এ বছরের প্রথম ছয় মাসে দেশে অন্তত ১১৯ জন সাংবাদিককে নির্যাতন ও হয়রানি করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসের মানবাধিকার পরিস্থিতির পরিসংখ্যানগত প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
সংস্থাটির পর্যালোচনায় দেখা যায়, এ সময়কালে নারীর প্রতি সহিংসতা, বিশেষত ধর্ষণ, শিশু নির্যাতন, সাংবাদিক নির্যাতন, হয়রানি ও হত্যাসহ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। এছাড়াও বেআইনি আটকের অভিযোগ ও রহস্যজনক নিখোঁজ, নির্যাতন ও নিপীড়ন, সীমান্তে হত্যাসহ বহুল আলোচিত ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপপ্রয়োগের ঘটনা বেড়েছে। সোমবার গণমাধ্যমে পাঠানো আসকের বিবৃতিতে মানবাধিকার লঙ্ঘনের সংখ্যাগত প্রতিবেদনে (জানুয়ারি-জুন ২০২৩) এমনটি জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ছয় মাসে যৌন হয়রানি ও সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যা, পারিবারিক নির্যাতন, যৌতুকের জন্য নির্যাতন, গৃহকর্মী নির্যাতনসহ নারীর প্রতি সহিংসতার বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। যৌন হয়রানি কেন্দ্রিক সহিংসতার শিকার হয়েছেন ১৫৪ জন নারী-পুরুষ, যাদের মধ্যে হামলার শিকার হয়েছেন ৭৯ জন নারী ও ৭৫ জন পুরুষ। এর মধ্যে বখাটেদের হাতে লাঞ্ছিত হয়েছেন ৬১ জন, বখাটেদের উৎপাতকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আহত হয়েছেন ৭২ জন। যাদের মধ্যে যৌন হয়রানির কারণে ১০ জন নারী আত্মহত্যা করেছেন। যৌন হয়রানির প্রতিবাদ করতে গিয়ে বখাটের হাতে তিনজন হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ১ জন নারী ও ২ জন পুরুষ। ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ২৯৪ নারী। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে ২০ নারীকে। ধর্ষণের পর আত্মহত্যা করেছেন তিন নারী।
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয় মাসে ৬৬ নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা চালানো হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ২৫৩ জন নারী। এর মধ্যে ১৫৬ জন নারীকে হত্যা করা হয়েছে। পারিবারিক নির্যাতনের কারণে আত্মহত্যা করেছেন ৫৯ জন নারী। এছাড়া শারীরিকভাবে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৮ জন নারী। যৌতুককে কেন্দ্র করে নির্যাতনের শিকার হয়েছেন মোট ৭৪ জন নারী। যৌতুকের জন্য শারীরিক নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে ৩৪ জনকে এবং যৌতুকের কারণে নির্যাতনের শিকার হয়ে আত্মহত্যা করেছেন ৩ জন নারী। এর মধ্যে শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন ৩৭ জন। এ সময়কালে মোট ১৩ জন গৃহকর্মী বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। যাদের মধ্যে ৭ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এ বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ধর্ষণের তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, দেশের প্রায় সবকটি জেলায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। ঢাকায় সর্বাধিক ২৭টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে। এরপরই রয়েছে নারায়ণগঞ্জে ২২, চট্টগ্রামে ১৬ এবং বগুড়ায় ১৫।
আসক তাদের প্রতিবেদনে বলেছে, মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিরোধে আইনের শাসন ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা অত্যাবশ্যকীয়। অন্যথায় বিচারহীনতার সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায় এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনজনিত ঘটনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। আসক রাষ্ট্রের কাছে নাগরিকের সব ধরনের মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং ভুক্তভোগীদের ন্যায়বিচার দ্রুততার সঙ্গে নিশ্চিত করতে হবে।
শিশু নির্যাতন ও হত্যা
আসক জানায়, দেশের বিভিন্ন স্থানে গত ছয় মাসে ৮০৪টি শিশু বিভিন্ন ধরনের নির্যাতন ও হত্যার শিকার হয়েছে। এর মধ্যে হত্যার শিকার হয়েছে ১০৯টি শিশু এবং একটি ছেলে শিশুকে বলাৎকারের পর হত্যা করা হয়েছে। আত্মহত্যা করেছে ৪৫টি শিশু, বিভিন্ন সময়ে মোট ৮৭টি শিশুর মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে, রহস্যজনক মৃত্যু হয়েছে চার শিশুর। এছাড়া বলাৎকারের শিকার হয়েছে ২৭ ছেলে শিশু এবং বলাৎকারের চেষ্টা করা হয়েছে পাঁচটি শিশুকে।
সাংবাদিক নির্যাতন ও হয়রানি
মানবাধিকার পরিস্থিতি প্রতিবেদনে বলা হয়, ছয় মাসে ১১৯ জন সাংবাদিক বিভিন্নভাবে নির্যাতন, হয়রানি, হুমকি, মামলা ও পেশাগত কাজ করতে গিয়ে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। ঢাকায় ২৯ জন এবং চট্টগ্রাম ও কুমিল্লা জেলার প্রতিটিতে ৮ জন করে সাংবাদিক রয়েছেন। বাংলা নিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম ও ৭১ টিভির জামালপুর জেলা প্রতিনিধি সাংবাদিক গোলাম রব্বানী নাদিম গত ১৪ জুন রাতে তার পেশাগত দায়িত্ব শেষে বাড়ি ফেরার পথে একদল সন্ত্রাসী হামলা চালায় এবং ব্যাপক মারধর করে। চিকিৎসাধীন অবস্থায় গত ১৫ জুন তাঁর মৃত্যু হয়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা ও পেশাগত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে সাংবাদিকরা হামলা মামলার শিকার হচ্ছেন বলেও প্রতিবেদনে জানায় আসক। বিশেষত, প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে সিআইডি পরিচয়ে ভোর রাতে তুলে নিয়ে যাওয়া এবং দিনভর তাকে আটকের ঘটনা সংশ্লিষ্টদের পক্ষ থেকে অস্বীকার করার মধ্য দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায়োগিক আচরণ যে অসঙ্গত ও বেআইনি তা প্রতীয়মান হয়েছে। এ ধরনের অমানবিক আচরণের অভিযোগ সাতক্ষীরা জেলায় কর্মরত সাংবাদিক রঘুনাথ খাঁকে আটকের সময়ও পুলিশের বিরুদ্ধে উঠেছিল। রঘুনাথ খাঁকে আটকের পর পুলিশ দিনভর অস্বীকার করে প্রায় নয় ঘন্টা পরে একটি মামলায় গ্রেপ্তার দেখায়। এ সময়কালে প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের ঘটনা ঘটেছে। এর আগে আইনমন্ত্রীসহ সরকারের উচ্চপদস্থ ব্যক্তিরা সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা গ্রহণের পূর্বে বিশেষ সতর্কতা বজায় রাখার যে অঙ্গীকার করেছিলেন, তার প্রতিফলন এ ঘটনাসমূহের ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে না। বরং উচ্চপদস্থ ও দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের প্রথম আলোর প্রতিবেদক এবং সম্পাদক সম্পর্কে নানা মন্তব্য এ ধরনের মামলা দায়ের করতে অতি উৎসাহীদের অনুপ্রাণিত করছে বলে মনে হচ্ছে।
আসক বলছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে মৃত্যুর ঘটনা ছিল উদ্বেগজনক। এ বাহিনীর হেফাজতে চারজন এবং গুলিতে দুজনসহ ছয়জন নিহত হয়। এ সময়কালে র্যাবের হেফাজতে সুলতানা জেসমিনের মৃত্যুর ঘটনা ছিল বিদ্যমান আইন ও যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করার একটি অন্যতম উদাহরণ। ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনে দায়েরকৃত ২৪টি মামলা পর্যালোচনায় দেখা যায়, ২৪টি মামলায় মোট আসামির সংখ্যা ৬০। এর মধ্যে তাৎক্ষনিক গ্রেপ্তার হয়েছেন ২৬ জন। এই মামলাগুলোর মধ্যে প্রধানমন্ত্রীকে কটূক্তি করার দায়ে পাঁচটি মামলা রয়েছে, যেখানে আসামি করা হয়েছে পাঁচজনকে এবং তাৎক্ষণিকভাবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে চারজনকে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায় বিএসএফ-এর গুলিতে এ সময়ে কমপক্ষে ১০ জনসহ ১১ বাংলাদেশির মৃত্যু ঘটেছে এবং ১৪ জন আহত হয়েছে। ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বরে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার লক্ষ্য কার্যকরী উদ্যোগ হিসেবে সীমান্তের স্পর্শকাতর এলাকাগুলোয় রাতে যৌথ টহল পরিচালনার ব্যাপারে উভয়পক্ষ সম্মত হয়েছিল। এছাড়া আন্ত:সীমান্ত অপরাধ বন্ধের জন্য দুই বাহিনী পরস্পরের মধ্যে তাৎক্ষণিক ও প্রয়োজনীয় তথ্য আদান-প্রদান এবং প্রয়োজনে যৌথ অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে একমত হয়েছিল। এমনকি, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের জুলাইয়ে ঢাকায় সীমান্ত সম্মেলনে সীমান্তে হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার ব্যাপারে দুই দেশ পুনরায় একমত হওয়ার পরেও এ ধরনের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।
