জন্মদিনে প্রণতি গুরুদেব, অঞ্জলি লহ মোর

দুলাল আচার্য |

সাংবাদিকতার নানা ধাপ পেরিয়ে তিনি আজ আলোকিত মানুষ। ছাত্ররাজনীতি দিয়ে তারুণ্যের প্রকাশ ঘটলেও এখন তাঁর মূল পরিচয় সাংবাদিক। তাঁর অনেক গুণের মধ্যে অন্যতম হলো বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি প্রবল অনুরাগ, যার প্রকাশ ঘটছে সাংবাদিকতার লেখনীতে। উদার, মানবিক, স্বচ্ছ ও সংস্কারমুক্ত মানুষটির আজ ৬৭তম শুভ জন্মদিন। শারীরিক বয়স বেড়েছে; কিন্তু মননে, কর্মনিষ্ঠায় ও মানসিকতায় তিনি এখনো তারুণ্যদীপ্ত। ১৯৫৮ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে জন্ম তাঁর। তিনি জাফর ওয়াজেদ। সাংবাদিক, কবি, সংগঠক, সুবক্তা, অনুসন্ধানী পাঠক, প্রতিশ্রুতিশীল লেখক- নানা অভিধায় তাঁকে অভিহিত করা যায়। জন্ম বাংলাদেশের একটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে, কিন্তু কর্মপরিধি দেশজুড়ে। শিক্ষাজীবন শেষ করে সাংবাদিকতায় প্রবেশ তাঁর। 

জাফর ওয়াজেদ

কর্মজীবনে দৈনিক সংবাদের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক, বাংলাবাজার পত্রিকা ও দৈনিক মুক্তকণ্ঠের প্রধান প্রতিবেদক এবং দৈনিক জনকণ্ঠের সহকারী সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। একসময় সাংবাদিক নেতা হিসেবে সাংগঠনিক নেতৃত্বে ছিলেন তিনি। ছিলেন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সহ-সভাপতি ও ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সহ-সভাপতি। পালন করেছেন বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বও। ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি (১৯৮০-১৯৮১), বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য (১৯৮০-১৯৮২) এবং গ্রন্থনা ও প্রকাশনা সহ-সম্পাদক (১৯৮৪-১৯৮৬), বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সম্পাদনা পরিষদ সদস্য (১৯৮৩-১৯৮৫), আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সম্মেলন সাংস্কৃতিক উপ-পরিষদের সদস্য সচিব (১৯৮৬), আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সম্মেলন প্রচার ও প্রকাশনা উপ-পরিষদের সদস্য সচিব (১৯৮৬)। এছাড়া ‘পেন্ডুলাম’, ‘নক্ষত্রবীথি’, ‘মন্তব্য’, ‘বারুদ’সহ বহু সাহিত্য সাময়িকী সম্পাদনা করেছেন। তিনি শিশু-কিশোর সংগঠন চাঁদের হাটের কেন্দ্রীয় কমিটিতে কাজ করেছেন।

পঁচাত্তর-পরবর্তী রাজনীতির অন্ধকার সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুজিববাদী ছাত্রলীগের অগ্রভাগে ছিলেন একঝাঁক তরুণ ছাত্রনেতা। যাদের তেজোদীপ্ত কণ্ঠ প্রতিবাদে মুখরিত ছিলো জাতির পিতার হত্যাকারীদের বিরুদ্ধে। সেই সম্মুখসারির একজন জাফর ওয়াজেদ। একদিকে স্বৈরনায়ক জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসন অন্যদিকে শাসক মদদপুষ্ট কথিত প্রতিবিপ্লবীদের দুবৃর্ত্তায়ন। এমন এক প্রতিকূল সময়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন একজন প্রতিরোধযোদ্ধার মতো। এই প্রতিরোধ সশস্ত্র নয়, প্রতিরোধের ভাষা ছিল শিল্প-সাহিত্য। প্রতিরোধের অস্ত্র ছিলো কবিতা, গান, সভা-সেমিনার। যে সময় মিডিয়ায় ‘বঙ্গবন্ধু’ শব্দটি নিষিদ্ধপ্রায়, যখন সামরিক শাসকের কোপানলে মুজিবপ্রেমীরা, সেই ক্লান্তিকালে জাফর ওয়াজেদ লিখেন ‘ঘরে ঘরে শেখ মুজিব’ শিরোনামের কবিতা।

‘আজও বাংলার ঘরে ঘরে শেখ মুজিবের রক্তের দাগ 
আজও বুকের ক্ষতে দাউ দাউ জ্বলে ওঠে বীভৎস কালো রাত
করুণ বিনাশে অপচয়ের ক্লান্ত ইতিহাস ভাঙে ক্রন্দন ক্ষোভ
আমাদের জীবনের সব সংগ্রামে ভাসে সাহসী মুজিবের মুখ।’

কবিতার এই সাহসী উচ্চারণ সে সময়কার তরুণ সমাজকে প্রতিবাদের সাহস জুগিয়েছে। তার এই দীর্ঘ সংগ্রামের পথে নানা বাধা এসেছে। সাম্প্রদায়িক শক্তির কোপানলে পড়েছেন বহুবার। বিশেষ করে স্বাধীনতাবিরোধী জামায়াত-শিবির প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের। নানা সময়ে বিশেষ করে সাংবাদিকতা পেশায় এসে হাতের কবজি কেটে নেয়াসহ তার জীবননাশের চেষ্টাও হয়। তারপরও থেমে থাকেনি তার কলম, তার এই পথচলা। 

