স্মৃতিতিয়াসডিগবাজার রোড থেকে নর্থব্রুক হল রোড

মনোয়ার হোসেন |

ভিক্টোরিয়া পার্ক (তখনও বাহাদুর শাহ পার্ক নামকরণ হয়নি) এর দক্ষিণ পূর্ব দিকে মুসলিম হাই স্কুল। তার গা ঘেঁষে যে রাস্তাটি সোজা দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হয়ে লালকুঠি পর্যন্ত গেছে, সেটার নাম ছিলো ডিগবাজার রোড। 

লাল রঙা দালান বলে লালকুঠি। আসলে এর নাম নর্থব্রুক হল। ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড নর্থব্রুকের (১৮৭২-৭৬খ্রি:) সম্মানে এই ভবনটি নির্মাণ এবং নামকরণ করা হয়। গভর্নর জেনারেলের ঢাকা সফর (১৮৭৪ খ্রি:) উপলক্ষে এই ভবন (আসলে টাউন হল) বুড়িগঙ্গার তীরে নির্মিত হয়। আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় ১৮৮০ খ্রিষ্টাব্দে।

ভবনটি দেখতে অনেকটা কার্জন হলের মত। সুন্দর স্থাপত্য। এর সাথেই কিছুটা পেছন দিকে রয়েছে নর্থব্রুক হল পাঠাগার। এই লাইব্রেরিতে অনেক দূর্লভ বই রয়েছে যেগুলো গবেষণার জন্য খুব সহায়ক। পরিচিতদের মধ্যে আহমদ ছফা ষাটের দশকের শেষের দিকে প্রায় প্রতিদিনই তাঁর গবেষণা কার্যক্রম উপলক্ষে এই লাইব্রেরিতে কয়েক ঘণ্টা অতিবাহিত করতেন। পরবর্তীতে নর্থব্রুক হলের কারণেই ডিগবাজার রোডের নতুন নামকরন হয় নর্থব্রুকহল রোড। এলাকার নাম বাংলাবাজার। 

ডিগবাজার রোড বা নর্থব্রুক হল রোডে অবস্থিত যে বাড়িতে আমরা থাকতাম তার সামনের রাস্তাটি মসৃণ ছিলো না। আংশিক পিচঢালা। সারাদিনে ২৫/৩০ টির বেশি গাড়ি চলাচল করতো না। এরমধ্যে বেশিরভাগ ছিলো ঢাকা নারায়ণগঞ্জ বাস সার্ভিস ও ট্যাক্সি সার্ভিসের কিছু ট্যক্সি। বাসস্ট্যান্ডটি ছিলো ভিক্টোরিয়া পার্কের ঠিক পূর্বদিক ঘেঁষে। তখন পার্কটি আয়তনে বেশ বড় ছিলো। ট্যাক্সি স্ট্যান্ডটি ছিলো স্টেট ব্যাংক অব পাকিস্তান আর স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বিল্ডিং এর মাঝখানের রাস্তায় জগন্নাথ কলেজের (বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়) ঠিক পূর্বদিকে। প্রাইভেট গাড়ির মধ্যে মাঝে মাঝে ডা. নন্দির কালো রঙ এর মরিস মাইনর গাড়ি দেখা যেতো। আর ছিলো জমিদার সুধীর বাবুর একটি গাড়ি, সম্ভবত অস্টিন। রিকশার প্রচলন ছিলো সীমিত। তবে অনেক ঘোড়ার গাড়ি চলাচল করতো। এর মধ্যে সুধীর বাবুর একটা এক্কা গাড়িও ছিলো। এছাড়া কিছু সরকারি জিপ গাড়ি চলাচল করতো। 

আমাদের বাড়ির ঠিক উল্টোদিকে ছিলো প্রেসিডেন্সি লাইব্রেরির স্বত্ত্বাধিকারী অনিল ঘোষের বিরাট বাড়ি। তাঁর লাইব্রেরি বা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অবিভক্ত বাংলায় সম্ভবত সর্ব বৃহৎ। আমাদের নিকটতম প্রতিবেশী, উত্তরদিকে ছিলেন বিপিন বিহারী ভাওয়াল (উকিল)। আর দক্ষিণ দিকে জগন্নাথ সাহা (উকিল)। আর আমাদের বাড়ির ঠিক পাশের বাড়িটি ছিলো ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস এর ঢাকা অফিস। এখান থেকে বড় গাড়িতে করে যাত্রীদের তেজগাঁও বিমানবন্দরে নিয়ে যাওয়া হতো। আর সেখান থেকে ঢাকায় আগত যাত্রীদের নিয়ে আসা হতো। কলকাতা থেকে তখন উড়োজাহাজে স্টেটসম্যান পত্রিকা ঢাকায় আসতো। সেগুলো বিতরণ হতো পাশের জগন্নাথ বাবুর বাড়ির আঙিনা থেকে। এ কারণে দুপুরে সামান্য জনসমাগম হতো। 

অনিল ঘোষের বাড়ির ঠিক দক্ষিণে ছিলো এক মাড়োয়ারির কয়লার আড়ত আর কালী মন্দির। সেখান থেকে প্রচুর কয়লা বিক্রি হতো। এই মাড়োয়ারি ছিলেন দেবী কালীর ভক্ত। কাজেই কালীপূজার সময় আতসবাজী আর বোম-পটকার আওয়াজে রাতের ঘুম ব্যাহত হতো। পরবর্তীতে মাড়োয়ারির বিশাল আঙিনাটি হয় বিক্রি নতুবা দখল হয়ে যায়। সেখানে নতুন ভবন তৈরি হয়। খালেদ নামে এক অবাঙালি ব্যবসায়ী নিজেকে এই আঙিনার মালিক বলে পরিচয় দিতেন। অনিল ঘোষের বাড়ির ঠিক উত্তরে ছিলো ছোট একতলা ভবন যা ছিল স্থানীয়দের একটি আড্ডার জায়গা। পরবর্তীতে এ স্থানে একটি বহুতল মসজিদ নির্মিত হয়।

