পার্বত্য এলাকার জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার বিরুদ্ধে গত বছর অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একপর্যায়ে কুকি চিন ন্যাশনাল ফ্রন্টের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বম এবং জামাতুল আনসারের দ্বিতীয় আমিরসহ শুরা সদস্যরা শামিন মাহফুজকে প্রস্তাব দেন সবাই মিলে আত্মসমর্পণ করার। কিন্তু শামিনের বিরোধিতার কারণেই আত্মসমর্পণ থেকে বিরত থাকেন তাঁরা।
দুই সংগঠনের নেতাদের গোপন কথোপকথনের সূত্র ধরে এ তথ্য পেয়েছে কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
গতকাল শুক্রবার রাজধানীর ডেমরা এলাকা থেকে জামাতুল আনসারের প্রতিষ্ঠাতা শামিন মাহফুজ ও তাঁর স্ত্রীকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতারের বিষয়ে বিস্তারিত জানাতে আজ শনিবার ঢাকা মহানগর পুলিশের গণমাধ্যম ও জনসংযোগ বিভাগে এক সংবাদ সম্মেলনে আয়োজন করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে সিটিটিসির প্রধান মো.আসাদুজ্জামান বলেন, নাথান বম যখন আত্মসমর্পণের প্রস্তাব দেন, সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে শামিন বলেন, ওরা আক্রমণ করলে (আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী) ওদের এমন ধাওয়া করবেন, যাতে কেউ পালিয়ে যেতে না পারে।
আসাদুজ্জামান বলেন, শামিনের কাছ থেকে একটি মোবাইল জব্দ করা হয়েছে। তাতে দুই সংগঠনেরই অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পাওয়া গেছে, যা পরবর্তী জঙ্গি অভিযানে পুলিশের কাজে লাগবে। তিনি বলেন, শামিন ছাত্রজীবন থেকেই অত্যন্ত মেধাবী ছিলেন। শামিন তাঁর বড় ভাইয়ের ছেলের মাধ্যমে জঙ্গিবাদের জড়িয়ে পড়েন। তিনি রংপুরে স্কুলে পড়ার সময় ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েন। এ কারণে স্কুল থেকে বহিষ্কার করা হয়। পরে তিনি একটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দেন। এইচএসসি পরীক্ষায় রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের মধ্যে তিনি সপ্তম স্থান অধিকার করেন। এসএসসি পরীক্ষায় অধিকার করেছিলেন পঞ্চম স্থান।
সংবাদ সম্মেলনে আসাদুজ্জামান বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পড়ার সময় নাথান বমের সঙ্গে পরিচয় শামিনের। নাথান বমের সঙ্গে তিনি একাধিকবার পাহাড়ে বেড়াতেও যান।
শামিনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে বরাত দিয়ে সিটিটিসির পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, জামাতুল আনসারের আগেও শামীম আরেকটি জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে গ্রেফতার হয়েছিলেন। গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন বেশ কিছুদিন। কারাগারে থাকা অবস্থায় বিভিন্ন নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি, হুজি, আনসারুল ইসলামের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, শামিন কারাগারে বসেই কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন মিলে একটি নতুন সংগঠন করার বিষয়ে পরিকল্পনা নেন। ২০১৮ খ্রিষ্টাব্দে জামিনে এসে পাহাড়ে ক্যাম্পের অবকাঠামো তৈরির কাজ শুরু করেন শামিন। এ সময় মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি, আনিসুর রহমান ওরফে তমাল, মোশারফ হোসেন ওরফে জনি ওরফে রাকিব, মাশুকুর রহমান ওরফে রণবীর ওরফে বিকাশের সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ হয়। কারাগারে পরিকল্পনা অনুযায়ী ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে কক্সবাজারের একটি হোটেলে বসে কুকি চিনের সঙ্গে সমঝোতা হয় শামিনের। সেই চুক্তিপত্রটিও লিখেছিলেন শামিন। ওই চুক্তিতে কুকি চিনের পক্ষে স্বাক্ষর করেন নাথান বম। শামিনের হাতের লেখা সেই চুক্তিপত্র ও উদ্ধার করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দে পাহাড়ের ওই ক্যাম্পে বসেই সংগঠনের নাম দেওয়া হয় জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়া। শামিন এই সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা সমন্বয়ক। পাশাপাশি তিনি কুকি চিনের প্রতিষ্ঠাতা নাথান বমের উপদেষ্টা হিসেবেও কাজ করতেন।
সংবাদ সম্মেলনের তথ্য অনুযায়ী, পড়াশোনা শেষ করে শামিন কিছুদিন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকতা করেছেন। পরে তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন নিয়ে পিএইচডি শুরু করেন। এই পড়াশোনার আড়ালে তিনি পাহাড়ে এই জঙ্গি প্রশিক্ষণের ক্যাম্প গড়ে তোলেন। সেখানেই জঙ্গিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। সমঝোতা স্বাক্ষর অনুযায়ী পাহাড়ে ক্যাম্প স্থাপন ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে নাথান বম জঙ্গি সংগঠনকে সহযোগিতা করবেন। প্রথম পর্যায়ে এই জঙ্গি সংগঠনের ক্যাম্প ছিল বান্দরবান জেলার রুমা থানার রেমাক্রির একটি পাহাড়ে। পরে ক্যাম্পটি বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়ি এলাকায় সরিয়ে নেয়া হয়।
সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, নতুন এই সংগঠনের বিষয়টি প্রথম আলোচনায় আসে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে। ওই মাসে সিলেট থেকে একসঙ্গে সাতজন নিখোঁজ হন। এরপরে কুমিল্লা থেকেও একযোগে বেশ কিছু তরুণ নিখোঁজ হন। এরপর পাহাড়ে অভিযান শুরু করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
গ্রেফতার শামিনের স্ত্রী প্রসঙ্গে সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তিনি এই সংগঠনের নারী সদস্যদের নেত্রী। একসময় তিনি আনসার আল ইসলামের প্রধান নেতা ইজাজ কারগিলের দ্বিতীয় স্ত্রী ছিলেন। ইজাজ কারগিল পাকিস্তানে ড্রোন হামলায় নিহত হন।
সিটিটিসির প্রধান জানান, জামাতুল আনসারের প্রথম আমির ছিলেন মাইনুল ইসলাম ওরফে রক্সি। দ্বিতীয় আমির হিসেবে কাজ করেন আনিসুর রহমান মাহমুদ ওরফে তমাল এবং নায়েবে আমির ছিলেন মহিবুল্লাহ ওরফে ভোলার শায়েখ। জঙ্গি সংগঠনের দাওয়াতি শাখার প্রধান ও প্রথম শুরা সদস্য ছিলেন ডাক্তার শাকির বিন ওয়ালি, অর্থ বিভাগের প্রধান ও দ্বিতীয় সদস্য ছিলেন মোশারফ হোসেন ওরফে জনি। এ ছাড়া সামরিক বিভাগের প্রধান ও তৃতীয় শুরা সদস্য ছিলেন মাসুদুর রহমান ও দাওয়াতি শাখার উপপ্রধান ও চতুর্থ শুরা সদস্য ছিলেন আবদুল্লাহ মায়মুন।