তাঁর মূল নাম আলী ওয়াজেদ জাফর (জাফর ওয়াজেদ নামে সবাই তাকে চেনেন)। জাফর ওয়াজেদ কুমিল্লা জেলার দাউদকান্দি উপজেলার ইলিয়টগঞ্জে নানাবাড়িতে জন্ম গ্রহণ করেন। পৈতৃক নিবাস একই জেলার চান্দিনা উপজেলার মহিচাইল ইউনিয়নের জোড়পুকুরিয়া গ্রামে। অধ্যক্ষ আছমত আলী ও মোসাম্মৎ রোকেয়া বেগম দম্পতির সাত সন্তানের মধ্যে জাফর ওয়াজেদ ষষ্ঠ। তিনি বাংলা সাহিত্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। শিক্ষার্থী থাকাবস্থায় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের (ডাকসু) সাহিত্যবিষয়ক সম্পাদক ছিলেন।

বর্তমানে তিনি প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ (পিআইবি)-এর মহাপরিচালক। ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার তাকে এই পদে নিয়োগ দেয়। সম্প্রতি টানা ৪র্থ মেয়াদের জন্য তিনি পিআইবির মহাপরিচালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সাংবাদিকতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার তাঁকে ২০২০ খ্রিষ্টাব্দে একুশে পদকে ভূষিত করে। ব্যক্তিগত জীবনে জাফর ওয়াজেদ স্ত্রী দিলশান আরা এবং দুই কন্যা অ্যালমা ও আহেলীকে নিয়ে সুখের সংসার।

আমার মতো অসংখ্য সাংবাদিকের শিক্ষাগুরু তিনি। একজন ভক্ত ও অনুরাগী হিসেবে তার সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে। কর্মক্ষেত্রে এসে তাকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ হয় আমার। নব্বইয়ের দশকের শেষদিকে শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় কাজ করতে গিয়ে লেখালেখির সূত্রে তার সান্নিধ্য পাই। পরে দৈনিক জনকণ্ঠে সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করতে গিয়ে সহকর্মী হিসেবে ব্যক্তিগত সম্পর্কের পরিধির বন্ধন আরো সুদৃঢ় হয়। বলা চলে, এখন ঢাকায় আমার অন্যতম অভিভাবক তিনি। 

অসংখ্য কলাম, কবিতা, গান লেখার পাশাপাশি কয়েকটি গ্রন্থের প্রণেতা তিনি। সম্প্রতি মত ও পথ প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত ‘ভুবনজোড়া শেখ হাসিনার আসনখানি’ শিরোনামের একটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে তার। গ্রন্থটির বেশির ভাগ লেখা বিভিন্ন সময়ে দৈনিক জনকণ্ঠে কলাম আকারে প্রকাশিত হয়। দৈনিক জনকণ্ঠের সম্পাদকীয় বিভাগে কাজ করার সুবাদে এই লেখাগুলোর সম্পাদনা ও প্রকাশে আমার সক্রিয় ভূমিকা ছিলো। এসব লেখা সম্পাদনা করতে গিয়ে আমার নিজের লেখালেখির পরিধিও সম্প্রসারিত হয়। এতে নিজেকে পরিপক্ব করার সুযোগ হয়েছিলো আমার। সহজ করে বললে আমার লেখালেখির প্রেরণার জাফর ওয়াজেদ। এখনো শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধু এবং মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তার অসংখ্য লেখা রয়েছে, যা দিয়ে আরো কয়েকটি গ্রন্থ প্রকাশের সুযোগ রয়েছে। 

বঙ্গবন্ধুর সম্প্রীতি তথা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তার কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সে পথের একজন সেনাপতির কাজ করছেন জাফর ওয়াজেদ। আর সেই বিশ্বাসের পথে আমার মতো একজন ক্ষুদ্র সৈনিকের পথচলা তার হাত ধরে। তার এই পথচলা আরো মসৃণ ও সুদৃঢ় হোক। শতায়ু হোন জাফর ওয়াজেদ। জন্মদিনে প্রণতি গুরুদেব, অঞ্জলি লহ মোর।

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর - dainik shiksha শিক্ষক লাঞ্ছিত ও পদত্যাগে বাধ্য করার প্রতিবাদ, কঠোর কর্মসূচির হুঁশিয়ারি বিটিএর মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি - dainik shiksha মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণের দাবি আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী - dainik shiksha আন্দোলনে অসুস্থ ১১ নার্সিং শিক্ষার্থী প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই - dainik shiksha প্রধান শিক্ষককে জোর করে পদত্যাগপত্রে সই জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে - dainik shiksha জলবায়ু পরিবর্তন মারাত্মক প্রভাব ফেলছে শিক্ষা খাতে বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ - dainik shiksha বয়স ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে চাকরি প্রত্যাশীদের মহাসমাবেশ এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য - dainik shiksha এমপিওভুক্তি: দীপু মনির ভাই টিপুচক্রের শতকোটি টাকার বাণিজ্য অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা - dainik shiksha অধ্যক্ষকে পদত্যাগে বাধ্য, আওয়ামী লীগ নেতাকে স্থলাভিষিক্ত করার চেষ্টা ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর - dainik shiksha ভুয়া নিয়োগে এমপিও: এক মাদরাসার ১৫ শিক্ষকের সনদ যাচাই করবে অধিদপ্তর বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন - dainik shiksha বার্ষিক পরীক্ষার উদ্দীপকসহ ও উদ্দীপক ছাড়া প্রশ্ন একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী - dainik shiksha একসঙ্গে তিন প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন তুলতেন মাদরাসা কর্মচারী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0026960372924805