বিংশ শতকে সাহিত্য গগনে/উঠেছিলো এক রবি, মরমী চেতনায় স্ফুরিত/পল্লী বাংলার কবি।
জসিমউদ্দীনকে আমরা সবাই পল্লী কবি হিসেবে জানি। গ্রাম বাংলা এবং লোকজ সংস্কৃতি তার কাব্যের প্রাণ। কিন্তু তার কাব্যে মরমীবাদ, সুফীবাদ, আধ্যাত্মবাদ এবং ইসলামী উপজীব্য কতোটা প্রভাব বিস্তার করেছিলো সে বিষয়ে খুব কমই জানি। আজকের আলোচনায় সে বিষয়ে কিছুটা আলোকপাত করার চেষ্টা করবো। বাল্যকাল থেকেই পল্লী কবির তাম্বুলখানা গ্রামে আমার যাতায়াত ছিলো। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে আধাঘন্টার পথ তাম্বুলখানা।
কবির বাড়ি দর্শনে প্রতিদিনই মানুষের ভিড় লেগে থাকে। অনেকে যায় সময় কাটাতে, কেউ যায় বিনোদন খুঁজতে, কেউ যায় গবেষণার উপাদান সংগ্রহে, আবার কেউ যায় তার কাব্য প্রেমে পড়ে। আমি চেষ্টা করেছি তার কাব্যের বহমাত্রিক উপজীব্য খুঁজে বের করতে। জসিমউদ্দীনের কাব্যে লালনের মরমীবাদের ছাপ স্পষ্ট। মরমী প্রেমতত্ত্ব, মিস্টিসিজম, অতিন্দ্রীয় ভাববাদ, অধিবিদ্যক উপমা, নান্দনিক অলংকরণ তার কাব্য দর্শনকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। কাজী নজরুলের ইসলামী গান ও গজল দ্বারা জসিমউদ্দীন ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন যেটার প্রমাণ মিলে জসিমউদ্দীনের জারি, সারি ও মুর্শিদী গানে। প্রথমেই আসি জসিমউদ্দীনের মাস্টারপিস ‘কবর’ কবিতা প্রসঙ্গে। এই কবিতায় একজন বৃদ্ধ কিভাবে তার আপনজনকে পর্যায়ক্রমিক হারান এবং এক পর্যায়ে তিনি বিমর্ষ হয়ে পড়েন শোকে। তিনি ভাবতে থাকেন তিনি আর এত শোক নিতে পারছেন না। তিনি এটাও ভাবেন যে তার জীবন যেনো কেয়ামত। তিনি তার নাতিকে খোদার নিকট মোনাজাত করতে আহবান জানান। আল্লাহর করুণা ভিক্ষা চান।
‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে/ অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে/ মজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর/ মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর/ জোড়হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা! রহমান/ ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু- ব্যথিত প্রাণ।’
জসিমউদ্দীনের কবিতার এই পঙতিতে বেশ কিছু শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে যেগুলো ইসলামী উপজীব্যের অন্তর্ভুক্ত। মজিদ ( মসজিদ), আযান, কেয়ামত, মোনাজাত, খোদা, রহমান, ভেস্ত ( বেহেস্ত), নসিব ইত্যাদি শব্দগুলি ইসলামী জীবনবোধের সাথে গভীরভাবে যুক্ত। তাছাড়াও বৃদ্ধের যে বুকফাটা আর্তনাদ সেটাও ইসলামী রীতিতে প্রতিপাদিত।
কাজী নজরুলের সঙ্গে জসিমউদ্দীনের একটি আত্মিক যোগাযোগ ছিলো। নজরুল জসিমউদ্দীনের তাম্বুলখানার বাড়িতে গিয়েছেন, সাহিত্য আসর করেছেন। নজরুলের ইসলামী গজলের ভূয়সী প্রসংশা করেছেন জসিমউদ্দীন। নজরুল কবি জসিমউদ্দীনকে একটি কবিতা লিখে উপহারও দিয়েছিলেন। জসিমউদ্দীন সেটা হারিয়ে ফেলেন। স্মৃতিচারণ করে নজরুল লিখেন, ‘আকাশেতে একলা দোলে একাদশীর চাঁদ, নদীর তীরে ডিঙি তরী পথিক ধরা ফাঁদ।’