এ সময়কালে হাতকড়া ও ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় বাবা মায়ের জানাজায় অংশ নেওয়ার ঘটনা ঘটেছে শরীয়তপুর ও গাজীপুর জেলায়। বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৪ অনুচ্ছেদে স্পষ্টত বলা আছে, বিচার বা দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে কোনো ব্যক্তিকে যন্ত্রনা দেওয়া যাবে না, কিংবা নিষ্ঠুর অমানুষিক বা লাঞ্ছনাকর দন্ড দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি অভিযুক্ত ব্যক্তিকে ডান্ডাবেড়ি পরানো সংক্রান্ত উচ্চ আদালতের নির্দেশনারও ব্যত্যয় ঘটেছে।
রাজনৈতিক সহিংসতা
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, বছরের শুরুর ছয় মাসে স্থানীয় নির্বাচনসহ রাজনৈতিক সংঘাত ও সহিংসতা হয়ে ১৭৯টি। এতে নিহত হয়েছে ১৪ জন এবং আহত হয়েছেন প্রায় ২৪২২ জন। ঢাকা জেলায় মোট ৭টি ঘটনায় ১৯২ জন আহত হয়েছেন। অন্যদিকে বরিশাল জেলায় ১০টি ঘটনায় ১৩৯ জন আহত হয়েছেন। এরপর রয়েছে নারায়নগঞ্জ জেলা, যেখানে ৯টি ঘটনায় একজন নিহত এবং ১১৯ জন আহত হয়েছেন। রাজনৈতিক সহিংসতায় নরসিংদী জেলায় তিনজন নিহত হয়েছেন।
আসকের তথ্য মতে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ছয়জন নিহতের অভিযোগ উঠেছে। তাদের মধ্যে চারজন পুলিশের হাতে এবং দুজন র্যাবের হাতে নিহত হয় বলে গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ
আসকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাদা পোশাকধারী ব্যক্তিরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে ছয়জনকে অপহরণ করার খবর গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে পরবর্তী সময় ছয়জনকে বিভিন্ন অভিযোগে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বরাবরের মত এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে। এই ছয়জনকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক বেআইনি আটক এবং আটকের পর দেশের প্রচলিত আইন অনুসরণ না করে (২৪ ঘন্টার অধিক সময় পরে/ এমনকি কয়েকদিন পর্যন্ত হেফাজতে রেখে) গ্রেফতার দেখানো হয়েছে বলে স্বজনেরা অভিযোগ উত্থাপন করেছেন।
ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতন
বছরের এ সময়কালে পাঁচটি ঘটনায় হিন্দু সম্প্রদায়ের তিনটি বাড়িঘরসহ একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে দুর্বৃত্তদের হামলা হয়েছে। এছাড়াও ১৫টি প্রতিমা ভাঙচুর হয়েছে। পঞ্চগড়ে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় আহমদিয়া সম্প্রদায়ের একজন নিহত ও কমপক্ষে ৬২ জন আহত হয়েছে। এছাড়া আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উপস্থিতিতে কমপক্ষে ১০৩টি বাড়ির ২৫৯টি ঘরে ও ৩৩টি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে।
সীমান্ত সংঘাত
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফের গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ১১ বাংলাদেশি নাগরিক। এছাড়া আহত হয়েছেন ১৪ জন। জেলাওয়ারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বাধিক লালমনিরহাট জেলায় পাঁচজন নিহত ও চার আহত হয়েছেন।
কারা হেফাজতে মৃত্যু
আসক তাদের প্রতিবেদনে জানায়, এই সময়কালে কারা হেফাজতে মারা গেছেন ৫১ জন। এর মধ্যে কয়েদি ২৪ জন এবং হাজতি ২৭ জন। জেলাওয়ারি পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, সর্বাধিক ঢাকায় ৯ কয়েদি এবং ১১ হাজতির মৃত্যু হয়েছে। এরপর রয়েছে গাজীপুর জেলা, যেখানে আট কয়েদি এবং তিন হাজতির মৃত্যু হয়েছে।
গণপিটুনিতে নিহত
আসক জানায়, গত ছয় মাসে গণপিটুনির ঘটনায় নিহত হন মোট ২৪ জন। এর মধ্যে ঢাকা বিভাগে ১২ জন, চট্টগ্রাম বিভাগে ৯ জন, খুলনা বিভাগে ১ জন, বরিশাল বিভাগে ১ জন এবং ময়মনসিংহ বিভাগে ১ জন নিহত হয়েছেন।