জালিয়াতি : আন্তর্জাতিক জার্নাল থেকে ৫ বাংলাদেশি অধ্যাপকের গবেষণা প্রত্যাহার

দৈনিক শিক্ষাডটকম, সিলেট |

দৈনিক শিক্ষাডটকম, সিলেট : প্রকাশের ৬ বছর পর জালিয়াতির অভিযোগে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) তিন অধ্যাপকের গবেষণাপত্র প্রত্যাহার করেছে কোরিয়াভিত্তিক আন্তর্জাতিক জার্নাল বায়োলজিক্যাল মেডিক্যাল সেন্টার (বিএমসি)। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) দুজন অধ্যাপক এই গবেষণাপত্রের সহ–লেখক ছিলেন।  

বিএমসির প্রত্যাহারপত্রে বলা হয়েছে, গবেষকেরা নিজেদের ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের একটি প্রকাশনার তথ্য ব্যবহার ও পরীক্ষা–নিরীক্ষায় প্রাপ্ত তথ্যসহ অন্যান্য গবেষণার উপাদান কমিয়ে–বাড়িয়ে ফলাফল তৈরি করেছেন। এ ছাড়া পশু গবেষণার জন্য নৈতিক অনুমোদন নেওয়ার তথ্যও মিথ্যা ছিল। কারণ, শাবিপ্রবিতে ২০২২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো কমিটি ছিল না। এ ব্যাপারে গবেষকেরা জার্নালের প্রধান সম্পাদককে কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি। ফলে জার্নালের প্রধান সম্পাদক এই গবেষণা নিবন্ধে উপস্থাপিত তথ্যের ওপর আস্থা হারিয়েছেন। তাই গবেষণাটি তিনি প্রত্যাহার করতে বাধ্য হন।

তবে প্রধান গবেষক জার্নালের প্রধান সম্পাদকের এসব অভিযোগ মানতে নারাজ। 

জানা গেছে, ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৮ সেপ্টেম্বর ‘ট্রাইড্যাক্স প্রোকাম্বেন্স ফ্ল্যাভোনয়েডস: অ্যা প্রসপেক্টিভ বায়োঅ্যাকটিভ কম্পাউন্ড ইনক্রিজড অস্টিওব্লাস্ট ডিফারেনসিয়েশন অ্যান্ড ট্র্যাবেকুলার বোন ফরমেশন’ শিরোনামে প্রকাশিত গবেষণাপত্রটি চলতি বছরের ৭ জুলাই প্রত্যাহার করেছে কোরিয়া–ভিত্তিক ওই আন্তর্জাতিক সাময়িকী। 

ওই গবেষণাপত্রটির সঙ্গে জড়িত শিক্ষকেরা হলেন— শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ও লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন ড. আবদুল্লাহ আল মামুন, তাঁর স্ত্রী নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. আমিনা খাতুন, লাইফ সায়েন্স অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন, কুষ্টিয়া ইসলামি বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) ফলিত পুষ্টি এবং খাদ্যপ্রযুক্তি বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মাসিহুল আলম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ফার্মেসি বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলিম আল বারি। 

গবেষণাপত্রে অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন প্রধান লেখক (ফার্স্ট অথর)। অধ্যাপক মামুন বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে থাকা নিজের প্রোফাইল থেকে প্রত্যাহার হওয়া গবেষণাপত্রের লিংক সরিয়ে নিয়েছেন। তবে বাকিদের নিজ নিজ প্রোফাইলে প্রত্যাহার হওয়া গবেষণাপত্রের লিংক আজ সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত দেখা গেছে।

এখানেই শেষ নয়, এর আগে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ নভেম্বর একই জার্নালে ‘ট্রাইড্যাক্স প্রোকাম্বেন্স ফ্ল্যাভোনয়েডস প্রমোট অস্টিওব্লাস্ট ডিফারেনসিয়েশন অ্যান্ড ট্র্যাবেকুলার বোন ফরমেশন’ শিরোনামে আরেকটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন এই অধ্যাপকেরা। সেই গবেষণায় যেসব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করার কথা উল্লেখ করেছেন সেগুলোর অধিকাংশই আজও শাবিপ্রবির ল্যাবরেটরিতে নেই। 

শাবিপ্রবির একাধিক অধ্যাপক জানান, এই ভুয়া গবেষণাপত্র ব্যবহার করে ড. আবদুল্লাহ আল মামুন অধ্যাপক হিসেবে পদোন্নতি নিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। ড. মামুনের স্ত্রী ড. আমিনার এই গবেষণার সঙ্গে দূরতম সম্পর্ক থাকার কথা নয়। ড. জাকির হোসেন মনগড়া ভুয়া ডেটা ব্যবহার করে গবেষণাপত্র তৈরি করতে পটু বলে অভিযোগ রয়েছে।

একদল সাবেক আন্ডার গ্র্যাজুয়েট ও গ্র্যাজুয়েট ছাত্রের সমন্বয়ে মনগড়া ডেটা ব্যবহার করে গবেষণাপত্র তৈরি করে যাচ্ছেন তাঁরা। তাঁর নিয়োগেও জালিয়াতির অভিযোগ রয়েছে। ড. জাকির এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম নিয়োগের সময় আবেদনপত্রের সময়সীমা শেষ হওয়ার পরে ভুয়া ব্যাংক ড্রাফট জমা দিয়ে চাকরি পেয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

শাবিপ্রবি সূত্র জানায়, ২০২২ খ্রিষ্টাব্দের ২ নভেম্বর গবেষণায় নৈতিকতা দেখভালের জন্য ‘সাস্ট রিসার্চ এথিক্স বোর্ড’ গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়। সাস্ট রিসার্চ এথিক্স বোর্ডের পরিচালক অধ্যাপক আকতারুল ইসলাম বলেন, ‘সঠিক তারিখ মনে নেই। আনুমানিক দুই বছর আগে এই বোর্ড গঠন করা হয়।’ অথচ ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে দাবি করা হয়েছে, গবেষকেরা এথিক্স কমিটি থেকে গবেষণায় পশুর ওপর পরীক্ষা চালানোর অনুমতি নিয়েছেন।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে শাবিপ্রবির লাইফ সায়েন্স অনুষদের ডিন অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমরা প্রত্যাহার করে নিয়েছি। এটা অন্য জায়গা ইউজ করব। তাঁদের এসব অভিযোগ, আমি এটা ওইভাবে এগ্রি করিনি। ওনারা বলেনি যে, এটা প্রত্যাহার করতে হবে। সত্যি কথা, সেই সময় আমাদের ভার্সিটিতে এথিক্যাল কমিটি ছিল না। ওনারা আসলে এগুলো দেখে। এথিক্যাল বলতে অ্যানিমেল রিসার্চ। তাঁরা বলছে, আগের ছবির সঙ্গে এটার মিল হয়ে গেছে। এটা একই রকম প্রজেক্টের কাজ। ছবি আসলে এক না। ফেক–টেইক ব্যাপার আসলে গুরুত্বপূর্ণ না। তাঁরা আসলে বাড়িয়ে বলেছে। এগুলো তো হাই–ইম্প্যাক্ট পেপারের, ওনারা এই জিনিসগুলো নিয়েছেন। ওনারা এটা পাবলিশ করে ফেলেছেন, যেখানে এথিক্যাল কমিটির কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। ইউনিভার্সিটির ল্যাবে সব যন্ত্রপাতি রয়েছে। তবে এটা ঠিক, আমাদের যতটা ফ্যাসিলিটি থাকা দরকার, আমেরিকায় যে ধরনের ফ্যাসিলিটি আছে, আমাদের সেটা নেই। ওসব অপপ্রচার।’

গবেষণাপত্রটির সহ–লেখক শাবিপ্রবির জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘গবেষণাটির পুরো কাজ আবদুল্লাহ আল মামুন স্যার করছেন। আমি এ রকম কিছু জানি না। ভালো রিসার্চ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সুনাম কুড়াচ্ছি। হয়তো এটা কারও সহ্য হচ্ছে না। এ জন্য আমার বিরুদ্ধে এসব বানোয়াট অভিযোগ আনা হচ্ছে।’ 

একই বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও ড. মামুনের স্ত্রী ড. আমিনা খাতুনও বলেন, ‘গবেষণাপত্রটি প্রত্যাহারের ব্যাপারে কিছু জানি না।’ তিনি এ বিষয়ে কথা বলতে অপারগতা প্রকাশ করেন।

এ বিষয়ে জানতে রাবি ও ইবির দুই অধ্যাপকের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তাঁদের তাৎক্ষণিক সাড়া পাওয়া যায়নি। 

শাবিপ্রবির উপ–উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. কবির হোসাইনের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি বলেন, ‘প্লেজারিজম (চৌর্যবৃত্তি) ধরার জন্য আমাদের সফটওয়্যার ডেভেলপ করা আছে। বিষয়টি প্রথম শুনলাম, কারা কী করেছে, জানি না। তবে কারও বিরুদ্ধে প্লেজারিজমের মতো কিছু প্রমাণিত হলে আমরা ব্যবস্থা নেব। অন্যদের বিষয়ে নিজ নিজ বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবস্থা নিবে।’


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে - dainik shiksha ভিকারুননিসার সেই ফৌজিয়া এবার ঢাকা বোর্ডের চেয়ারম্যান হওয়ার দৌড়ে ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য - dainik shiksha ১৮ দিনে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৮ কোটি টাকা সাশ্রয় করেছি : উপাচার্য উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত - dainik shiksha উপদেষ্টা আসিফ-নাহিদের ছাত্র সংগঠনের সব কার্যক্রম স্থগিত যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস - dainik shiksha যারা আপনাদের সেবা করবে তাদের ভোট দেবেন: সারজিস এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি - dainik shiksha এখনো প্রস্তুত হয়নি একাদশের, পাঁচ বইয়ের পাণ্ডুলিপি মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক - dainik shiksha মাদরাসায় অনুপস্থিত থেকেও ১১ মাসের বেতন তুলেছেন শিক্ষক ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক - dainik shiksha ৬৬ জন ছাত্রকে পাঁচচুলো করলেন শিক্ষক প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি - dainik shiksha প্রশ্নফাঁসের তদন্ত নিয়ে সিআইডি ও পিএসসি মুখোমুখি কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.004194974899292