ছেলের চেয়ারে বসলেন অশ্রুসিক্ত মা

নিজস্ব প্রতিবেদক |

প্রথম আলো কার্যালয়ে ছেলে মিজানুর রহমান খানের চেয়ারে বসেছিলেন তাঁর বৃদ্ধ মা নাসিমা বেগম। কোনো কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না তাঁর। সদ্য ছেলেকে হারানো মা পরম মমতায় ছুঁয়ে দেখছিলেন টেবিল, তাতে রাখা বিভিন্ন বইপত্র, কম্পিউটারের কি-বোর্ড। একসময় উঠে এল কান্নার দমক। তা সামলে কোনোমতে বললেন, ‘আমার ছেলে যদি কোনো অন্যায় করে থাকে তোমরা ক্ষমা করে দিয়ো।'

মায়ের এই আকুল আর্তি হৃদয় ছুঁয়ে গেল উপস্থিত সবার। সবার মুখেই এক কথা, ‘এ আপনি কী বলছেন! মিজানুর রহমান খানের মতো সহজ-সরল মানুষ হয় না। কোনো অন্যায় করার মানুষ তিনি নন।'

প্রথম আলোর সদ্য প্রয়াত যুগ্ম সম্পাদক মিজানুর রহমান খানের মা নাছিমা বেগম, বড় ছেলে শাদমান মিজানুর খান, মেয়ে আফসারা মিজানুর খান, ছোট ভাই ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাধারণ সম্পাদক দৈনিক ‘সমকাল’-এর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক মসিউর রহমান খান ও তাঁর স্ত্রী হাসনাত আরেফিন, মেয়ে আয়ানা, আরেক ভাইয়ের স্ত্রী সানজিদা খাতুন ও তাঁর ছেলে সাদিদ আজ বুধবার দুপুরে প্রথম আলোতে এসেছিলেন।

মিজানুর রহমান খানের মায়েরই আগ্রহ ছিল, ছেলে যেখানে কাজ করত সেই জায়গাটি একবার দেখার।

কারওয়ান বাজারে অবস্থিত প্রগতি ভবনের সপ্তম তলায় প্রথম আলোর সম্পাদকীয় বিভাগে মিজানুর রহমান খানের কাজের জায়গাটি ঠিক তেমনই আছে, যেমন তিনি রেখে গিয়েছিলেন। টেবিলে, পাশের ডেস্কে নানা রকমের বই, সাময়িকী, কাগজপত্র। পা রাখার জায়গায় তাঁর চপ্পল জোড়াও রয়ে গেছে— যেন তিনি ফিরে আসবেন যেকোনো সময়, বরাবর যেমন আসতেন। মা ছেলের সেই চপ্পল জোড়াতেও হাত বুলিয়ে ‘বাবা আমার বাবা’ বলে অস্ফুট আর্তি প্রকাশ করছিলেন।

এ সময় তাঁদের সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন প্রথম আলোর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক সাজ্জাদ শরিফ। তিনি তাঁদের বলেন, মিজানুর রহমান খানের লেখা, সাক্ষাৎকার, বিশেষ রিপোর্ট, আইন বিষয়ে নানা বিশ্লেষণ নিয়ে একটি গ্রন্থ প্রকাশের পরিকল্পনা করা হয়েছে। তাঁর একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবিও রাখা হবে ওঁনার কাজের জায়গায়।

প্রথম আলোর সহযোগী সম্পাদক সোহরাব হাসান, উপসম্পাদক এ কে এম জাকারিয়া, উপসম্পাদক লাজ্জাত এনাব মহছি, প্রশাসন বিভাগের প্রধান উৎপল চক্রবর্তী, জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক শরফুদ্দিন আহমেদসহ সহকর্মীরা উপস্থিত ছিলেন।

