জেলে জনগোষ্ঠী পেলো আরডিআরসি’র পানির পাম্প

দৈনিকশিক্ষা প্রতিবেদক |

ঢাকার সাভার উপজেলার কাউন্দিয়া ইউনিয়নে প্রায় দুই শতাধিক জেলে পরিবারের জন্য সুপেয় পানির ব্যবস্থা করেছে নদী বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার’ (আরডিআরসি)।  গত শুক্রবার এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে কাউন্দিয়া শ্মশানঘাটে স্থাপিত পানির পাম্পটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হয়। 

অনুষ্ঠানে রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার বা আরডিআরসির চেয়ারম্যান ও নদী গবেষক মোহাম্মদ এজাজের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন আমিন বাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রকিব আহমেদ, ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী, চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভের প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান, বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নির্বাহী সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা। আরও বক্তব্য রাখেন তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটর সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক সরদার, আরিফুর রহমান, পরিবেশ সংগঠক আমিনুর রসুল, কাউন্দিয়া পুলিশ পাড়ির ইনচার্জ সাব-ইনেস্পেক্টর সুব্রত দাশ ও মোহাম্মদ রুমেলসহ অনেকে।   

অনুষ্ঠানে আমিন বাজার ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ রকিব আহমেদ বলেন, কাউন্দিয়া ইউনিয়নের হিন্দু-মুসলিম জেলেদের সার্বিক উন্নতির জন্য কাউন্দিয়া চেয়ারম্যানের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করবো। রিভার এন্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার কে নদী ও নদীর পাড়ের মানুষের সমস্যা ও সহয়তার জন্য ধন্যবাদ জানাই।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) নির্বাহী সদস্য ইবনুল সাঈদ রানা বলেন, আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে, তাহলে তুরাগ ও তার প্রকৃতিক দৃশ্য রক্ষা করা সম্ভব হবে, তুরাগ পাড়ে অবস্থিত কাউন্দিয়া বাগেরআক্রা শ্মশানঘাট হবে উল্লেখযোগ্য স্থান।  

ক্লাইমেট এক্সপার্ট মনির হোসেন চৌধুরী বলেন, তুরাগ নদীর পাড়ের জেলে জনগোষ্ঠীর সংস্কৃতি নদীর সঙ্গে সম্পর্কিত। নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে নদীতে মাছ নেই, জেলে পেশা পরিবর্তন হয়ে যাচ্ছে, বর্তমানে সংস্কৃতি ধরে রাখা কষ্টকর হচ্ছে। তুরাগ নদীর পাড়ের ফ্যাক্টরিগুলো নদীর পানি দূষিত করছে। আমাদের নদীর পানি দূষণ রোধে প্রধান বাধাগুলো চিহ্নিত করতে হবে। নদী দূষণ রোধ করতে পারলে নদীতে মাছ বৃদ্ধি পাবে, এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মানুষ আরো উন্নতি করতে পারবে এবং নিজেদের সংস্কৃতি ধরে রাখতে পারবে।  

তুরাগ নদী সুরক্ষা কমিটর সাধারণ সম্পাদক মাসুদুল হক সরদার বলেন, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের এই মহান উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। তুরাগ নদী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে আমরা জানতে পারি, তুরাগ নদীর পানি দূষণের কারণে নদীর পাড়ের জেলেরা বছরের ছয় মাস বেকার থাকে। এদের অনেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়ে যায়। তাই আমরা তুরাগ নদী দূষণ রোধে কাজ করে যাচ্ছি।

আমিনুল রসুল বলেন, নদী পাড়ের জেলেদের জীবন একরকম আবার সাগর পাড়ের জেলেদের জীবন আরেক রকম। জেলেরা মাছ আহরণের মাধ্যমে মাছের যোগান দিয়ে পুষ্টির চাহিদা পূরণ করে থাকে। কিন্তু জেলেদের কোনো পরিসংখ্যান নেই। যুগ যুগ ধরে নদীর পাড়ের জেলে জনগোষ্ঠী ঐক্যবদ্ধ ছিলো। রাষ্ট্রের নিকট তুরাগ পাড়ের জেলেদের তথ্য নেই বলে তুরাগ নদী পাড়ের জেলেদের কোন রেশনের ব্যবস্থা নেই। পর্যাপ্ত গবেষণা নেই বলে কতজন জেলের পেশা পরিবর্তন হয়েছে তার কোন তথ্য নেই। তাই নিজেদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে হলে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে হবে।

চেইঞ্জ ইনিশিয়েটিভ-এর প্রধান নির্বাহী জাকির হোসেন খান বলেন, রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টার তাদের কাজের মাধ্যমে নদী, পানি ও সম্পৃক্ত মানুষের সমস্যা তুলে ধরেছে। মানুষ বেঁচে থাকার জন্য সারা জীবন প্রকৃতি থেকে যে পরিমাণ অক্সিজেন গ্রহণ করে তার মূল্য আট হাজার কোটি টাকা। সভ্যতার উন্নয়ন হলেও পানি, বায়ু ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব। তুরাগ নদীর পানি নষ্ট করার মাধ্যমে মানুষ অকৃতজ্ঞতা ও আত্মঘাতীর পরিচয় দিয়েছে। মানুষ নিজেদের উন্নতি করতে গিয়ে পরিবেশ সবসময় দূষিত করছে। প্রাচীন সভ্যতাগুলো ধ্বংস হয়েছে মানুষের নিজেদের কারণে। তাই পরিবেশ দূষণ রোধে সবাইকে সচেতন হতে হবে। নেতৃস্থানীয়দের কাছে আমার আকুল আবেদন তুরাগ পাড়ের জেলেরা যাতে সুরক্ষা পায়।

উন্দিয়া পুলিশ পাড়ির ইনচার্জ সাব-ইনেস্পেক্টর সুব্রত দাশ বলেন, প্রাগঐতিহাসিক সময় থেকে নদীর মাছ আহরণের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে জেলেদের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। নদী টিকে থাকলে মানুষ টিকে থাকবে। তাই সবাইকে একসঙ্গে নদী দূষণ রোধে এগিয়ে আসতে হবে।

জেলে ব্যবসায়ী নিত্য রাজবংশী বলেন, একসময় তুরাগ নদীর পানি খাওয়া ও রান্নাবান্নার কাজে ব্যবহার হতো এবং নদীতে অনেক মাছ পাওয়া যেতো। কিন্তু এখন ফ্যাক্টরি থেকে বর্জ্য এসে নদীর পানি দূষিত হওয়ার কারণে মাছ মারা যায়। ছয় মাস মাছ না পাওয়ার কারণে বেকার থাকতে হয়। এতে সংসার চালাতে কষ্ট হয়, ঋণ নিতে হয়। আমাদের একটাই দাবি, আমরা তুরাগ নদী দূষণ মুক্ত চাই। আশা করি, সরকার আমাদের সমস্যা সমাধানে এগিয়ে আসবে।

জেলে ব্যবসায়ী সুসেন রাজবংশী বলেন, তুরাগ নদীর পাড়ের কাউন্দিয়া বাগেরআক্রা শ্মশান নয়টি গ্রামের শেষ অবলম্বন। কিন্তু তুরাগ নদী দূষণের পাশাপাশি শ্মশান ভেঙে যাচ্ছে। এই শ্মশান রক্ষা করতে সবার সহযোগিতা চাই।

জেলে ও ব্যবসায়ী নিরঞ্জন রাজবংশী বলেন, একসময় তুরাগ নদীর পানি খাওয়া যেতো কিন্তু এখন নদীর পানির স্পর্শ করা যায় না। নদীর পানি দূষণের কারণে মাছ পাওয়া যায় না। তাই এখন অনেকে অন্য পেশায় স্থানান্তরিত হয়। নদী দূষণের পাশাপাশি শ্মশান ভেঙে পড়ছে। তাই সরকারের কাছে আমাদের দাবি নদীকে দূষণমুক্ত করা এবং শ্মশান রক্ষার জন্য অনুদান দেয়া করা।

গৃহিণী কমলা রাজবংশী বলেন, তুরাগ নদীর পানি নষ্ট হওয়ার কারণে জেলেরা ছয় মাস বেকার থাকে। সংসার চালানোর জন্য ঋণ নিতে হয়। তখন ঋণের টাকা, মাসিক-সাপ্তাহিক কিস্তি পরিশোধ করতে অনেক কষ্ট হয়। সরকারের নিকট আমাদের দাবি, তুরাগ নদী রক্ষায়  যেন এগিয়ে আসে।

রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা তুরাগ নদীর পানি দূষণের কারণে নদী পাড়ের জেলে ও বেদে জনগোষ্ঠীর জন্য খাবার পানি সরবরাহের জন্য পানির পাম্প স্থাপন করে তাদের সঙ্গে সংহতি জানাচ্ছি। আমরা আরও দুটি পাম্প স্থাপনের আশ্বাস দিচ্ছি।

তিনি আরও বলেন, তুরাগ নদীর গবেষণায় আমরা লক্ষ্য করি নদীর পাড়ে বাইশটি জেলে গ্রাম রয়েছে। সাভার উপজেলায় অবস্থিত দশটি জেলেগ্রাম হলো- মাঝিরদিয়া, বাগিচারটেক, ঈশাখাঁবাদ, মেলারটেক, কাউন্দিয়া, গোলারটেক, কোটবাড়ি, বারয়ানি, বরাদপুর ও বেলতলি। এছাড়া আরও বারোটি গ্রাম গাজীপুরে অবস্থিত। সরকারের কাছে এই গ্রামগুলোর জেলেদের কোনো তথ্য নেই। কারণ, সরকারের কাছে পৌঁছানো হয়নি। জেলে ও বেদে জনগোষ্ঠীর উন্নতিতে সরকারকে কীভাবে যুক্ত করা যায় আমরা সেই চেষ্টা করবো।

তুরাগ নদী তীরে অবস্থিত বাইশটি গ্রামের জেলেদের নদীর পানি দূষণের কারণে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত বাধ্যতামূলক বেকার থাকতে হয়। তীব্র পানি দূষণের কারণে তখন নদীতে মাছ থাকায় জেলেদের অনেকেই অন্য পেশায় যুক্ত হন আবার অনেকে বেকার জীবন কাটাতে বাধ্য হন। নদীর পানি দূষণের কারণে এই সময়ে জেলে পরিবারগুলোকে পানি, স্বাস্থ্য, ও বেকার সমস্যা কাঁধে নিয়ে জীবন চালাতে হয়, তার সঙ্গে চলে ঋণের কিস্তির চাপ নিয়ে বেঁচে থাকার এক কঠিন লড়াই। খাবার পানি সরবরাহের জন্য এই পানির পাম্পটি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে জেলেদের জীবন সংগ্রামের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে অনন্য নজির স্থাপন করেছে রিভার অ্যান্ড ডেল্ট রিসার্চ সেন্টার। 

আলোচনা সভায় জেলে ও বেদে সম্প্রদায়ের প্রায় শতাধিক নারী-পুরুষ উপস্থিত ছিলেন। সভায় তাদের অনেকে পেশাগত ও অন্যান্য সমস্যা নিয়ে বক্তব্য রাখেন। অনুষ্ঠানে জেলেদের পরিবেশনায় ভিন্নরকম এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ - dainik shiksha শিক্ষকদের বদলির বিষয়ে সর্বশেষ শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে অধ্যাপক হচ্ছেন যারা ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের - dainik shiksha ভিসি নিয়োগের দাবিতে এবার উত্তরবঙ্গ ব্লকেড বেরোবি শিক্ষার্থীদের মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য - dainik shiksha মসজিদ ইবাদাতের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চারও একটি কেন্দ্র হতে পারে: ঢাবি উপাচার্য ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য - dainik shiksha ঢাকা বোর্ডের পরিদর্শক আবুল মনছুর ভূঁঞার ঘুষ বাণিজ্য দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! - dainik shiksha দীপু মনি-রতন সিন্ডিকেটের ফিরোজই শিক্ষা অধিদপ্তরের এ ডি! ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের - dainik shiksha ছাত্র আন্দোলনে নিহতদের ‘জাতীয় বীর’ ঘোষণার দাবি জামায়াতের ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি - dainik shiksha ভারতে পাঠ্যবই ছাপানোর বিপক্ষে ৯২ শতাংশ বাংলাদেশি ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী - dainik shiksha ভয়ংকর বিপদের মধ্যে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.012287855148315