ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের ৫ কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ

দৈনিক শিক্ষাডটকম, জয়পুরহাট |

জয়পুরহাটের কালাই উপজেলায় অনিয়ম, দুর্নীতি এবং প্রতারণার মাধ্যমে ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত সরকারি অর্থ লুটপাটের ভয়াবহ অভিযোগ উঠেছে। স্থানীয় জনগণ প্রশাসনের নীরবতা এবং উদাসীনতায় গভীর হতাশা প্রকাশ করেছেন। বীর মুক্তিযোদ্ধা বাবু মনীশ চৌধুরী জানান, তিনি ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’র দুর্নীতির বিষয়ে যথাযথ কর্তৃপক্ষের কাছে বার বার তুলে ধরেছেন। কিন্তু তারা কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছেন না। সরকারের টাকাগুলো এভাবে লুটপাট হতে দেখে তারা হতাশ।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের আওতায় ‘চতুর্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি (পিইডিপি-৪)’র অধীনে ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ১৫ই ডিসেম্বর থেকে ৮-১৪ বছর বয়সের ঝরেপড়া শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়। কালাই উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় ৭০টি উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র পরিচালনা করার জন্য প্রায় ৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। যার দায়িত্বে রয়েছে লিড এনজিও  ‘সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস, জয়পুরহাট’ ও সহযোগী সংস্থা ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’। কিন্তু স্থানীয়দের অভিযোগ, তারা অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ করেছে।

অনুসন্ধানে জানা যায়, কর্তৃপক্ষের বিধি অনুযায়ী প্রতিটি শিখনকেন্দ্রে ২৫-৩০ জন শিক্ষার্থী থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে কোনো কেন্দ্রেই ৩০ জন শিক্ষার্থী নেই। অধিকাংশ শিখনকেন্দ্রে ১০-১২ জন শিক্ষার্থী রয়েছে, যারা বিভিন্ন মাদ্রাসা ও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী। আবার কোনো কোনো কেন্দ্রে শিক্ষার্থীই আসে না, ক্লাসও হয় না।

শুধু কাগজ-কলমে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি দেখানো হয়েছে। সরকারি অর্থ লোপাটের উদ্দেশ্যেই শিক্ষার্থীদের জন্য মানসম্মত শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন না করে তারা নামমাত্র মানুষের ঘরের বারান্দা, রান্না ঘর, আঙিনা, গোয়াল ঘর এবং দোকান ঘরে সাইনবোর্ড দিয়ে এসব শিখনকেন্দ্র স্থাপন করেছে, যেখানে কোনো ক্লাস হয় না। অন্যদিকে উপজেলা মনিটরিং কর্মকর্তাদের জন্য প্রতি মাসে বরাদ্দকৃত ১৫ হাজার টাকা ঠিক রেখে সুপারভাইজার ও শিক্ষকদের বেতনসহ সবকিছুতেই অনিয়ম হয়েছে। প্রতি জন সুপারভাইজার মাসিক পাবেন ১৫ হাজার টাকা কিন্তু তাদের দেয়া হচ্ছে ১০/১২ হাজার টাকা ও প্রতি শিক্ষক যেখানে মাসিক ৫০০০ টাকা পাবেন বলে কথা ছিল, সেখানে তাদের দেয়া হচ্ছে ৩৫০০ টাকা। শিক্ষাকেন্দ্রগুলোর জন্য বরাদ্দকৃত ভাড়া ও সাজসজ্জার খরচও আত্মসাৎ হচ্ছে। প্রতিটি কেন্দ্রের জন্য মাসিক ভাড়া ১,৫০০ টাকা এবং ডেকোরেশনের জন্য বরাদ্দ  ৫,০০০ টাকা। ৪৮ মাসের জন্য শিক্ষার্থীদের বরাদ্দকৃত মাসিক ভাতা জনপ্রতি ১২০ টাকা করে দেয়ার কথা থাকলেও সেটাও তাদের দেয়া হয় না। কার্পেটের জন্য ৫,০০০ টাকা এবং ফ্যান কেনার জন্য ৩,০০০ টাকা বরাদ্দ থাকলেও বাস্তবে কিছুই সরবরাহ করা হয়নি। এ ছাড়া, টিউবলাইট, পানির জার, স্টিলের ট্রাঙ্ক, জাতীয় পতাকা, সাইনবোর্ড, হাতলযুক্ত টুল, স্কুল ব্যাগ, স্কুল ড্রেস, শিক্ষার্থীদের আইডি কার্ড, টিচিং এইডস এবং গেমস উপকরণের অধিকাংশ সরঞ্জামই সরবরাহ করা হয়নি। কিন্তু বাস্তবে এই অর্থ দুর্নীতির মাধ্যমে লোপাট করা হয়েছে।

