টিএসসির অবকাঠামোর চেয়ে সৃজনশীল কাজে মনোনিবেশ জরুরি

মাছুম বিল্লাহ |

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-ছাত্র কেন্দ্র যা টিএসসি নামে আমরা সবাই জানি ও চিনি সেটিকে  নতুন করে গড়ার লক্ষ্যে  কাজ শুরু করেছে সরকারের গণপূর্ত অধিদপ্তর। এর ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে বলা যায়, গত ২ সেপ্টেম্বর ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে  এক অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি ভবনটিকে তিনি আধুনিক ভবন হিসেবে দেখতে চান। সেই লক্ষ্যে তিনি ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ভবনের নকশা প্রস্তত করার নির্দেশ দিয়েছেন। আমরা জানি বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। তাঁর ভালবাসার জায়গা থেকেই  তিনি একথা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়।”

যেহেতু টিএসসি ছাত্র ও শিক্ষকদের কেন্দ্র, তাই আমরা টিএসসি ভবনকে আধুনিক পদ্ধতিতে নতুন করে গড়তে চাই।’ তারই ধারাবাহিকতায়  ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের ’ সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারনের উদ্যোগে’র বিষয়ে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মতামত জানতে চেয়েছে প্রশাসন। উপাচার্যের নির্দেশনা অনুযায়ী ২৪ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান প্রকৌশলী আবুল কালাম সিকদার অনুষদগুলোর ডিন ও ইনস্টিটিউটগুলোর পরিচালকদের কাছে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে মতামত জানতে চেয়েছেন । বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সদয় নির্দেশনায় টিএসসি-র সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। টিএসসির সার্বিক উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রত্যাশা ও সুপারিশ আহবান  করা যাচেছ। বিজ্ঞপ্তিতে ২ জানুয়ারী২০২১ -এর মধ্যে মতামত ও সুপারিশ পাঠানোর জন্য অনুরোধ করা হয়। 

গণপূর্তের কর্মকর্তারা বলেছেন এটি হবে সম্পূর্ন নতুন আঙ্গিকের একটি প্রকল্প। আধুনিক সুবিধা সংবলিত একটি নান্দনিক বহুতল কমপ্লেক্স হবে টিএসসি। টিএসসির ভারপ্রাপ্ত পরিচালক তার দেওয়া তালিকায় নতুন কমপ্লেক্সে যেসব সুযোগ-সুবিধার কথা বলেছেন সেগুলো হচেছ---সাংস্কৃতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য মহড়াকক্ষ, ব্যায়ামাগার, টিএসসিভিত্তিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর জন্য আধুনকি সুবিধাসংবলিত কক্ষ, আন্তক্রীড়াকক্ষ, পৃথক ক্যাফেটেরিয়া, শিক্ষক মিলনায়তন, গাড়ি পার্কিংয়ের জন্য তিন তলাবিশিষ্ট স্থান, অতিথিকক্ষসহ বেশ কিছু আধুনিক সুবিধা। পরিচালক বলেন, তাদের দেওয়া তালিকা অনুয়ায়ী নতুন অবয়বে টিএসসিতে তিনটি মিলনায়তন থাকবে, যেগুলোর একটিতে প্রায় দেড় হাজার ও অন্য দুটির প্রতিটিতে ৩০০ জনের ধারণক্ষমতা থাকবে।  

কমপ্লেক্সের দ্বিতীয়  বা তৃতীয় তলায় নতুন একটা সুইমিং পুল নির্মান করা হবে। টিএসসি ভবন নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যে আলোচনা শুরু হয়।  এ বিষয়ে উপাচার্য বলেন, ” ১৯৬৪ খ্রিষ্টাব্দে টিএসসি নির্মিত হয়েছিল। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিল  তিন হাজার ৮০০জন, শিক্ষকের সংখ্যা ছিল ২০০ এর কিছ বেশি। এটি বিবেচনায় রেখে এটুকু জায়গায় টিএসসি ভবন, মিলনায়তন ও ফ্যাসিলিটিজ তৈরি করা হয়েছিল। আজ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই হাজারের বেশি শিক্ষক আর চল্লিশ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী আছেন। কিন্তু টিএসসি আগের মতোই আছে। প্রধানমন্ত্রী সে জন্যই আমাদের এটা পুনর্বিন্যাস করার নির্দেশান দিলেন।’’ এটি অবশ্যই যুক্তির কথা। 

