করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগাতার বন্ধের সুযোগে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে যুক্ত হচ্ছে শিশু শিক্ষার্থীরা। লকডাউনে ঘরবন্দি থাকায় বিষন্নতা, খেলাধুলার সুযোগের অভাব আর মানসিক চাপে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে মেধা-মনন, স্বাস্থ্য-সুরক্ষাসহ সৃজনশীল প্রতিভা বিকাশ। জড়িয়ে পড়ছে মোবাইল গেমস, ইন্টারনেটে অশ্লীল ওয়েবসাইটসহ নানা ধরণের ঝুঁকিপূর্ণ আসক্তিতে। দারিদ্রের কষাঘাতে ঝরে পড়েছে অনেকে। স্কুলের গণ্ডি না পেড়োতেই বাল্যবিয়ের শিকার হয়েছেন ছাত্রীরা। এসব ঝরে পড়া শিক্ষার্থীরা আগের মতো স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফিরবে কি না তা নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়ছে অভিভাবকদেরও।
করোনা পরিস্থিতির অনিশ্চয়তার গ্যারাকলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। গ্রামের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রছাত্রীদের সরাসরি অংশগ্রহণের সুযোগ নেই। অনলাইন ক্লাসের নামে মাঝে মধ্যে ফেসবুকের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেবল শিক্ষকদের ক্লাসের ভিডিও আপলোড করতে দেখা যায়।
পটুয়াখালীর বাউফলের ধানদী গ্রামের ফিরোজ চৌকিদারর ছেলে রিফাতের বয়স ১৫ বছর। ওই এলাকার ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়োর দশম শেণির ছাত্র। স্কুল থেকে বই নেয়ার পরে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় আনুষ্ঠানিক ক্লাসে আর যাওয়া হয়নি তার। অটোরিকশা চালক বাবার আয়ে দুই ভাইবোনসহ চার জনের সংসার চলছে না কোনমতে।
আরও পড়ুন : দৈনিক শিক্ষাডটকম পরিবারের প্রিন্ট পত্রিকা ‘দৈনিক আমাদের বার্তা’
তিন ছেলেমেয়েসহ পাঁচ জনের সংসার ঠিকমতো চলছে না একই গ্রামের বাদশা চৌকিদারেরও। বাদশা চৌকিদারের ছেলে রবিউল একই এলাকার ধানদী ফাজিল মাদরাসা থেকে এবার দাখিল পরীক্ষায় অংশ গ্রহণের অপেক্ষায় আছে। প্রতিবেশী রিফাত আর রবিউল এই দুইজন এ বয়সেই নিজ নিজ সংসারের বাড়তি আয়ের জোগান দিতে স্থানীয় বশার চৌকিদারের সাথ দিনমজুর হিসেবে মাটি কাটার কাজ করছেন। কখনো স্থানীয় পরিমাপে কুয়া প্রতি মাটির মজুরির ১ হাজার টাকার অংশে রোজ হিসেবে ওরা পায় আড়াইশ’ থেকে ৪০০ টাকা। আর এই টাকায় চলছে ওদের সংসার।
মহামারি করোনায় গত ১৬ মার্চ ক্লাস শেষে বন্ধ হয়েছে স্কুল। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে এলে স্কুল খুলেই সম্ভাব্য পরীক্ষা বিষয়টি মাথায় থাকলেও মাটি কাটার কাজের আয়ে এ সময়ে বিপাকে থাকা নিজ হতদরিদ্র পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা ওদের। অনলাইন ক্লাসের মতো ওদের স্কুলের দু’একজন শিক্ষক মাঝে মধ্যে ভিডিও আপলোড করলেও এ্যান্ড্রয়েট মোবইলফোন না থাকায় তা দেখার সুযোগ নেই ওদের।
পাশের নিমদী গ্রামের নুরু গাজীর ছেলে সুজন গাজী ওই ধানদী আদর্শ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির আরেক ছাত্র। স্কুলে ক্লাস না থাকার কারণে সে এখন পুরোদস্তুর অটোরিকশা চালক।
