অকূল জলরাশির মধ্যে মধ্যে ছবির মতো একেকটি গ্রাম। দেখলে মনে হবে যেনো অথৈ পাথারে ভাসছে একগুচ্ছ কচুরিপানা। দিগন্তজোড়া নীল জল আর দূরে দৃষ্টি মিললেই চোখের সীমানায় জলরাশি ঘিরে দেয়ালের মতো ঠায় দাঁড়িয়ে মেঘালয় পর্বতমালা। বলছি পর্যটনের অপার সম্ভাবনাময় টাঙ্গুয়ার হাওরের কথা। এ হাওরের মনোহর দৃশ্যে মন কাড়বে ঠিকই তবে একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে হাওরবাসীর জল জীবনের দুঃখগাঁথা। বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে ছবির মতো গ্রামগুলো খালি চোখে দেখতে সুন্দর। কিন্তু সেখানকার মানুষের জীবন কষ্টের। বাজার-সদাই থেকে শুরু করে চিকিৎসা-শিক্ষা সবকিছুর জন্যেই পাড়ি দিতে হয় অথৈ জল। আর এতে তাদের একমাত্র বাহন হলো ডিঙি। এক কথায় ডাঙার জীবন নির্ভর ছোট্ট ডিঙির ওপর।
হাওরবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে তাদের দুঃখে ভরা জীবনের কাহিনি। বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামের দূরত্ব যেমন অনেক আবার গ্রামগুলো থেকে মফস্বলের ঠিকানাও বহুদূর, শহর তো সুদূর পরাহত। তাই কোনো গ্রামের কেউ হঠাৎ অসুস্থ হলে পল্লী চিকিৎসকের ওপরেই নির্ভর করতে হয়। কারণ, হাসপাতালে পৌঁছাতে তাকে ডিঙিতে করেই পাড়ি দিতে হয় কয়েক ঘণ্টার জলের পথ। আর এতে পথেই অনেকের জীবনাবসান ঘটে। সুনামগঞ্জের মধ্যপাড়া বাজারটিও পানিবেষ্টিত একটি দ্বীপ।
এ হাটে কথা হয় ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেল চালক হুমায়ুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, কেউ অসুস্থ হলে কয়েক মাইল পথ ডিঙিতে চড়ে কোনো দ্বীপ বাজারে নিয়ে আসা হয়। সেখানে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পাঠানো হয় জেলা সদরে। এতে যে সময় ক্ষেপণ এবং রোগীকে যতো ঝক্কি-ঝামেলা পোহাতে হয় এতেই অনেক রোগী মারা যান। সুচিকিৎসা জোটে না আমাদের কপালে। তার কথায় উঠে আসে হাওরের বিভিন্ন কুসংস্কারের কথা। চিকিৎসায় ওঝা-বৈদ্য থেকে শুরু করে মঙ্গল কামনায় দরগায় শিরনি দেয়ার কথাও। বসন্ত রোগ থেকে মুক্তি পেতে কলা গাছের পাতায় বিন্নি ধানে ভাজা খৈ জলে ভাসিয়ে দেয়ার কথাও।শুধু চিকিৎসা নয় বেঁচে থাকার তাগিদে বাজার-সদাইয়ের জন্যও প্রতিনিয়ত জলের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হয় তাদের। কয়েক গ্রাম পর পর গ্রাম্য বাজারে মিলে তাদের খোরাকের চাল-ডাল-সবজি। সবাই ডিঙিতে চড়েই সদাই করতে হাটে যায়। আর সওদাগরেরাও বড় বজরায় জিনিসপত্র নিয়ে হাটে আসেন। এভাবেই চলে তাদের জীবন।
আধুনিক জীবনের ছোঁয়া বঞ্চিত হাওরবাসীকে শিক্ষার জন্যও নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। ছোট্ট ডিঙিতে চড়ে কয়েক মাইল পথ পাড়ি দিতে হয় স্কুল-কলেজ পড়ুয়াদের। আর যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা একটু ভালো তাদের ছেলেমেয়েরা শহরে পড়ালেখা করে। তবে অনেকের ভাগ্যেই জোটে না শহরের বড় কলেজে পড়ার ভাগ্য। তাই মাঝপথেই লেখাপড়ায় ক্ষান্ত দিয়ে নেমে পড়েন পূর্ব পুরুষের দেখানো পথে উপার্জনের খোঁজে। হাওরে যাতায়াতের একমাত্র বাহন ডিঙি বা বজরা। বিয়ে থেকে শুরু করে আত্মীয়ের বাড়ি বেড়াতে গেলেও ভরসা এ নৌকা। দূরের পথে পাড়ি দিতে দিতে মাঝি গান ধরেন ‘তরী ভাট্যায় পথ আর উজান না/মন মাঝি তোর বৈঠা নেরে/আমি আর বাইতে পারলাম না’।
হাওরবাসীর জীবনও মূলত জলের ওপর ভাসে। এ জলেই তাদের জীবিকা। অর্ধেক বছর চলে মাছ ধরে বাকি বছর চলে চাষে। বৃষ্টির মওসুমে হাওরে পানি থাকে কূলে কূলে ভরা। তখন জালে ধরা পড়ে বিভিন্ন প্রজাতির নানা স্বাদের মাছ। শহরের মানুষের কাছে স্বাদু পানির মাছের চাহিদা বাড়তি থাকায় তারা ভালো দামও পান। আবার এই পানিই মাঝেমধ্যে ফুসে উঠে তাদের ভাসিয়ে নিয়ে যায়। বন্যার সময় তাদের জীবন বর্ণনাতীত কষ্টের। সরকারি সহায়তা পৌঁছায় তবে তা নগণ্য। হেমন্তে হাওরের জলে টান ধরে। শুকাতে থাকে জল আর জেগে ওঠে দিগন্ত জোড়া মাঠ। এরপর হাওরবাসীর ব্যস্ততা বেড়ে যায়। মাঠ প্রস্তুত করে সারা বছরের খোরাক জোগাতে ধান লাগানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন নারী-পুরুষ সবাই।
ট্যাকের ঘাটের মাঝি আশরাফুল জানান, বিস্তীর্ণ হাওরে সবারই কমবেশি জমি আছে। আর এ ধানেই চলে তাদের সারা বছর। কয়েক মাসের ঘাম ঝরানো প্রচেষ্টায় এক সময় ঘরে ওঠে সোনালী ধান। পাকা ধানের মৌ মৌ গন্ধে ভরে ওঠে পাড়া। এভাবে মাছ আর ধানে জীবিকা চলে হাওরবাসীর। আবার পানি ওঠে হাওরে। জলে ভরে যায় চারপাশ। গভীর রাতে ধান ভানতে ভানতে হাজার বছর ধরে উপন্যাসের আম্বিয়ার মতো কোনো গৃহবধূ গান ধরেন ‘কাদা দিলি সাদা কাপড়ে/কলসি-দড়ি গলায় বেঁধে মরব ডুবে কোন পুকুরে...।
লেখক: প্রভাষক, ঢাকা রেসিডেনসিয়াল মডেল কলেজ