আজ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস। এবারকার প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘Empower Minds, Change Lives: Celebrate World Literacy Day!!’ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস পালনের মধ্য দিয়ে মনকে ক্ষমতায়িত করা ও জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসা। সেই ১৯৬১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে বিশ্বের নেতারা পৃথিবী থেকে নিরক্ষরতা দূর করতে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে একটি প্রস্তাব পেশ করেন যেটি গৃহীত হয় কারণ নিরক্ষরতা হচ্ছে অন্ধকার, একটি মানব সভ্যতার জন্য অভিশাপ। জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিবিষয়ক সংস্থা ইউনেসকোর উদ্যোগে ১৯৬৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানের রাজধানী তেহরানে অনুষ্ঠিত হয় বিশ্ব সাক্ষরতা সম্মেলন। তারপরেই বিষয়টি গতি পায় এবং ১৯৬৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪তম অধিবেশনে ৮ সেপ্টেম্বর’ আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে দিবসটি প্রথমবারের মতো পালন করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে প্রস্তাবটি গৃহীত হওয়ার পর কেটে গেছে ৬৪ থেকে ৬৫ বছর আর প্রথমবার পালন করা থেকে কেটে গেছে ৫৭ বছর। এই সময়ের মধ্যে গোটা পৃথিবীতে ঘটে গেছে অনেক ঘটনা, অনেক পরিবর্তন কিন্তু নিরক্ষরতা আমরা দূর করতে পারিনি। এই সময়ের মধ্যে যদিও পৃথিবীকে কয়েকবার ধ্বংস করার মতো অস্ত্র ও মারণাস্ত্র বানিয়েছে বিশ্বের অনেক শক্তিধর রাষ্ট্র। দিবসটি পালনের জন্য প্রতিবছরই বৈশ্বিক পরিস্থিতি ও দিবসটির তাৎপর্য বোঝানোর জন্য একটি করে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করা হয়।
ইউনেসকো মনে করে যে সারা বিশ্বে প্রচুর সংখ্যক মানুষ অন্তত একটি ভাষায় পড়তে বা লিখতে পারে না। এই সংখ্যার একটি বিশাল অংশ নারী এবং তাদের প্রায় অর্ধেকই প্রাপ্তবয়স্ক। আফ্রিকাজুড়ে বেশ কয়েকটি নিম্ন আয়ের দেশে সাক্ষরতার হার ৪৫ শতাংশেরও কম। কারণ, দারিদ্র্য ও নিরক্ষরতা প্রায়ই এই অঞ্চলের পাবলিক শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে সম্পর্কিত এবং জাতীয় শিক্ষার বোঝাকে সমর্থন করার জন্য যথেষ্ট অর্থায়ন করা হয় না। অথচ অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক ইত্যাদিসহ নানা ধরনের প্রতিবন্ধকতা থেকে মুক্তির অন্যতম উপায় হলো সাক্ষরতা অর্জন করা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই সাক্ষরতার সংজ্ঞায় ভিন্নতা থাকলেও ১৯৬৭ খ্রিষ্টাব্দে ইউনেসকো সর্বজনীন একটা সংজ্ঞা নির্ধারণ করে। তখন শুধু কেউ নাম লিখতে পারলেই তাকে সাক্ষর বলা হতো। পরবর্তীতে প্রায় প্রতি দশকেই এই সংজ্ঞায় পরিবর্তন এসেছে এবং ১৯৯৩ খ্রিষ্টাব্দের একটি সংজ্ঞায় ব্যক্তিকে সাক্ষর হওয়ার জন্য তিনটি শর্ত পূরণ করতে হয়। যথা-ব্যক্তি নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য পড়তে পারবে, নিজ ভাষায় সহজ ও ছোট বাক্য লিখতে পারবে, দৈনন্দিন জীবনের সাধারণ হিসাব-নিকাশ করতে পারবে। পড়তে ও লিখতে সক্ষম ব্যক্তিকে সাক্ষর বলা হয়। যাদের ‘ক’ ‘খ’, ‘গ’ জ্ঞান আছে, ভাষার প্রতি সম্মান আছে ও যিনি সঠিক ও বেঠিকের পার্থক্য বোঝেন, তিনিই সাক্ষর। তবে তথ্য-প্রযুক্তির এই যুগে সেই সংজ্ঞা কতোটা প্রাসঙ্গিক সেটি একটি প্রশ্ন।
এথনোলগ ওয়েবসাইট সূত্র থেকে আমরা জানতে পারি, পৃথিবীতে বর্তমানে প্রায় ৭ হাজার ৯৭ ভাষা বেঁচে আছে। এর মধ্যে দুই হাজার ভাষায় কথা বলা লোকের সংখ্যা এক হাজারেরও কম। এ ছাড়া মোট ভাষার মাত্র অর্ধেকের আছে লিখিত রূপ। এসব ভাষায় ব্যবহার করা হয় ৪৬ ধরনের বর্ণমালা। বাকিগুলো মৌখিকভাবেই চর্চিত হয়। কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাকেন্দ্রিক গবেষণার তথ্য অনুযায়ী প্রতি দুই সপ্তাহে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যাচ্ছে একটি করে ভাষা। সেগুলোর অবস্থান কোথায় আছে সেগুলোও জানা প্রয়োজন। পৃথিবীর প্রায় ৭৭৫ মিলিয়ন অধিবাসীর ন্যূনতম প্রয়োজনীয় অক্ষরজ্ঞানের অভার রয়েছে। প্রাপ্তবয়স্ক প্রতি পাঁচজনে একজন এখনো শিক্ষিত নন ও এই জনগোষ্ঠীর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ নারী। বিশ্বের প্রায় ৬০ দশমিক ৭ মিলিয়ন শিশু প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থেকে বঞ্চিত এবং আরো অনেকের শিক্ষায় অনিয়মিত বা শিক্ষা সমাপ্ত হওয়ার আগেই ঝরে পড়ে। চীনের উপকথা অনুসারে ড্রাগনমুখো লোক সা-চিয়েন প্রাচীন চীনা ক্যারেক্টারগুলো বা অক্ষরগুলো তৈরি করেছিলেন। পাখির মতো মাথা ও মানুষের মতো দেহবিশিষ্ট দেবতা থথ কর্তৃক মিসরীয় লিপিসমূহের সৃষ্টির কথাও প্রচলিত আছে। প্রাচীন ফিনিশীয় লিপি, হায়ারোগ্লিফিক, কিউনিফর্ম ও ব্রাক্ষ্রী প্রভৃতি লিপির উদ্ভাবনই আধুনিক সভ্যতার লিখন পদ্ধতির ভিত্তিভূমি। ব্রাক্ষ্রী, কুষাণ, কুটিল, নাগরি লিপিসমূহ বাংলালিপির আধুনিকায়নে বিভিন্ন স্তর হিসেবে কাজ করেছে। লিখন পদ্ধতির উদ্ভাবন এবং তার পরবর্তী চর্চাই সাক্ষরতা প্রত্যয়টিকে আমাদের সামনে নিয়ে আসে, যার সরলীকৃত অর্থ পড়া ও লেখার সক্ষমতা।
আমাদের দেশে সাক্ষরতা বৃদ্ধির প্রাথমিক ও প্রাচীন প্রচেষ্টাগুলোর দিকে দৃষ্টি দিলে দেখতে পাই যে, ১৯১৮ খ্রিষ্টাব্দে নৈশ বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ । এরপর ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দে খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ ও নবাব আবদুল লতিফ প্রমুখের প্রচেষ্টায় গড়ে ওঠে বয়স্ক শিক্ষাকেন্দ্র। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ভি-এইড কার্যক্রমের আওতায় সফলভাবে পরিচালিত হয় বয়স্ক শিক্ষা কার্যক্রম। এরই ধারাবাহিকতায় ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রতিষ্ঠিত হয় ব্যুরো অব নন ফরমান এডুকেশন। ১৯৯১ খ্রিষ্টাব্দে আমাদের প্রাথমিক শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়। বর্তমানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হচ্ছে আর মেযেদের দেয়া হচ্ছে বৃত্তি। আমাদের সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে ছয় থেকে দশ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য বিনামূল্যে মৌলিক শিক্ষা প্রদানের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এগুলো সাক্ষরতা বৃদ্ধির ইতিবাচক পদক্ষেপ। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশের স্কুল ও কলেজে যেসব শিক্ষার্থীরা পড়াশুনা করছে তারা শতকরা কতজন প্রকৃত সাক্ষর? যিনি জীবনেও বিদ্যালয়ের চৌকাঠ মাড়াননি তার জন্য কোনোরকমে নিজের দস্তখত করতে পারাকেই আমরা লিটারেসি বলছি কিন্তু যেসব শিক্ষার্থী আট দশ বছর পড়াশোনা করেছেন তাদের লিটারেসি লেভেল বা সংজ্ঞা কি একই হবে? দেশে হাজার হাজার নয়, লাখ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে যারা লিটারেট নন। কারণ, তারা দেখে বাংলা বই পড়তে পারেন না। নিজের সম্পর্কে নিজ ভাষায় পাঁচটি বাক্য লিখতে পারেন না। ওই শর্তগুলো ছিলো ‘আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের’ প্রাথমিক কালের যদিও সেই সংজ্ঞা এখন সময় ও বিশ্ববাস্তবতায় বিরাট পরিবির্তনের দাবি রাখে। সেই পরিবর্তিত এবং অনুমিত সংজ্ঞার কথা না হয় বাদই দিলাম, প্রাথমিককালের সংজ্ঞার সঙ্গেও আমাদের বিরাট অঙ্কের শিক্ষার্থীরা যাচ্ছে না। সেই হিসেব আমরা কীভাবে রাখবো? রেখেছি কি? কখনোই রাখিনি। তারা কিন্তু রাষ্ট্র থেকে একটি সনদও লাভ করে যে, তারা অমুক শ্রেণি পর্যন্ত লেখাপড়া সমাপ্ত করেছেন। শিক্ষার মান নিয়ে যে কথাটি শিক্ষা সংশ্লিষ্টদের উদ্বিগ্নতার কারণ তার দিকে সরকার কোনো ভ্রুক্ষেপ না করে শুধুমাত্র সাক্ষরতার হার এতো শতাংশ বেড়েছে, শিক্ষিতের হার দেশে এতো শতাংশ বেড়েছে বলতে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টায় ব্যস্ত ছিলো।
তারপরে রয়েছে, অ্যানালগ লিটারেসি এবং ডিজিটাল লিটারেসি। বিষয়দুটেতো আসতে হবে। কারণ, অ্যানালগ লিটারেসি বলতে আমরা আপমর জনসাধারণের মাতৃভাষার অক্ষরের সঙ্গে পরিচিতি এবং সর্বনিম্ন পর্যায়ের ব্যবহারকে বোঝাচ্ছি, যা এ যুগে কোনো কাজের কথা বলে না। যারা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অধ্যয়ন করছেন তাদের মধ্যে লিটারেসির ধারণা, যারা কখনো বিদ্যালয়ে যাননি তাদের সঙ্গে এক হওয়ার কথা নয়। তারপরে আসে যারা শারীরিক শ্রম বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করেন তাদের লিটারেসি লেভেলের সঙ্গে এগুলো যাবে না। এরপর দেশের এক বিরাট জনগোষ্ঠী যারা নিজ নিজ কার্যক্ষেত্রে শ্রম, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান, দক্ষতা ও দিক নির্দেশনা দিয়ে থাকেন তাদের লিটারেসি কিন্তু পুরো আলাদা। কারণ, দৈনন্দিন ব্যবহৃত প্রযুক্তির সঙ্গে শুধু পরিচিতি নয়, এগুলো ব্যবহারে তাদের ফ্রেন্ডলি ও দক্ষ হতে হয় ও এটি সেখানে মৌলিক বিষয়। অথচ আমাদের অনেক অফিসের বিশেষ করে রাষ্ট্র পরিচালিত কার্যক্ষেত্রগুলোর অনেক বস কম্পিউটার টাচ করেন না, মেইল খোলা, মেইল পাঠানো ইত্যাদি বিষয়ে নির্ভরশীল অফিসের পিওন, ক্লার্ক কিংবা নিজ পিএ-এর ওপর। এখানে লিটারেসির সংজ্ঞা কি একই হবে? আমাদের উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা ব্যুরো দেশ থেকে নিরক্ষরতা দূর করার দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান-সেটি আসলে এক শ্বেতহস্তী। এই প্রতিষ্ঠানের দরকার ছিলো অবস্থা, পেশা, ভৌগলিক অবস্থান ইত্যাদিভেদে সাক্ষরতার সংজ্ঞা নির্ধারণ করা, গবেষণা করা, নির্দিষ্ট মেয়াদে সাক্ষরতার সর্বশেষ অবস্থা জাতিকে অবহিত করা এবং কী কী ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায় সেই পরামর্শ সরকার তথা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে প্রদান করা। কিন্তু তাদের যে কি কাজ আল্লাহ মালুম! শুধু প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর থেকে কোনো প্রজেক্ট এলো কিনা, প্রজেক্ট এলে সেখান থেকে কীভাবে লভ্যাংশ তোলা যায়, কীভাবে এনজিওর মাধ্যমে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করা যায়, দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরে ঘুরে উপঢৌকন গ্রহণ করা যায়-এসব নিয়েই ব্যস্ত। ট্রাডিশনাল ওয়ার্ক করে বর্তমান বিশ্ব বাস্তবতায় প্রকৃত সাক্ষরতা অবস্থা নির্ণয় ও বৃদ্ধিতে ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। সরকারকে অতিরিক্ত আর যে বিশেষটিকে গুরুত্ব দিতে হবে তা হচ্ছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকে লেভেলে যেসব শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা করেন তাদের মধ্যে এক বিরাট অংশ নিজ ভাষায় লিখিত বই-ই পড়তে পারেন না। সেটি যাতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: ক্যাডেট কলেজের সাবেক শিক্ষক