কিংবদন্তী গ্রিক স্থপতি কনস্ট্যান্টিন ডক্সিয়াডিস ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের শুরুর দিকে টিএসসির নকশাটি করেন। নকশা করার ক্ষেত্রে তিনি এ দেশের সংস্কৃতি ও আবহওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখেছিলেন। তার পুরো নাম কনস্ট্যানটিন অ্যাপোস্টলোউ ডক্সিয়াডিস। তিনি এ দেশের গ্রামীণ বসতির চিরায়ত ঐতিহ্য থেকে অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন।  বাংলাদেশের গ্রামীণ পরিসরে ও স্থাপনার প্রাণকেন্দ্রে উঠান থাকে, সেটিকে কেন্দ্র করে মানুষ ঘর করে বসবাস করে। টিএসসি-র  প্রাণকেন্দ্রে উঠানোর মতোই মাঠ রয়েছে, সেটিকে কেন্দ্র করে দৃষ্টিনন্দন স্থাপনা ও শিক্ষার্থীদের কোলাহল। ডক্সিয়াডিস শুধুমাত্র টিএসসির স্থপতিই নন, তিনি ঢাকার হোম ইকোনমিকস কলেজ, কুমিল্লার বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন একাডেমিসহ কিছু স্থাপনার নকশা করেন। তিনি আন্তর্জতিকভাবে স্বীকৃত ও সমাদৃত। এশিয়া, ইউরোপ, আমেরিকা ও আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে নান্দনিক স্থাপনার নকশা করেছেন। তিনি ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ জুন ৬২ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সংবাদপত্র নিউইয়র্ক টাইমস লেখে, ডক্সিয়াডিসের কাজ বিশ্বজুড়ে কোটি মানুষের জীবনকে ছুঁয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-পরবর্তী সময়ে গ্রিসের পুনর্গঠনে যে স্থপতিরা ভূমিকা রেখেছিলেন, তাদের অন্যতম ডক্সিয়াডিস।

তিনি নিজের কাজে ঐতিহ্য ও নতুন ধারণার সংমিশ্রণ ঘটিয়েছেন, যার পূন:প্রকাশ আমরা টিএসসি-র নকশায় দেখতে পাই। পৃথিবীর বিবর্তনের সবচেয়ে শক্তিশালী অলিখিত ইতিহাস হচেছ স্থাপত্য।  আমরা বইয়ের পাতায় যে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা জানতে পারি তার চেয়েও উজ্জলতম সাক্ষ্য বহন করে  ইট-চুন-সুরকিতে লেখা ইতিহাস যা  সহজে হারায় না। এগুলো সভ্যতার ধারক ও বাহক। টিএসসি আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের সাক্ষী। এটি শুধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের  নয়, গোটা জাতির সম্পদ, গোটা জাতির ইতিহাসের সাক্ষী। 

আর তাই দেশের বিশিষ্টজনেরা মন্তব্য করেছেন, টিএসসির উন্নয়ন কিংবা পুননির্মাণ করতে  হলে ইতিহাস বা ঐতিহ্যকে সাথে নিয়েই করতে  হবে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, ’ আমরা উন্নয়ন চাই। কিন্তু তার জন্য টিএসসি ভাঙ্গা মোটেই গ্রহনযোগ্য হবেনা। কারন সব  কিছুরই তো একটা ঐতিহ্য এবং নিজস্বতা আছে। কার্জন হল বা সলিমুল্লাহ হল যেমন আমরা ভাঙ্গতে চাইবনা, তেমনি একটি ঐতিহ্যবাহী টিএসসিও ভাঙ্গতে চাইনা। ”ঢাবির সাবেক শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ তার ফেসবুকে লিখেছেন, ’ পৃথিবীর নামকরা সব বিশ্ববিদ্যালয়কে  ছবি দেখেই চেনা যায় কিছু ঐতিহ্য ধারণ করা স্থাপনার মাধ্যমে। শত শত বছরের পুরনো হয়ে গেলেও এগুলোকে সযতেœ সংরক্ষন করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন স্থাপনার মধ্যে আছে কার্জন হল, এসএম হল ও টিএসসি। এর মধ্যে টিএসসি ষাটের দশকে নির্মিত অপেক্ষাকৃত আধুনিক স্থাপত্যের একটি সুন্দর নিদর্শন। বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রামের পুর্ববতী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের ঐতিহ্য ধারণ করে টিএসসি। রক্ষনাবেক্ষনের বদলে এটিকে ভেঙ্গে এখন বহতল ভবন নির্মানের আয়োজন চলছে। ”নগরপরিকল্পনা ও পরিবেশবিদ স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “ স্থাপত্য এবং সাহিত্য মানবসমাজের দুই প্রধান অঙ্গ। যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে একটি জাতির ইতিহাস বলতে পারে।ঢাকার আধুনিক স্থাপত্যের প্রথম উদাহরণগুলোর মধ্যে অন্যতম একটি হচেছ টিএসসি। ডক্সিয়াডিসের এমন একটি স্থাপত্য ভেঙ্গে দেওয়ার অর্থ হচেছ এই শহরের ইতিহাস মুছে ফেলার প্রচেষ্টা।”