উপজেলার পাঁচটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’ সংস্থাটি নামমাত্র সাইনবোর্ড থাকার বিষয়ে ফারুক হোসেন, আমজাদ হোসেন, শফিকুর রহমান, রফিকুল ইসলাম, আবু জাফর, আয়নাল হোসেন, আজিবর রহমান, আব্দুল জলিল, সাহিদুর রহমান, শাজেদ আলি, সোহেল মিয়াসহ স্থানীয় অনেকেই অভিযোগ করে বলেন, কাগজ-কলমে ছাত্রছাত্রী দেখানো হলেও বাস্তবে কোনোদিন কেন্দ্রে ১০-১২ জনের বেশি শিক্ষার্থী আসে না। বেশির ভাগ সময় শিখনকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকে। মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অধিকাংশ ছাত্রছাত্রীদের এখানে ভর্তি দেখিয়ে সরকারের অর্থ লুটপাট ছাড়া কোনো কাজ হচ্ছে না। তাদের মতে, ‘এভাবে সাইনবোর্ড সর্বস্ব দুই একটি শিক্ষাকেন্দ্রে অপ্রাপ্ত বয়স্ক শিশু, মাদ্রাসা ও প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থী নিয়ে উপানুষ্ঠানিক শিক্ষাকেন্দ্র সচল দেখানো হয়েছে।’

অভিভাবক ওয়াহেদ আলী, সোহায়েব হোসেন, জালালুদ্দিন মণ্ডল, নূরজাহান খাতুন, জাহাঙ্গীর হোসেন, গোলাম সরোয়ার, নায়েব আলী, রিক্তা বেগম, জাহানারা বিবি, আকলিমা বিবি, রোকেয়া বেগম, মাহবুবা খাতুনও একই অভিযোগ করেছেন। তারা বলেছেন, “ভর্তির সময় আমাদের বাচ্চাদের অনেক কিছু দেয়ার আশ্বাস দিয়েছিল ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’র কর্মকর্তারা। কাপড়-চোপড় এবং ব্যাগ দেয়ার কথা থাকলেও শুধু বই আর খাতা ছাড়া আর কিছুই দেয়নি।”

‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’র কালাই উপজেলা প্রোগ্রাম ম্যানেজার জাহাঙ্গীর আলম জানান, কার্যক্রম পরিচালনায় কিছুটা ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকতে পারে। তারা জেলা অফিসের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করেন। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের জরিপ অনুযায়ী ঝরেপড়া শিক্ষার্থী নেই। তাহলে ৭০টি শিখনকেন্দ্রে ২১০০ শিক্ষার্থী কোথায় থেকে এসেছে, সে প্রশ্নের কোনো জবাব তিনি দেননি। 

‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’র নির্বাহী পরিচালক মো. গাওছুল আজমের সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমবার দিনাজপুর এবং দ্বিতীয়বার ঢাকায় গুরুত্বপূর্ণ মিটিংয়ে আছেন বলে ফোন কেটে দেন।

তবে, উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, “আমাদের স্কুল এলাকায় কোনো ঝরেপড়া শিক্ষার্থী নেই। বিভিন্ন স্কুল ও মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিয়ে উপানুষ্ঠানিক স্কুল চালাচ্ছে ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’। বেনামি ভুয়া শিক্ষার্থী দেখিয়ে তারা সরকারি টাকা লুটপাট করছে। তিনি ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে এই এনজিও’র বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন।”
জয়পুরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) বিপুল কুমার জানান, ‘এসো গড়ি, সোনার বাংলা’ এনজিও’র দুর্নীতি ও অনিয়মের বিষয়ে তিনি অবগত হয়েছেন। তিনি উপজেলা মনিটরিং কমিটির ওপর ক্ষুব্ধ, কেন তাদেরকে বিল প্রদানের জন্য সুপারিশ করেন! এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরকে দ্রুত আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জানানো হবে।


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি বিএনপির - dainik shiksha ৪৩তম বিসিএসের নিয়োগ প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি বিএনপির যশোর বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট - dainik shiksha যশোর বোর্ডের চেক জালিয়াতির মামলায় ১১ জনের বিরুদ্ধে দুদকের চার্জশিট র‍্যাগিং বন্ধে বুয়েটসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিশন গঠন - dainik shiksha র‍্যাগিং বন্ধে বুয়েটসহ উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কমিশন গঠন ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও - dainik shiksha ভর্তিযুদ্ধের জন্য প্রস্তুত হও শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি - dainik shiksha শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি গণহারে ফেলের অভিযোগ নিয়ে এনটিআরসিতে গেলেন যারা - dainik shiksha গণহারে ফেলের অভিযোগ নিয়ে এনটিআরসিতে গেলেন যারা দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0023250579833984