এইচএসসি পরীক্ষায় এ গ্রেড (৪.১০) পেয়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নিহত শাওয়ান্ত মেহতাব প্রিয় (১৬)। এমন সাফল্যে আনন্দ উদযাপন করার বদলে কাঁদছেন প্রিয়’র পরিবার, আত্মীয় ও বন্ধুরা।
যশোরের মুজিব সড়কের বাসিন্দা হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক শাকিল ওয়াহিদ (৫২) ও গৃহিনী রেহেনা পারভীন (৪৮) দম্পত্তির পুত্র শাওয়ান্ত মেহতাব প্রিয়। তিন ভাইয়ের মধ্যে প্রিয় বড়। ছোট দুই ভাই।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতন হলে এদিন সন্ধ্যায় একদল দুষ্কৃতকারী যশোরের মুজিব সড়কে অবস্থিত পাঁচতারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনাল-এ অগ্নিসংযোগ করে। এ সময় অগ্নিদগ্ধদের উদ্ধার করতে এগিয়ে যান একই এলাকার বাসিন্দা প্রিয়। কিন্তু আহতদের উদ্ধার করতে গিয়ে প্রিয় নিজেই দগ্ধ হয়ে প্রাণ হারান।
প্রিয় এ বছর যশোর সরকারি সিটি কলেজ থেকে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়েছিলেন। পরীক্ষায় ভালো ফলও করেছেন। কিন্তু এই আনন্দ উদযাপনের জন্য প্রিয় নেই। প্রিয় আর ফিরে আসবে না। দেখবে না তার পরীক্ষার ফলাফল।
গত মঙ্গলবার ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশিত হয়েছে। এ উপলক্ষে গতকাল সন্ধ্যায় মুজিব সড়কস্থ প্রিয়’র বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, নীল রঙ করা চারতলা বাড়িটি যেন আরো বিষণ স্তব্ধ। বেদনায় নীল। প্রিয়’র পরীক্ষার ফল শুনে আনন্দের বদলে কাঁদছেন প্রিয়’র বাবা-মা। আত্মীয়-বন্ধুরা দেখা করতে আসছেন। কিন্তু প্রিয়’র মা রেহেনা পারভীনের মনে আনন্দ নেই। তিনি চোখ মুছছেন আর প্রিয়’র ব্যবহৃত জিনিসপত্র খুলে খুলে দেখাচ্ছেন। টেবিলের পাশে সাজিয়ে রাখা একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণীর নানা বই নাড়াচাড়া করছেন। মুছে রাখছেন। এসএসসিসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় ও বিভিন্ন ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পাওয়া পুরস্কার ও ক্রেস্টগুলো দেখাচ্ছেন।
বাষ্পরুদ্ধ কন্ঠে রেহেনা পারভীন বলেন, ‘আমার সবই আছে, শুধু নেই প্রিয়। মনে হয়, এখনই আমার কাছে ফিরে আসবে। বলবে, দেখো মা আমি পাস করেছি। তোমার দোয়া কাজে লেগেছে। সবাই বলছে সে ভালো রেজাল্ট করেছে। কিন্তু আমার ভেতরটা দুমড়েমুচড়ে যাচ্ছে। আমি থাকতে পারছি না আমার বুকের ধনকে ছাড়া। সে বেঁচে থাকলে কত আনন্দ করত, খুশি হতো। তা দেখে গর্ব করতাম আমিও।’
তিনি বলেন, আমার ছেলে যে কত ভালো। বাবা মা ছাড়া তার জীবনে কিছু ছিলো না। স্বপ্ন দেখতো তার দুই ভাইকে মানুষ করবে, মা বাবাকেও দেখাশুনা করবে। এসব এখন শুধু স্মৃতি। প্রিয় ‘র পাসের খবর আমার জন্য খুশির। কিন্তু খুশি উদযাপন যার সঙ্গে করব, সে তো আমার কাছে নেই। আমার স্বপ্নটা আগুনে পুড়ে গেছে।’
প্রিয়’র বাবা শাকিল ওয়াহিদ নিজের কষ্ট বুকে চেপে স্ত্রীকে সান্ত¦না দিচ্ছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে বলতো বাবা তোমার বয়স হয়ে গেছে, তোমার তো আর কিছু হবে না। আমি আইইএলটিএস (ইন্টারন্যাশনাল ইংলিশ ল্যাংগুয়েজ টেস্টিং সিস্টেম) পরীক্ষা দেবো। বিদেশ যাবো। সংসারটা আমিই দেখবো। সাথে ছোট দুই ভাইকে বড় করবো।
তিনি জানান, একই এলাকায় নিজেদের জায়গা থাকা সত্ত্বেও টাকার অভাবে বাড়ি করতে পারেন নি। ভাড়া বাড়িতে থাকেন। প্রিয় বিদেশ গেলে নিজেদের একটা বাড়ি করারও স্বপ্ন ছিলো পরিবারের।
প্রিয়’র বাবা আরো বলেন, ‘আমার ছেলে আগস্টের ৫ তারিখে মারা গেছে। তবে রেজাল্ট শুনে আত্মীয় স্বজনেরা যখন ফোন দিচ্ছে, তখন বুকের ভিতরটা ক্ষত বিক্ষত হয়ে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে আমার সন্তানের দ্বিতীয় মৃত্যু হলো আজ। এসএসসিতে প্রিয় জিপিএ-৫ পেলে এলাকায় আধা মণ মিষ্টি খাইয়েছিলাম। এবার ছেলে নাই। আমি বুকে কষ্ট চেপে দিন পার করছি।’
প্রিয়’র বন্ধুদের সাথে কথা বলে জানা যায়, প্রিয় অনেক সাহসী ও পরোপকারি ছিলো। গত ৫ আগস্ট বিকেলে শহরের চিত্রামোড়স্থ ১৪ তলা বিশিষ্ট জাবির হোটেল ইন্টারন্যাশনালে দাউ দাউ আগুনে জ্বলতে দেখে হোটেলে আটকে থাকাদের উদ্ধারে যান প্রিয়। কয়েকজনকে বাঁচাতে পারলেও একসময় নিজেই আটকে যান।
তার বন্ধুরা বলেন, জাবির ট্রাজেডিতে পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে আমাদের মেধাবি বন্ধু প্রিয়। আজ তার সাফল্যের খবরে আমরা সত্যিই খুব ব্যথিত।
প্রসঙ্গত, ৫ আগস্ট বৃহত্তর যশোর অঞ্চলের পাঁচতারকা হোটেল জাবির ইন্টারন্যাশনালে অগ্নিসংযোগে একজন বিদেশি নাগরিকসহ ২৪ জন্য দগ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। অগ্নিদগ্ধ হন শতাধিক। প্রিয়’র মৃত্যুতে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের বিজয়ের উল্লাসের মধ্যে এ এলাকার ছাত্রদের মধ্যে তখন নেমে এসেছিল গভীর শোক। আর এখন প্রিয়’র পরীক্ষার ফলাফলে সে শোক যেন আরো দ্বিগুণ হয়ে কাঁদাচ্ছে সকলকে।