দৈনিক আমাদের বার্তার ইউটিউব চ্যানেলটি সাবস্ক্রাইব ও ফেসবুক পেইজটি ফলো করুন
হতাশার কথা, সুজন গাজী, রিফাত ও রবিউলের মতো অনলাইন ক্লাস কিংবা ইন্টারনেটে ক্লাসের পাঠদানে অংশ নেয়ার মতো কোন রকমের স্মার্টফোন বা ল্যাপটপ ওই উপজেলার অধিকাংশ স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীর নাগালের বাইরে। আরও জানা গেছে, কারো কারো হাতে স্মার্টফোন থাকলেও ইন্টারনেটে শিক্ষামূলক অংশগ্রহণের চেয়ে অনলাইন গেমস খেলে, নানা অশ্লীল ওয়েবসাইটে বেশি সময় কাটে তাদের।
করোনা পরিস্থিতির এ সময়ে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িয়ে পড়ছে অস্বচ্ছল শিক্ষার্থীদের অনেকেই। জড়িয়ে পড়ছে শৈশবের সৃজনশীল দুরান্তপনার পরিবর্তে মোবাইল গেমস, ইন্টারনেটের খারাপ ব্যবহারেও। হাজার হতদরিদ্র, জেলে, ছিন্নমূল, মানতাসম্প্রদায় ও চরের ভূমিহীন পরিবারের এসব শিশুদের অন্ন-বস্ত্র, চিকিৎসা কিংবা শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। দিন দিন মাদকসহ শিক্ষায় অনিশ্চয়তায় ধাবিত হচ্ছে এসব শিশুরা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠদান আর শিক্ষা ব্যবস্থায় করোনা পরিস্থিতি আমূল পরিবর্তন আনবে। এ ক্ষেত্রে কেবল বিনামুল্যে বই বিতরণ কিংবা উপবৃত্তি প্রদানই হতদরিদ্র শিশু-কিশোরদের শিক্ষা ক্ষেত্রে অগ্রসরের পথ হতে পারে না। অনগ্রসর এই জনগোষ্ঠিকে এগিয়ে নিতে হলে মোবাইল গেমস, ইন্টারনেটের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। ইন্টারনেটের অপব্যবহার নিয়ন্ত্রণে কোন অ্যাপস বা সফটওয়্যারযুক্ত করে উপবৃত্তি কিংবা সরকারি বই বিতরণের মতো বিনামূল্যে নেটবুকের আদলে কোন উন্নত ডিভাইস দেয়া এখন জরুরি হয়েছে।
বাউফল পৌর সদরের ফারুক তালুকদার মহিলা কলেজের রসায়ন বিভাগের শিক্ষক অহিদুজ্জামান সুপন দৈনিক শিক্ষাডটকমকে জানান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পরিসংখ্যান অনুযায়ী উপজেলায় ৮ থেকে ১২ বছর বয়সের ১০ হাজারের বেশি শিশু রয়েছে।
করোনা পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে তা অনিশ্চিত। আবার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও এসব শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীদের স্বাভাবিক শিক্ষাজীবনে ফেরা নিয়ে আছে অনিশ্চয়তা। এদের অনেকের আবার বাইরে ঘুরে বেড়ানো মানুষের সঙ্গে মেলামেশার দক্ষতা, ইচ্ছা ও আকাঙ্খা কমে যাচ্ছে। মানসিক হতাশায় ভোগার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। ঘরবন্দি থেকেও এদের শিক্ষার সুযোগ যথেষ্ট নয়। ইন্টারনেট সেবা ছড়িয়ে পড়লে নানা রকমভাবে অনেকে আর্থিক ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে খরচ মেটাতে। অভিভাবকদের উচিত পরিপক্কতা, দায়িত্বশীলতা এবং ভালো বিচারক্ষমতা সৃষ্টি না হওয়া পর্যন্ত শিশু-কিশোরদের সঙ্গে থাকা। সরকারেরও উচিত করোনাকালের শিক্ষায় এসব শিশু-কিশোর শিক্ষার্থীর অন্তরায়গুলো চিহ্নিত করে তা উত্তরণে সময়োপযোগি পদক্ষেপ নেয়া।