গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান ও আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) কার্যত অবাঞ্ছিত হয়ে পড়েছেন আওয়ামীপন্থি শিক্ষকরা। ছাত্র আন্দোলনের বিপরীতে অবস্থান এবং শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার নির্দেশ ও পরিকল্পনার অভিযোগে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফিরতে পারেননি তারা। উপরন্তু উপাচার্যসহ প্রশাসনের শীর্ষব্যক্তিদের পদত্যাগের পর নেতৃত্বশূন্য অবস্থায় দিন পার করতে হচ্ছে তাদের।
গত ৭ আগস্ট পদত্যাগ করেন উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলম। পদত্যাগের দিন সকালে অনলাইনে জরুরি সিন্ডিকেট সভা ডেকে অ্যাকাডেমিক কার্যক্রম শুরুর ঘোষণা দেন তিনি। একই দিনে পদত্যাগ করেন রেজিস্ট্রার আবু হাসান। প্রশাসনিক ও অ্যাকাডেমিক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র স্বাক্ষর ও অনুমোদন না হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। পদত্যাগের ধারাবাহিকতায় ধাপে ধাপে পদত্যাগ করেছেন দুই উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষ।
এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিন্ডিকেটেও ছিল তৎকালীন ক্ষমতাসীন সরকারের সমর্থক শিক্ষকদের একচ্ছত্র আধিপত্য। সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবির, গাজীপুর জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মোতাহার হোসেন মোল্লা, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ এবং তেজগাঁও কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. হারুন অর রশিদ সবাই ছিলেন আওয়ামী সমর্থনপুষ্ট। সরকার পতনের পর অধ্যক্ষরা নিজ নিজ পদ থেকে পদত্যাগ করেছেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ও বিভিন্ন হলের প্রভোস্টরা পদত্যাগ করায় সংকট আরও ঘনীভূত হয়। ছাত্রছাত্রীদের ১০টি আবাসিক হলের প্রভোস্ট ইতোমধ্যে পদত্যাগ করেছেন, তারা সবাই ছিলেন আওয়ামীপন্থি রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। এ ছাড়া গত রোববার পদত্যাগ করেছেন জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক নূহু আলম। সমাজবিজ্ঞান অনুষদের ডন ও ‘বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদে’র সদস্য সচিব অধ্যাপক বশির আহমেদ আর ক্যাম্পাসে ফেরেননি।
এরই মধ্যে গত ১৫ আগস্ট ঘিরে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফেরা ও নিজেদের অবস্থান জানান দিতে অনলাইন মিটিং ডাকে বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদ। তবে তালিকাভুক্ত প্রায় চার শতাধিক শিক্ষকের মধ্যে মাত্র ৪০ জন শিক্ষক মিটিংয়ে উপস্থিত ছিলেন। ১৩ আগস্ট বিভাগে এসে শিক্ষার্থীদের তোপের মুখে পড়েন লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক জেবউননেছা ও অধ্যাপক ছায়েদুর রহমান। বঙ্গবন্ধু পরিষদের আহ্বায়ক পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এএ মামুন, সরকার ও রাজনীতি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও সাবেক প্রক্টর ফিরোজ-উল-হাসান, সহকারী প্রক্টর ইখতিয়ার উদ্দিন ভূঁইয়া, ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মেহেদী ইকবালও নিজ বিভাগে ফেরেননি। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে বিভাগে ফিরতে পারেননি আইন অনুষদের ডিন তাপস কুমার দাস ও সহযোগী অধ্যাপক সুপ্রভাত পাল। নাটক ও নাট্যতত্ত্ব বিভাগের ছয় শিক্ষককে বিভাগে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন শিক্ষার্থীরা।
সূত্র জানায়, গত ১৫ জুলাই আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ওপর ছাত্রলীগ নেতাকর্মী ও বহিরাগত সন্ত্রাসীদের হামলার ব্যাপারে আগে থেকেই অবগত ছিল বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। আন্দোলন দমন করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের সঙ্গে পরিকল্পনায় জড়িত ছিলেন প্রক্টরিয়াল টিম, ডিন ও হল প্রভোস্টরাও। এমনকি
১৭ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে শহীদ মিনার সংলগ্ন সড়কে শিক্ষার্থীদের উপর গুলিবর্ষণও ঘটেছে আওয়ামীপন্থি শিক্ষকদের প্রত্যক্ষ মদদে। বঙ্গবন্ধু শিক্ষক পরিষদের হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে এ সংক্রান্ত একাধিক স্ক্রিনশট ইতোমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
এ ব্যাপারে সমন্বয়ক আব্দুর রশিদ জিতু ও জাহিদুল ইসলাম বলেন, হামলায় জড়িত শিক্ষকদের আমরা চিহ্নিত করতে পেরেছি। তাদের ক্যাম্পাসে অবাঞ্ছিত ঘোষণা করা হয়েছে। এ মুহূর্তে ক্যাম্পাসে ফিরে তারা শিক্ষার্থীদের হাতে লাঞ্ছিত হলে দায়ভার আমরা নেব না। বিশ্ববিদ্যালয় ও রাষ্ট্রীয় আইনে আমরা তাদের বিচার চাই।
এ ব্যাপারে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক মোতাহার হোসেন বলেন, শিক্ষক সমিতির নির্বাহী সভায় এ ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন প্রশাসক নিজস্ব পলিসি অনুযায়ী তাদের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। তবে আমরা চাই আমাদের কোনো সহকর্মীর সম্মানহানি যেন না হয়।