কবি নজরুলের জন্ম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে আর জসিমউদ্দীনের জন্ম ১৯০৩ খ্রিষ্টাব্দে। আব্দুল মান্নান সৈয়দ লিখেন- তারা দুজনে দূরে বাস করলেও তারা ধন্য হয়েছেন একালের মুসলমান সমাজের অন্তরে। উপমহাদেশে ইসলামী সাহিত্যের বিকাশে এরা দুজনেই বহুমাত্রিক অবদান রেখেছেন। জসিমউদ্দীনের কবিতায় আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য লক্ষনীয়। ‘দর্গা তলা দুগ্ধে ভাসে, সিন্নী আসে ভারে; নৈলা গানের ঝংকারে গাঁও কান্দে বারে বারে’। --- ( নক্সীকাথাঁর মাঠ)। কবি জসিমউদ্দীন লেখাপড়া করেছেন কলকাতায়। বহু সংস্কৃতির সানিধ্যে তিনি এসেছিলেন। তার কাব্যে ইসলামী উপাদান এক বিশেষ স্থান জুড়ে আছে। ‘ওগো কল্যাণী! কহ কহ তুমি কেবা দরবেশ, তোমার লাগিয়া মন-মোমবাতি পুড়ায়ে করিলো শেষ।’ ( রূপবতী)
কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যের মূল উৎস গ্রাম বাংলার লোকজ সংস্কৃতি, রীতিনীতি। বাংলাদেশের বেশিরভাগ মানুষ মুসলিম। তাই তাদের সংস্কৃতিতে ইসলামের ব্যাপক প্রভাব দৃশ্যমান। মানস কবি জসীমউদ্দীন ইসলামী উপমা প্রয়োগে মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন। তার আখ্যান কাব্যের মূল উপাদান লোকজ থেকে নেয়া। কাহিনী বিন্যাসে, ভাষা ব্যবহারে, শব্দ চয়নে, উপমা চিত্রকল্পে, লোককাব্যে, পুথিঁ সাহিত্যে মরমীবাদের ছাপ স্পষ্ট। জসীমউদ্দীনের কাব্যে সম্প্রতির পরিচয় অনেক গভীরে। হিন্দু মুসলমানদের একত্রে বসবাস, এদের দ্বন্দ্ব সংঘাতকে ঘৃণা করে নিরপেক্ষ থেকেছেন। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী কবি লিখেন- ‘এক গেরামের গাছের তলায় ঘর বেঁধেছি সবাই মিলে, মাথার ওপর একই আকাশ ভাসছে রঙের নীলে।’ ( সোজন বাদিয়ার ঘাট)। জসীমউদ্দীনের এই কাব্যিক চরণগুলো লালনের সেই সাম্যবাদী চেতনাকে স্মরণ করে দেয়- ‘হিন্দু খ্রিষ্টান আর মুসলমান, রক্তে বর্ণে নেই ব্যবধান।’
জসীমউদ্দীন তার কাব্যে গ্রামীন জনপদ, গ্রামের মানুষের জীবন, তাদের সংস্কৃতি, তাদের দর্শন, তাদের ধর্ম, তাদের বিশ্বাসসহ সব কিছুকে নান্দনিকতায় ফুটিয়ে তুলেছেন। তার কাব্যের আলোচনার মানুষগুলোর বেশিরভাগ মুসলিম। তারা ইসলামী ভাবাদর্শে বিশ্বাসী। খোদায় ভক্তি, ইহকাল, পরকাল, মরমীচেতনা, ইসলামী সংস্কৃতি তাদের জীবন চলার প্রধান নির্দেশনা। কবি জসীমউদ্দীন সেগুলোই তার কাব্যে তুলে ধরেছেন উপমা দিয়ে, অলংকরণ করে।
প্রকারান্তরে তার কাব্যের বিষয়গুলো ইসলামী ভাবধারাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। কবি জসীমউদ্দীন তার প্রেমকাব্য সাজিয়েছেন বৈষ্ণব, বাউল আর মরমীবাদের আলোকে। তার বালুচর কাব্য ১৭ টি কবিতা নিয়ে প্রকাশিত হয়। এই কবিতাগুলোতে তার দৃষ্টিভঙ্গি অন্তর্মুখী মনে হয়েছে। এক ধরনের ঐন্দ্রিক ভাবতত্ত্বের গন্ধ পাওয়া যায় তার কাব্যে। দুর্বিসহ যাতনা ভোগ করেও যে প্রেম নিঃস্বার্থ হওয়ার মন্ত্র শেখায়, সে প্রেম যেনো তার কাব্যকে আলোকিত করেছে। তার কাব্যে আধুনিক পরাবাস্তবতার দৃশ্য অনুপস্থিত। বরং মরমী ও সুফী সাধকের মত তিনি চরিত্রায়ন করেছেন। বালুচরের অনেক কবিতা ত্রিপদী ছন্দে লেখা হয়েছে। ইসলামী কাব্যে ত্রিপদী ছন্দ বেশ জনপ্রিয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, জসীমউদ্দীনের এই ছন্দে ইসলামী কাব্যের ছন্দের প্রভাব রয়েছে। ‘বাঁশরী আমার হারায়ে গিয়াছে বালুর চরে, কেমনে ফিরিব গোধন লইয়া গাঁয়ের ঘরে?’
কবি জসীমউদ্দীনের কাব্যে যে প্রেমের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা সাধারণ প্রেম নয়, লোকজ প্রেমও নয়, প্রেম- ভাবনার ক্ষেত্রে কবি বেছে নিয়েছেন বাংলার ধর্ম ভিত্তিক প্রেম সাধনা। যুগ যুগ ধরে সেই প্রেমই উঠে এসেছে তার কাব্যে। তার প্রতিদান কবিতায় ফুটে উঠে উদার প্রেমের অমিয়বানী—‘আমার এ ঘর ভাঙ্গিয়াছে যেবা, আমি বাঁধি তার ঘর/ আপন করিতে কাঁদিয়া বেড়াই যে মোরে করেছে পর।’
ইসলামী নৈতিকতার সৌহার্দ্য আর মর্মবাণী যেনো কবির কবিতা জুড়ে। যে কবিকে ‘বিষে ভরা বাণ’ দিতে চায়, কবি তাকে ‘বুক ভরা গান’ দিতে চান। ইসলামের সেই বাণী - কেউ তোমার প্রতি প্রতি হিংসা করলেও তুমি প্রতিহিংস হবে না। কবির কাব্যের পরতে পরতে যেনো ইসলামের সেই বাণীই মূর্তমান। কবি তার কাব্যে লোকজ ভাষার সঙ্গে দেশি বিদেশি ভাষাও ব্যবহার করেছেন। ‘জনম কালো, মরণ কালো, কালো ভুবনময়।’ বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন স্তরে সুফীবাদের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। জসীমউদ্দীনের সাহিত্যও এর ব্যতিক্রম নয়। তার নক্সীকাঁথার মাঠ কবিতায়ও সুফীবাদের প্রভাব স্পষ্ট। ‘বন্ধুর বাড়ি, আমার বাড়ি মধ্যে ক্ষীর নদী / উইড়া যাওয়ার সাধ ছিলো, পাঙ্খা দেয় নাই বিধি।’
কবি জসীমউদ্দীন বেশ কিছু মুর্শিদী গান রচনা করেছেন। ও তুমি আইসোরে দয়াল আমার মুর্শিদেরে / দয়াল আমার কান্ডারি হইয়ো রে। তিনি ইসলামী ভাবধারার অনেক জারি গান লিখেছেন। কোরবানীর জারী, ইউসুফের জারী, হাসানের বিষপান, দেহতত্ত্ব, কুলসুমের মেজবানী, মক্কার জন্মনামা জারী, হাজেরার বনবাস, জহরনামা জারী উল্লেখযোগ্য। তার পরিচিত উপন্যাস বোবা কাহিনীতেও ইসলামী উপজীব্য দৃশ্যমান। পালাগান, গাজীর গান, লোকগীতি, জারী-সারি, ইসলামী গান, দেহতত্ত্ব, মর্সিয়া, উর্দু গান, ভাটিয়ালি, বিচ্ছেদিসহ সব ধরনের শিল্প সংস্কৃতিতে তার পান্ডিত্যের প্রমাণ মিলে। আধ্যাত্মিকতা তার কাব্যে যেনো এক নবমাত্রার উম্মেষ। ‘ আমার সোনার ময়না পাখি/ কোন দেশেতে গেলা উইরা রে / দিয়া মোরে ফাঁকি।’ তার আধ্যাত্মিক ইসলামী গান পাঠক মনে শান্তির পরশ বুলায়। ‘খোদার ঘরে নালিশ করতে দিলো না আমারে/ পাপ পূন্যের বিচার এখন মানুষে করে।’ এছাড়াও তার লেখা ‘যোগী ভিক্ষা ধরো’, ‘আগে জানিনারে দয়াল তোর পিরিতে’ ইত্যাদি আধ্যাত্মিক গান তার সাহিত্য কর্মকে যেনো আরো প্রাণবন্ত করে তোলে। বিখ্যাত শিল্পী আব্বাসউদ্দীন কবির সহযোগিতায় বেশ কিছু ভাটিয়ালি ও মরমী গান গেয়েছেন। স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন তিনি বেশ কিছু দেশাত্মবোধক গানও লিখেছেন। তবে ইসলামী ভাবধারার মরমী গানগুলো কবিকে অমর করে রাখবে। ‘উজান গাঙ্গের নাইয় ‘, ‘নদীর কূল নাই কিনারা নাই’, ‘তোরা কে কে যাবি লো জল আনতে’। তার ইসলামী ভাবধারার গানগুলো মুসলিম পাঠক হৃদয়কে দোলা দেয়। পাঠকদের খোদা ভক্তে বাড়ায়। পবিত্র জীবনের অনুষঙ্গ জোগায়। কবির ধর্মীয় অনুভূতি কতোটা যে প্রকট তার প্রমাণ মিলে যখন তিনি লিখেন-‘আমার হাড় কালা করলাম রে / আমার দেহ কালার লাইগা রে।’
কবি জসীমউদ্দীনের গীতিকাব্যগুলো বাংলা গানের ঐতিহ্যের এক মূর্ত ধারক ও বাহক। তার বিখ্যাত গীতিকাব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্রাণ সখিরে ঐ কোন কদম্বডালে বংশী বাজায় কে, ও আমার দরদী আগে জানলে তোর ভাঙ্গা নৌকায় চড়তাম না, আমায় ভাসাইলিরে আমায় ডুবাইলিরে অকুল দরিয়ায় বুঝি কুল নাই রে। কবি জসীমউদ্দীন ১০ হাজার এর বেশি লোকসংগীত সংগ্রহ করেছেন। কবি তার ‘তারাবি’ কবিতায় ইসলামী উপজীব্যকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন তা বাংলা সাহিত্যে বিরল। মহিমান্বিত তারাবির অসামান্য কাহিনীর হৃদয়ছোয়া বর্ণনা, কবির ধর্ম ভীরুতা, ধর্মের প্রতি আবেগ ও শ্রদ্ধা কবিতাখানিকে অমর করে তুলেছে। যান্ত্রিক ও নগর সমাজের ধর্ম বিমুখতার রুঢ় চিত্র ফুটে উঠেছে তারাবি কবিতায়। ‘সারা গ্রামখানি থমথম করে স্তব্ধ নিরালা রাতে/ বনের পাখিরা আছাড়িয়া কাঁদে উতলা বায়ুর সাথে।’ তারাবি কবিতার মাধ্যমে কবি তার পাঠকদের জানান দিচ্ছেন যে খোদার কৃপা লাভ করতে চাইলে তার ইবাদত করতে হবে। খোদার হুকুম পালন করতে হবে। বিমুখ হলে চলবে না। ‘মোল্লা বাড়ির দলিজায় আজি সুরা ইয়াসিন পড়ি/ কোন দরবেশ সুদূর আরবে এনেছে হেথায় ধরি।’ কবি জসীমউদ্দীন আমাদের পল্লী কবি, আমাদের লোকজ সংস্কৃতির ধারক ও বাহক। গ্রামীণ জীবনকে সাহিত্যে তার মত আর কেউ প্রাণবন্ত করতে পারেন নি। একই সঙ্গে মানুষের ধর্মীয় আবেগ যে কতোটা প্রকট হয় তা তিনি তার সাহিত্য কর্মে তুলে ধরেছেন। ইসলামী উপাদানে ভরপুর তার কবিতাগুলো মুসলিম উম্মার প্রাণে গেঁথে থাকবে যুগের পর যুগ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক