কেবল পাঠদান আর পাঠ গ্রহণেই সীমাবদ্ধ নয়। চিন্তা-চেতনা, মেধা-মননের বিকাশ কেন্দ্রেও বিশ্বমানবের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করার চর্চা বিশ্ববিদ্যালয়ই প্রদান করে আসছে। বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, মতলবীদের কুমতলবী সৃষ্টির স্থান নয়, মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে তার অবস্থান। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো তার মূল অবস্থান থেকে সরে এসেছে ক্রমশ। বিশ্বে কোনো ধর্মাবলম্বী হওয়া অতি সহজ।
কিন্তু মানুষ হওয়া বড় কঠিন বিশ্ববিদ্যালয় এই শিক্ষাটা দিয়ে আসে যে, মানুষ হতে হবে। কিন্তু আজকের দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ঠিক উল্টো পথে যেন। মানুষ হওয়া নয়Ñ বিশেষ ধর্মাবলম্বী হওয়াটাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রের ব্রেন ওয়াশ করে হত্যাকারী-খুনিতে পরিণত করার মতো ‘ব্ল্যাক ম্যাজিক’ যারা শেখান তাদেরও নিশ্চয়ই বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিগ্রি রয়েছে। খুনের মধ্যে পাপমোচন ও স্বর্গপ্রাপ্তি বিরাজ করছে বলে এই যে উচ্চ শিক্ষিতদের খুনি বানিয়ে আত্মঘাতী পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা তাদের মানুষে উন্নীত করেনি, বরং নৃশংস খুনিতে পরিণত করেছে এবং তাদেরও খুন হতে হচ্ছে। জীবনের এই অপচয়, মানবের এই পরাজয় দেখে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর যে টনক নড়ছে না তা সমাজ টের পায়। আর পায় বলেই সমাজ দেখে শিক্ষার কদাকার দিক।
যেখানে মানবিকবোধ লুপ্ত, মানুষের মধ্যকার আত্মীয়তাবোধ নিঃস্ব, সভ্যতার দরজাগুলো বিনষ্ট, মমতাবোধ উধাও, এমন তারুণ্যের উদ্ভব বিপজ্জনক বৈকি! যে সময়ে তাদের দেশ, জাতি-সমাজকে সৃষ্টিশীলতা, কর্মকুশলতা, কর্তব্যনিষ্ঠা, দায়িত্ববোধে আকৃষ্ট করার কথা সে সময় তারা খুনি বনে যাচ্ছে এবং তা সীমাহীন এক কল্পিত স্বর্গের মোহে ভ্রান্ত জিহাদের টানে তারুণ্যকে বিভ্রান্তির চোরাবালিতে ঠেলে দেওয়ার পেছনে শিক্ষার কুফলই প্রণোদনা দিচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানী, মনস্তাত্ত্বিকরা বিশ্লেষণ করলে হয়তো স্পষ্ট হবে শিক্ষার্থীকে বিপথগামী করার নেপথ্যে শিক্ষা কোনো ভূমিকা রাখছে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় নিশ্চয়ই দস্যুবৃত্তির শিক্ষাদান কেন্দ্র নয়, দৈত্য-দানব তৈরির কারখানাও নয়, বর্বর মধ্যযুগীয় ধ্যান-ধারণার প্রসার ঘটানোও তার কাজ বা লক্ষ্য নয়। বরং এসবের বিপরীতে সত্যসন্ধ জ্ঞানদান করাই তার মুখ্য কর্তব্য। চরিত্র এবং বুদ্ধিবৃত্তি উভয়েরই উৎকর্ষ সাধনের জন্য শিক্ষা বিস্তার। শিক্ষার ফলে শিক্ষার্থীরা আত্মনির্ভরশীল এবং মিতব্যয়ী সংযমী হতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতি বেশ করুণই বলা যায়। প্রতি বছরই বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বিশ্বের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র্যাংকিং প্রকাশ করে থাকে। সেই তালিকায় কবেকার প্রাচ্যের অক্সফোর্ডখ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নামগন্ধই মেলে না, বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালগুলোর নাম দূরে থাক। দেখা যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যাবতীয় অর্জন হিসেবে যেসব সাফল্যের কথা উল্লেখ করা হয়, তার মধ্যে কোনো বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কিংবা সামাজিক কোনো তত্ত্বের প্রবর্তন থাকে না। থাকে রাজনৈতিক সংগ্রামের বিজয়োপাখ্যান।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় একশ’ চার বছরে পা রেখেছে এবারের পহেলা জুলাই। দিনটিকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনেক বছর ধরেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দিবস হিসেবে পালন করে আসছে। এ উপলক্ষে অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মাথা উঁচু করে দাঁড়াক। জ্ঞান- গরিমায় হয়ে উঠুক সমৃদ্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়টি আলোর দিশারী হয়ে উঠুক এই কামনা করি।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত সাংবাদিক, কবি ও মহাপরিচালক, প্রেস ইনস্টিটিউট বাংলাদেশ।