জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) স্নাতকে ভর্তি প্রক্রিয়া নিয়ে নানা প্রশ্ন দীর্ঘদিনের। বিশেষ করে, নির্ধারিত আসনের বাইরে কয়েকটি কোটা নিয়ে বিতর্ক-সমালোচনা বেশ পুরনো। তবে কোটাবিরোধী আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সরকার পতন, এরপর অন্তর্বর্তী সরকারের ‘রাষ্ট্র সংস্কারের’ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ভিসি কোটা’ ও ‘পোষ্য কোটা’ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বলছেন, পোষ্য কোটা বৈষম্যমূলক, এটি সংস্কার করতে হবে। আর ভিসি কোটার সুবিধাটিকে নজিরবিহীন উল্লেখ করে এটির বাতিল চাইছেন তারা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্য বলছে, বছরপ্রতি নির্ধারিত ১৮৮০ আসনের বাইরে কোটায় অন্তত ২৫০ থেকে ৩০০ জন শিক্ষার্থীকে ভর্তি করা হয়। এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধা কোটা, দলিত ও আদিবাসী কোটা, প্রতিবন্ধী কোটা, খেলোয়াড় কোটা ও উপাচার্যের সংরক্ষিত কোটা (ভিসি কোটা) আসনসংখ্যা নির্ধারিত। প্রতিবছর মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ১৪৮ জন, দলিত ও আদিবাসী কোটায় ৩০, প্রতিবন্ধী কোটায় ১৫, খেলোয়াড় কোটায় ৮ এবং ভিসি কোটায় ২০টি আসনে শিক্ষার্থীরা ভর্তির সুযোগ পান।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সন্তান, ভাই-বোনরা পোষ্য কোটার আওতায় ভর্তির সুযোগ পান। এই ভর্তি প্রক্রিয়াকে ‘বিশেষ বিবেচনা’ বলে আখ্যা দিচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা। কারণ, ভর্তি পরীক্ষায় ন্যূনতম নম্বর পেয়ে পাস করলেই তারা পছন্দমতো বিভাগে ভর্তি হতে পারেন। রেজিস্ট্রার কার্যালয়ের তথ্যমতে, পোষ্য কোটায় ২০২২-২৩ শিক্ষাবর্ষে ৫৬ ও ২০২১-২২ শিক্ষাবর্ষে ৫৪ জন ভর্তি হন।
দেশের চারটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাদেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় পোষ্য কোটা রয়েছে। তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় বাদে অন্য তিনটি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ভিসি কোটা নেই।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কোটায় আবেদনকারী শিক্ষার্থীদের ভর্তি-সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্দিষ্ট কোনো অধ্যাদেশ বা আইন নেই। শুধু ভিসি কোটা বাদে সব কোটায় শিক্ষার্থীদের ভর্তির ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটির নির্দেশনায় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা পরিচালনা কমিটি সরকারি চাকরির পরীক্ষাসহ বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য সরকারিভাবে জারি করা প্রজ্ঞাপনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। ভিসি কোটায় ভর্তিসংক্রান্ত সব সিদ্ধান্ত উপাচার্য নিজেই নিয়ে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষায় ৮০ নম্বরের মধ্যে ২৬.৪ নম্বর পেয়ে উত্তীর্ণ হলেই কোটায় আবেদনকারীরা ভর্তি হওয়ার সুযোগ পান। এর মধ্যে ভিসি কোটায় আবেদনকারীদের মধ্য থেকে উপাচার্য তার পছন্দমতো যে কাউকে ভর্তির সুযোগ দিতে পারেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেপুটি রেজিস্ট্রার (শিক্ষা) সৈয়দ মোহাম্মদ আলী রেজা বলেন, পোষ্য কোটার জন্য নির্দিষ্ট কোনো আসন সংরক্ষিত থাকে না। ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য কোটাধারী শিক্ষার্থীদের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে বিবেচনা করা হয়। ভর্তি প্রক্রিয়ায় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে মেধা তালিকার প্রথম দিকে থেকেও অনেকে পছন্দের বিষয়ে পড়ার সুযোগ পান না। অথচ কোটাধারীরা মেধা তালিকায় না থেকেও বিশেষ সুবিধায় পছন্দমতো পড়ার বিষয় নির্বাচন করে নিতে পারেন। কোটায় ভর্তি শিক্ষার্থীর চেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় বেশি নম্বর পেয়েও ভর্তির সুযোগ পান না বহু ভর্তিচ্ছু।
শিক্ষার্থীরা বলছেন, শিক্ষক-কর্মকর্তা বা কর্মচারীর সন্তান ও পরিবারের সদস্যরা সুবিধাবঞ্চিত নন, তাই তাদের কোটা সুবিধার মাধ্যমে ভর্তির সুযোগ দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। ভিসি কোটা থাকারও যৌক্তিকতা নেই, এটি আর কোথাও দেখা যায় না।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জাবি শাখার সমন্বয়ক হাসিব জামান বলেন, ভিসি কোটা বাতিল করতে হবে। পোষ্যসহ কোটা পদ্ধতির সংস্কার আনতে হবে। যারা সুবিধাবঞ্চিত, তাদের কোটায় অগ্রাধিকার দিতে হবে।
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ অধ্যাপকরা বলছেন, পোষ্য ও ভিসি কোটা নিয়ে নানা বিতর্ক থাকলেও বিগত সময়ের প্রশাসন সেটির ইতিবাচক কোনো সংস্কার করতে পারেনি। উল্টো কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা কোটা সুবিধায় ভর্তির সুযোগ আরও অবারিত করার দাবি জানিয়েছেন।
উপাচার্য অধ্যাপক মোহাম্মদ কামরুল আহসান বলেন, পোষ্য কোটায় ভর্তিকৃত শিক্ষার্থীরা শুধু শ্রেণিকক্ষের সুবিধা পান। আবাসিক হলে তারা কোনো আসন ভোগ করেন না। তারা অন্যদের আসনে ভাগ বসান না। তবে পোষ্য কোটার বিষয়টি নিয়ে অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে।