ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নতুন সরকার গঠন শেষে দীর্ঘ ১১২ দিন পর ক্লাসে ফিরেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। মাঝে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে বিশ্ববিদ্যালয় ও সামগ্রিক শিক্ষাব্যবস্থায়। পরিবর্তনের ধারাবাহিকতায় এবার ডাকসু নির্বাচন দেওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যেই এ নির্বাচন হতে পারে বলে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে। আগামী জানুয়ারিতেই ডাকসু নির্বাচনের ভোটগ্রহণের লক্ষ্যে ইতিমধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে আন-অফিশিয়াল একাধিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে বলেও জানা গেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্যের দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই অধ্যাপক নিয়াজ আহমেদ খান আবাসিক হলগুলোতে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন এবং সব হলেই তিনি দ্রুত ডাকসু নির্বাচন হবে বলে শিক্ষার্থীদের আশ্বস্ত করেছেন। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিয়াশীল ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে বৈঠক করে ক্লাস এবং একাডেমিক কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর ডাকসু নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হবে বলেও ছাত্রসংগঠনগুলোকে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কার্যালয়ে সে বৈঠকে উপাচার্য নিয়াজ আহমেদ খান, দুই উপ-উপাচার্য মামুন আহমেদ ও সায়মা হক বিদিশা, কোষাধ্যক্ষ জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী ও প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ এবং ক্যাম্পাসের ১০ ছাত্রসংগঠনের নেতারা উপস্থিত ছিলেন। মতবিনিময়ে অংশ নেওয়া সব ছাত্রসংগঠনের নেতারা ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের পরিবর্তে প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং স্বল্প সময়ের মধ্যে ডাকসু ও হল সংসদ কার্যকর করার দাবি জানান।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডাকসু নির্বাচন আয়োজন নিয়ে ছাত্রসংগঠনগুলোর মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। উপাচার্য কার্যালয়ের সভায় ছাত্রশিবিরের উপস্থিতিও অনেক সংগঠন স্বাভাবিকভাবে নেয়নি। এর পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্র ইউনিয়নের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ এবং ছাত্র ফ্রন্টের নেতা সোহাইল আহমেদ পরিবেশ সংসদ কার্যকরের দাবি জানিয়েছেন। উল্লেখ্য, ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিবেশ সংসদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক ক্যাম্পাসে শিবিরের কার্যক্রমে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে।
ডাকসু নির্বাচন ইস্যুতে বিএনপির ছাত্রসংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল এবং অন্যান্য বামপন্থি সংগঠনগুলো প্রয়োজনীয় সংস্কার এবং ডাকসুর গঠনতন্ত্র সংশোধনের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। ছাত্রদলের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি গণেশ চন্দ্র রায় বলেন, সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসসহ সারা দেশই যেন ট্রমাটাইজড হয়ে আছে। দীর্ঘদিনের ফ্যাসিবাদের প্রভাবে পুলিশ বাহিনীসহ প্রশাসনের সব কাঠামো প্রায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে চলে গেছে। ছাত্রলীগের রোষানলে পড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক ছাত্রছাত্রী নতুন করে হলে উঠছে। ছাত্রদলসহ ফ্যাসিবাদবিরোধী ছাত্রসংগঠনসমূহ অনেক বছর পরে মুক্তভাবে ক্যাম্পাসে সহাবস্থান করতে পারছে। এ অবস্থায় খুব জরুরিভিত্তিতে বা খুব দেরিতে ডাকসু নির্বাচনের মানে হতে পারে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড নষ্ট করা। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের উচিত যত দ্রুত সম্ভব একটি রোডম্যাপ প্রকাশ করা, যাতে করে মোটা দাগে এসব ভয়ংকর ট্রমা কাটিয়ে ওঠার পর শিক্ষার্থীরা সুন্দর মনমানসিকতা নিয়ে উৎসবমুখর পরিবেশে ডাকসু নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে।
ছাত্র ফেডারেশনের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আহ্বায়ক আরমানুল হক বলেন, ডাকসু নির্বাচন আয়োজন করার সিদ্ধান্ত বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন আমাদের জানিয়েছে, সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানাই। তবে এক্ষেত্রে প্রশাসনকে প্রথমে সুষ্ঠু নির্বাচনের মাঠ তৈরি করতে হবে। হলগুলোতে কোনো রাজনৈতিক দখলদারিত্ব নেই, তা নিশ্চিত করতে হবে এবং একই সঙ্গে ডাকসু গঠনতন্ত্রের যৌক্তিক সংস্কার করতে হবে।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বলছে ডাকসু নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিলেও প্রয়োজনীয় স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আরও আলোচনা না করে চূড়ান্ত দিনক্ষণ ঘোষণা করবেন না তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক সায়মা হক বিদিশা বলেন, প্রাথমিকভাবে ডাকসুর আগে আমরা সব বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে ক্লাস শুরুর ওপর গুরুত্ব দিচ্ছি। ছাত্রসংগঠনগুলোর সঙ্গে ডাকসু নিয়ে আলোচনা হয়েছে, ডাকসু নির্বাচন আমাদের চিন্তায়ও আছে। তবে সব স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে এ বিষয়ে আরও আলোচনা প্রয়োজন। এরপর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত আমরা জানাতে পারব।
এর আগে দীর্ঘ ২৮ বছর পর ২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে সর্বশেষ ডাকসু নির্বাচন হয়। সে নির্বাচনের মাধ্যমে সচল হয় ডাকসু ও ১৮টি হল সংসদ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ অনুযায়ী প্রতি বছর নির্বাচন হওয়ার কথা থাকলেও পাঁচ বছরেও আর ডাকসু নির্বাচন দেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। অধ্যাদেশ অনুযায়ী, ডাকসু মনোনীত পাঁচ জন শিক্ষার্থী প্রতিনিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের নীতিনির্ধারণী ফোরাম সিনেটের সদস্য হন। এ আনুষ্ঠানিক ফোরামে তারা শিক্ষার্থীদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নীতিনির্ধারকদের সামনে তুলে ধরার সুযোগ পান। কিন্তু নির্বাচন বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সিনেটে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধিত্বও বন্ধ হয়ে গেছে।