আমরা জানি এবং বহুবার বিভিন্ন মিডিয়ায় এসেছে, ঢাকা বিম্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা  অমানবিক জীবনযাপন করেন গণরুমগুলোতে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মেধাবীরা এখানে আসেন জ্ঞান আহরণ করতে কিন্তু তাদের হলে থাকার জায়গা হয়না দুই তিন বছরেও। ফলে তারা পড়াশনায় মনোযোগ দিতে পারেননা। জোর করে কোন এক পার্টির খাতায় নাম লেখাতে হয় হলে থাকার জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এগুলো দেখেও না দেখার ভান করেন। এই বাস্তবতার কথাও মনে রাখতে হবে। কর্তৃপক্ষের যদি অর্থই থেকে থাকে তাহলে প্রথমেই নিশ্চিত করা উচিত দেশের মেধাবী শিক্ষার্থীদের জন্য থাকার সুবন্দোবস্ত করা যাতে তারা পূরোপুরি মনোনিবেশ করতে পারেন পড়াশুনায়, গবেষণা কাজে, দেশ ও সমাজের বৃহত্তর কল্যাণের কাজে। তারপরে আসে তাদের হলের ক্যান্টিন ও খাবারের দুরবস্থার কথা। ঢাবি ক্যাম্পাসে প্রয়োজন একটি উন্নতমানের আধুনিক সেন্ট্রাল ক্যাফেটেরিয়া যেটি কোন দলের হবেনা, উন্মুক্ত থাকবে সকল দলের ও মতের শিক্ষার্থীদের জন্য। মুক্তবুদ্ধির চর্চার জায়গা হবে গোটা ক্যাম্পাসে। এ বিষয়গুলো নিশ্চিত করা প্রয়োজন সবার  আগে। আমাদের মনে রাখতে হবে, টিএসসি এক সময় নানামুখী কর্মকান্ডে অনেক বেশি মুখর থাকতো। এখন কিন্তু সেরকম আর নেই। তাই অবকাঠামোগত পরিবর্তনের চেয়ে শিক্ষার্থীদের নানাবিধ সৃজনশীল কর্মকান্ডে সত্যিকার অর্থে  আগ্রহী করে তোলা , মুক্তবুদ্ধির চর্চা করার সুযোগ তৈরি করা, ডাকসু-কে প্রকৃতঅর্থে সচল ও প্রাণবন্তু করার মাধ্যমে  টিএসসিকে আরও বেশি গতিশীল করা প্রয়োজন। 

লেখক : মাছুম বিল্লাহ, শিক্ষা বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য - dainik shiksha হাইকোর্টের আদেশ পেলে আইনি লড়াইয়ে যাবে বুয়েট: উপ-উপাচার্য প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে - dainik shiksha প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগ: তৃতীয় ধাপের ফল প্রকাশ হতে পারে আগামী সপ্তাহে ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা - dainik shiksha ভূমির জটিলতা সমাধানে ভূমিকা রাখবেন নবম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক - dainik shiksha সর্বজনীন শিক্ষক বদলি চালু হোক ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি - dainik shiksha ডিপ্লোমা প্রকৌশলীদের বিএসসির সমমান দিতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কমিটি রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার - dainik shiksha রায় জালিয়াতি করে পদোন্নতি: শিক্ষা কর্মকর্তা গ্রেফতার কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0059030055999756