আইনে স্নাতক করে আইন পেশায় কাজ শুরু করতে প্রস্তুতি নিচ্ছেন মিজানুর রহমান খানের বড় ছেলে শাদমান। বাবার একান্ত ইচ্ছাতেই তাঁর আইন পড়া। তিনি জানালেন, এখন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেলের কার্যালয়ে যুক্ত থেকে কাজ করছেন। সম্প্রতি তিনি আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর করার জন্য একটি বিদেশি বৃত্তি পেয়েছেন। বাবাকে সেই সংবাদও দিতে পেরেছিলেন। শুনে তিনি বলেছিলেন ‘শাবাশ! শাবাশ’। শাদমান বললেন, ‘লাইসেন্সের পরীক্ষা দেব। ইচ্ছে ছিল বার সমিতির অনুমোদন পেলে সনদ নিয়ে এসে বাবাকে সালাম করব।’ কথা বলতে বলতে কান্নার দমকে আটকে যায় তাঁর কণ্ঠ।

মেয়ে আফসারা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে পড়ছেন। দ্বিতীয় বর্ষ শেষ হয়েছে। তিনি জানালেন, বাবা আইন পড়তে উৎসাহ দিয়েছিলেন। তবে বড় ভাই আইনে পড়ছে বলে তিনি স্থাপত্য পড়তে চেয়েছিলেন। বাবা তাতে আপত্তি করেননি। স্থপতিই হবেন তিনি।

চিকিৎসার দিনগুলোতে প্রথম আলো তাঁদের পরিবারের পাশে যেভাবে দাঁড়িয়ে নানা সহায়তা দিয়েছে, সেই বিষয়টি তুলে ধরেন ভাই মসিউর রহমান এবং পরিবারের অন্য সদস্যরা। প্রথম আলো কার্যালয়ে ঘণ্টা দুয়েক থেকে অশ্রুভেজা চোখে তাঁরা ফিরে যান।

মিজানুর রহমান খান করোনাভাইরাসে সংক্রমিত হয়েছিলেন। করোনার নমুনা পরীক্ষায় গত ২ ডিসেম্বর পজিটিভ রিপোর্ট আসে। গত ৫ ডিসেম্বর তিনি গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে ভর্তি হন। সেখান থেকে গত ১০ ডিসেম্বর তাঁকে ইউনিভার্সেল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হয়। তাঁকে কোভিড-১৯ জোনে রেখে চিকিৎসা দেওয়া হয়।

এরপর ১৫ ও ১৬ ডিসেম্বর আবার করোনার নমুনা পরীক্ষা করা হলে নেগেটিভ রিপোর্ট আসে। ৯ জানুয়ারি তাঁর অক্সিজেনের চাহিদা বাড়তে থাকে। ওই দিন বিকেল পৌনে পাঁচটায় তাঁকে ভেন্টিলেশন সাপোর্ট (কৃত্রিমভাবে শ্বাসপ্রশ্বাস) দেওয়া হয়। তাঁর রক্তচাপও কমে যায়। এর মধ্যেই সোমবার সোয়া পাঁচটায় হার্ট অ্যাটাক হয়। পরে সন্ধ্যা ৬টা ৫ মিনিটে তাঁকে মৃত ঘোষণা করা হয়। মঙ্গলবার মিরপুর শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে মিজানুর রহমান খানকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়।

সূত্র: প্রথম আলো। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি - dainik shiksha দেশে তিন দিনের হিট অ্যালার্ট জারি আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ - dainik shiksha আকাশে তিনটি ড্রোন ধ্বংস করেছে ইরান, ভিডিয়ো প্রকাশ অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন - dainik shiksha অভিভাবকদের চাপে শিক্ষার্থীরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে উঠছেন আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী - dainik shiksha আমি সরকার পরিচালনা করলে কৃষকদের ভর্তুকি দিবই: প্রধানমন্ত্রী বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি - dainik shiksha বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মামলা ১২ হাজারের বেশি শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে - dainik shiksha শিক্ষকদের অবসর সুবিধা সহজে পেতে কমিটি গঠন হচ্ছে শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ - dainik shiksha শিক্ষকদের শূন্যপদ দ্রুত পূরণের সুপারিশ ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল - dainik shiksha ইরানে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালালো ইসরায়েল কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0028059482574463