখান থেকে কত দূরে অনেক সামনে আমাদের নিয়ে গেছে। এই কথাটাই যেন আমরা বলতে পারি, এইটাই আমি আশা রাখছি। হয়তো আর দেখা কারো সঙ্গে হয়তো হবে না, এরকম অনুষ্ঠান আর কবে হবে জানি না এবং আমাদের সূর্য অস্তাচলে নেমেছে এখন শুধু নামতে বাকি সেই ডুবন্ত সূর্যের মৃদু আলোতো আমরা একবার গোটা পৃথিবীকে রঙিন দেখে নিই।

আজকে সেটাই দেখলাম, আজকে মনোয়ারের কল্যাণে আমরা সেই আমাদের জীবনের অপরাহ্নকালে স্তিমিত আলোয় আমরা সোনার মত এই পৃথিবীটা আবার দেখলাম, আমার ছাত্রদের দেখলাম। আমার গর্ব, অহংকার আমি তার অন্ত পাচ্ছি না আমার ভালোবাসা, স্নেহ তারও অন্ত পাচ্ছি না তাদেরকে জানাবার। শ্রদ্ধা জানাবারও অন্ত পায় না। কারণ আমি জানি প্রীতির পাত্র যারা, তারা শ্রদ্ধার পাত্রও হতে পারে। স্নেহ, শ্রদ্ধা, প্রীতি এক সঙ্গেই যায় এই সমস্ত একত্র করে সমস্ত মন-প্রাণ ঢেলে আমি পুরনো পদ্ধতিতে আর্শীবাদ জানাই সকলের ওপরে, এখানে যারা উপস্থিত আছে তাদের সকলের প্রতি আমার আর্শীবাদ, সকলের প্রতি আমার ভালোবাসা এবং আমি আশা করি মনোয়ার যা করেছে, হয়তো সে দু-বছর পরে পরে হোক যাহোক এটা সে করবে অন্তত পক্ষে যতদিন পর্যন্ত তার পুরনো শিক্ষকরা বেঁচে আছে। কেননা মনোয়ার নিজেও তো এ রকম অনুষ্ঠান করবে। সবার প্রতি ওই আবার বললাম ধন্যবাদ টন্যবাদ জানাবো না, ভালোবাসা জানাই, স্নেহ জানাই, প্রীতি জানাই, শ্রদ্ধা জানাই।'

২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে হাসান আজিজুল হকের বক্তব্য।  


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি - dainik shiksha ষষ্ঠ-নবম শ্রেণিতে ষাণ্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের সূচি শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ - dainik shiksha অষ্টম পর্যন্ত অবৈতনিক শিক্ষায় সরকারকে সহযোগিতা করবে ইউএনএফপিএ ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র - dainik shiksha ইসরায়েলকে বোমা পাঠানো বন্ধ রাখছে যুক্তরাষ্ট্র ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে - dainik shiksha ভুইফোঁড় শিক্ষক সমিতি নেতাদের এমপিও বাতিল হতে পারে শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ - dainik shiksha শিক্ষার্থীদের জন্য পাঠ্যবইয়ের সংশোধনী প্রকাশ ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! - dainik shiksha ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের জাপান টিকিট ৩০ লাখ! জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল - dainik shiksha জাল সনদধারী শিক্ষকের এমপিও বাতিল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0027809143066406