কথা বলা একটা জাদুকরী শিল্প। কথায় মানুষকে কাঁদানো যায় আবার হাসানো যায়। জয় করা যায় মন ও মস্তিষ্ক। কথা বিভিন্ন রকমের হতে পারে যেমন: উসকানিমূলক, অনুপ্রেরণামূলক, উপদেশমুলক, অনুরোধমূলক, আশ্চর্যজনক, সৃষ্টিশীল ও বিধ্বংসী কথা ইত্যাদি।
প্রসঙ্গত, গত কিছুদিন আগে বাংলাদেশের প্রায় সকল এমপিওভূক্ত মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের দাবিতে ঢাকার প্রেসক্লাবে জমায়েত ও আমরণ অনশন পালন কালে শিক্ষা উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল এর কথায় শিক্ষার প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে উঠেছে। এখনই জাতীয়করণ হোক বা না হোক সেটা বড় কথা নয়, শিক্ষকরা যে আন্দোলন করেছেন সেখানে শিক্ষকদের দাবির যৌক্তিকতা ও সত্যতা যে সরকার পক্ষ অকপটে স্বীকার করেছেন সেটা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছেন। উপমন্ত্রীর কথার মধ্যে যে মায়া ও মাধুর্য মিশ্রিত ছিলো সেটার জন্য বাংলার শিক্ষক সমাজ সারা জীবন মনে রাখবেন। তিনি যেভাবে বলেছেন যে, ‘আমরা শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আমাদের শিক্ষকদের আমরা সবসময়ই সম্মানের চোখে দেখি। তাদের ব্যথায় আমরা ব্যথিত। তাদের ক্রন্দন আমাদের সবাইকে ভাবিয়েছে। সরকারি-বেসরকারি শিক্ষকদের বৈষম্য থাকা উচিত নয়।’ সুতরাং কথার জোর অনেক শক্তিশালী। এতো সুন্দর কথায় শিক্ষকরা আশ্বস্ত হয়েছেন এবং অনশন ছেড়ে শ্রেণিকক্ষে ফিরেছেন। এখানেই প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি সমীকরণ নিহিত।
শিক্ষকরা কেন আন্দোলন করলেন তা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট এবং স্পর্শ করেছে দেশের সকল শ্রেণি পেশার মানুষকে। শিক্ষকরা এমন জাতি যে জাতি অন্যের সন্তানকে শিক্ষা দীক্ষায় পরিচর্যা করে জ্ঞান গরিমায় সমৃদ্ধ করে সফলতার সর্বোচ্চ আসনে আসীন করতে দিন রাত নিরলসভাবে পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। শিক্ষাদাতার গর্ব শুধু এটাই যে, অমুক আমলা আমার ছাত্র, অমুক মন্ত্রী আমার ছাত্র, অমুক শিল্পপতি আমার ছাত্র, অমুখ ডিসি আমার ছাত্রী ইত্যাদি নানান মুখভরা গালগল্প।
আমিও কারো না কারো ছাত্র কিন্তু আজ পর্যন্ত কি আমি পেরেছি আমার কোনো শিক্ষাদাতার উপকারে আসতে? প্রশ্নের উত্তর দিতে সকলেই অপারগ। আন্দোলনের ২১ দিনেও দেখিনি আমাদের শিক্ষকদের কোনো ক্ষমতাবান ছাত্র-ছাত্রী যারা আজকের দিনে এমপি-মন্ত্রী-আমলা প্রেসক্লাবে এসে কিঞ্চিত সমবেদনা কিংবা সংহতি প্রকাশ করেছেন। একমাত্র ঈশ্বরই জানেন তারা মনে মনেও করেন কি না। কথায় আছে, ছাত্র আর পুত্রের কাছে আশা করতে নেই। এই কথায় সত্য। তারপরেও শিক্ষা উপমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টাসহ সংশ্লিষ্টদেরকে অনেক অনেক ধন্যবাদ এই জন্যে যে, শিক্ষকদের দাবিকে যৌক্তিকভাবে সমর্থন দিয়েছেন এবং শিক্ষাবান্ধব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে শিক্ষকদের দাবি গুলো অচিরেই বাস্তবায়ন করবেন।
শিক্ষকদের চাওয়া কি খুব বেশি? সরকারি শিক্ষকদের মতো না হলে ও আপাতত সম্মানজনক বাড়ি ভাড়া, শতভাগ উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতা, বদলী ও পেনশন ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ধাপে ধাপে সরকারিকরণের পথ ধাবিত হওয়া।
আজকাল আমরা পত্রিকার পাতা খুললেই দেখি অমুক অফিসের পিয়নের রাজধানীতে বিশাল কয়েকটি ফ্ল্যাট আছে, অমুক অফিসের কর্মকর্তার বিদেশে বাড়ি, দেশে চড়ে বিএমডব্লিউ গাড়ি, আরো কত কী! এই এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের চাকুরিতে এই সবের সুযোগ আছে কি? আছে যতো বঞ্চনা ও যন্ত্রণা!
শিক্ষকরা চান বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। যেখানে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষকদের বেতন ভাতা ও অন্যান্য সুযোগ সুবিধার সাম্যাবস্থা। সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষার্থীদের শিক্ষার ব্যয়ভার সমান করা। কেনোনা প্রকৃত শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণ। আর একটি সুন্দর ও সভ্য সমাজ বিনির্মানের হাতিয়ার হলো শিক্ষা, শিক্ষা এবং শিক্ষা। আর শিক্ষক হলো সেই সমাজ নির্মাণের কারিগর। সেই কারিগরদের অসুখী রেখে আগামী দিনের স্মার্ট, জ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর সোনার বাংলা গড়ে তোলা হবে এই সময়ের কঠিণ চ্যালেঞ্জ।
শিক্ষকরা সবসময়ই আশাবাদী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শিক্ষা ব্যবস্থা জাতীয়করণের ঘোষণা দিয়ে সকল শিক্ষকদের মনে আশার প্রদীপ জ্বালিয়ে চিরকাল স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এই সোনার বাংলায়।
পরিশেষে, কোনো আন্দোলন একদিনে বা একমাসে সফল হয় না বা কোনো সুফলও আনে না। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। যেমনটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা লাভের আন্দোলন যার শুরু হয়েছিল ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৪, ১৯৫৬, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ ও ১৯৭১’র আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। অতঃপর স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষার সুবর্ণ ফসল।
লেখক: প্রভাষক- ইংরেজি, শশীদল আলহাজ্ব মুহাম্মদ আবু তাহের কলেজ, কুমিল্লা