মাড়োয়ারির কয়লার আড়তের ঠিক দক্ষিণে ছিলো ‘তারা বোর্ডিং’। এর মালিক ছিলো ইসমাইলিয়া সম্প্রদায়ের এক লোক। এই বোর্ডিং এর দক্ষিণে তিনটি বাড়ির পরে ছিলো ‘অরুণকুঠির ছাত্রাবাস’। এটা ছিলো বিভিন্ন কলেজ ছাত্রদের একটি মেস। জগন্নাথ বাবুর বাড়ির দক্ষিণ দিকে ঠিক একটি বাড়ির পরই ছিল ‘বিশ্রামালয় রেস্টুরেন্ট’। শিক্ষিত ও রুচিবান লোকেরা ছিলেন এই রেস্টুরেন্টের খদ্দের বা গ্রাহক। ফলে এই রেস্টুরেন্টের সুনাম ছিলো। এর চারটি বাড়ির পরই জমিদার সুধীর বাবুর বিশাল বাড়ি। 

বাড়ির প্রধান ফটকের সাথেই ছিলো সুধীর বাবুর ঘোড়ার আস্তাবল এবং মটরগাড়ির গ্যারেজ। তারপর গোবিন্দ পালের ‘চৌরঙ্গী রেস্টুরেন্ট’। বিভিন্ন খাবার আইটেমের জন্য এই রেস্টুরেন্টের নাম ছিলো। পাশেই ছিলো প্রখ্যাত ‘দার্জিলিং টি হাউজ’। এখানে বিভিন্ন মানের চা পাতা বিক্রি হতো। দোকানটি ছিলো বাংলাবাজার চৌরাস্তার ওপর। 

পাশেই ‘চাঁদশী অস্ত্র চিকিৎসালয়’। এর মালিক চাঁদশী ডাক্তার হিসাবে পরিচিত ছিলেন। চৌরাস্তা থেকে এক/দেড়শ গজ দক্ষিণ দিকে গেলেই হাতের বাঁ দিকে জুবিলী স্কুল এবং ডান দিকে ধানকোড়া এস্টেটের বিশাল বাড়ি, যাকে স্থানীয়রা নীলকুঠি বলতেন। ধানকোড়া এস্টেটের এই ভবনটি সেনাবাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প হিসেবে ব্যবহৃত হতো। জুবিলী স্কুলের ঠিক দক্ষিণেই লালকুঠি বা নর্থব্রুক হল। 

এখনকার নর্থব্রুক হল রোডের অবস্থা দেখে পঞ্চাশ দশকের নর্থব্রুক হল রোড বা ডিগবাজার রোডের চরিত্র ধারণা করা যাবে না। রাস্তার দুই পাশের বাড়িই ছিলো আবাসিক, খোলামেলা। প্রায় প্রতিটি বাড়ির সামনেই ফাঁকা যায়গা বা ছোট খাটো ফুলের বাগান এবং গাছপালা ছিলো। এই রাস্তায় বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড তখনো ছিলো। টোবাকো বা বিভিন্ন মানের তামাকের পাইকারি দোকান ছিলো। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে সেগুলো ফার্নিচারের দোকানে পরিণত হয়। এরপর পরিণত হয় মোটর পার্টস এর দোকানে। বর্তমানে এই রাস্তাটি ঢাকায় মোটর পার্টসের বৃহত্তম মার্কেট বা বাজার। 

বাংলাবাজারে চৌরাস্তার মোড়ে এক অবাঙালি (সম্ভবত: ইরানি) একটি রেস্টুরেন্ট খোলেন। নাম দিয়েছিলেন ‘মেহেরবান্ রেস্টুরেন্ট’। খুব অল্প সময়েই এটি একটি চালু রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়। বেশ কিছুদিন পর এর উল্টোদিকে খোলা হয় ‘কাফে কর্নার’। এটিও একটি চালু রেস্তোঁরায় পরিণত হয়। এর মালিক ছিলেন হরিনারায়ণ ও হরিপদ (পদা)। বর্তমানে রেস্টুরেন্টটির মালিকানা পরিবর্তন হলেও এখনো খুব চালু অবস্থায় আছে। 

লেখক : মনোয়ার হোসেন, সাংবাদিক 

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ - dainik shiksha ইউএনওর ‘মানসিক নির্যাতনে’ শিক্ষকের মৃত্যুর অভিযোগ শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর - dainik shiksha শিক্ষা ক্যাডারে পদোন্নতির সভা ১৮ সেপ্টেম্বর সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! - dainik shiksha সেই অভিযুক্ত রেবেকাই এবার মাউশি ঢাকার ডিডি! নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! - dainik shiksha নাহিদ-দীপুর ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিই মাউশি অধিদপ্তরের ডিজি হচ্ছেন! শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর - dainik shiksha শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে- জানতে চায় অধিদপ্তর এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস - dainik shiksha এক ফ্যাসিস্টকে দেশ ছাড়া করেছি অন্যকে সুযোগ দেয়ার জন্য নয়: সারজিস কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা: একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.0041358470916748