ডোপ টেস্টে নেয়া হচ্ছে তিন গুণ টাকা, ভোগান্তিতে শিক্ষার্থীরা

বগুড়া প্রতিনিধি |

বগুড়া শহরের মালতিনগর এলাকার কলেজছাত্র ইশতিয়াক আহমেদ সরকারি আজিজুল হক কলেজে অনার্সে ভর্তি হবেন। ভর্তির আগে তাঁকে ডোপ টেস্ট করাতে হবে। এই সপ্তাহের শেষে তা করাতে গিয়েছিলেন বগুড়ার ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টারে। সেখানে ডোপ টেস্টের রিপোর্ট পেতে তাঁকে গুনতে হয়েছে দুই হাজার টাকা।

ইশতিয়াক আহমেদের বাবা আব্দুস সামাদ পেশায় ইলেকট্রিক মিস্ত্রি। বললেন, ‘ছেলের ভর্তির টাকা জোগাড় করাই আমার জন্য দুরূহ। তার ওপর এতগুলো টাকা দিয়ে ডোপ টেস্ট করাই কিভাবে? এখন ছেলেকে ভর্তি করাতে গিয়ে নতুন করে সংকটে পড়েছি।’

ইশতিয়াকের মতোই শহর ও শহরের বাইরের গরিব শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট করাতে গিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। অন্য কোনো কলেজে ভর্তির জন্য ডোপ টেস্টের রিপোর্ট না লাগলেও পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই আজিজুল হক কলেজ এই নিয়ম চালু করায় এমন বিপত্তি দেখা দিয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্টের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ৯০০ টাকা ফি নির্ধারণ করে দিয়েছে। বগুড়ার দুটি সরকারি হাসপাতাল ছাড়া অন্য প্রায় সব বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে সরকার নির্ধারিত ফির চেয়ে তিন গুণ পর্যন্ত অর্থ আদায় করা হচ্ছে। এখানেই শেষ নয়। ডোপ টেস্টের ভুয়া (রক্ত ও প্রস্রাবে মাদকের উপস্থিতি পরীক্ষা) রেজাল্ট মিলছে প্রিন্টিংসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন দোকানে। ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা দিলেই ডোপ টেস্টের ‘নেগেটিভ’ রেজাল্ট বানিয়ে দিচ্ছেন দোকানিরা।

জানা গেছে, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তিতে শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করেছে  বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ কর্তৃপক্ষ। তবে মন্ত্রণালয়ের চিঠি না পাওয়ায় শহরের অন্য কোনো সরকারি কলেজে ডোপ টেস্টের শর্তারোপ করা হয়নি। এমনকি উপজেলা পর্যায়ের কলেজগুলোতেও তেমন বাধ্যবাধকতা নেই।

চলতি বছরের ২ জুন ঢাকায় অনুষ্ঠিত আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির ষষ্ঠ সভায় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী ভর্তির ক্ষেত্রে ডোপ টেস্ট বাধ্যতামূলক করা এবং নির্দিষ্ট সময় পর পর তা পরীক্ষার সিদ্ধান্ত হয়। সেই নির্দেশনার আলোকে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে গত ২৯ আগস্ট দেশের সব সরকারি-বেসরকারি স্কুল-কলেজের প্রধান ও মাঠ পর্যায়ের শিক্ষা কর্মকর্তাদের চিঠি পাঠানো হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ওই চিঠি কলেজগুলোতে এখনো পৌঁছেনি। ফলে বেশির ভাগ কলেজই অনার্সে ভর্তীচ্ছুদের ডোপ টেস্ট করাচ্ছে না।

এদিকে গত ২ সেপ্টেম্বর থেকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত কলেজগুলোতে অনার্স প্রথম বর্ষে ভর্তি শুরু হয়েছে। তবে মূলত ভর্তি শুরু হয়েছে ৬ সেপ্টেম্বর। তা চলবে আজ ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। কিন্তু ডোপ টেস্ট সম্পর্কে ধারণা না থাকা এবং ভর্তির জন্য হাতে খুব কম সময় থাকায় আজিজুল হক কলেজে ভর্তীচ্ছু শিক্ষার্থী ও তাঁদের অভিভাবকরা চরম বেকায়দায় পড়েছেন। তাঁরা বলছেন, ‘এমনিতেই ভর্তির জন্য হাতে সময় খুব কম; তার ওপর একসঙ্গে প্রায় সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থীর ডোপ টেস্ট করাতে গিয়ে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোয় দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। গুনতে হচ্ছে নির্ধারিত ফির প্রায় তিন গুণ অর্থ।’

বগুড়া সরকারি মুজিবুর রহমান মহিলা কলেজের উপাধ্যক্ষ প্রফেসর ড. বেল্লাল হোসেন বলেন, ‘আমরা কোনো লিখিত নির্দেশনা পাইনি। তাই শিক্ষার্থীদের ডোপ টেস্ট ছাড়াই ভর্তি করাচ্ছি। তবে তাদের ভবিষ্যতে ওই পরীক্ষা করতে হবে বলে মৌখিক নির্দেশনা দিচ্ছি।’

একই ধরনের মন্তব্য করে সরকারি শাহ্ সুলতান কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা আপাতত ডোপ টেস্ট করাচ্ছি না। তবে ভবিষ্যতে ডেস্ট করাতে বাধ্য থাকবে এমন একটি অঙ্গীকারনামা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিচ্ছি।’

সরকারি আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর শাহজাহান আলী জানান, শিক্ষার্থীদের ভর্তির সময় ডোপ টেস্ট করানোর বিষয়ে সরকার যেহেতু সিদ্ধান্ত নিয়েছে, তাই তাঁরা এর প্রয়োগ শুরু করেছেন।

গত বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, সরকারি আজিজুল হক কলেজে অনার্সে ভর্তীচ্ছুরা ডোপ টেস্টের জন্য শহরের সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে ভিড় করছেন। ডোপ টেস্টের জন্য বগুড়া শহীদ জিয়াউর রহমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ৯৫০ টাকা, সরকারি মোহাম্মদ আলী হাসপাতালে ৯০০ টাকা এবং বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারগুলোতে এক হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা চার্জ নেওয়া হচ্ছে। ভর্তির সময় কম থাকায় অনেকে বাধ্য হয়ে বেশি খরচ করে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টারে যাচ্ছেন। সেখানে গিয়েও তাঁদের দীর্ঘ সময় লাইনে দাঁড়িয়ে টেস্টের জন্য নমুনা দিতে হচ্ছে।

অতিরিক্ত অর্থ আদায় প্রসঙ্গে বগুড়া ইবনে সিনার ডেস্ক কর্মকর্তা আবুল ফজল বলেন, ‘আমরা শিক্ষার্থীদের জন্য ফি কমিয়ে ১২০০ টাকা করেছি। অন্যদের কাছ থেকে ১৮০০ থেকে দুই হাজার টাকা নেওয়া হয়।’

এদিকে বগুড়ায় ভুয়া ডোপ টেস্ট ফল সরবরাহের অভিযোগে রাসেল মাহমুদ নামে এক কম্পিউটার ও ফটোস্ট্যাট দোকানিকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব। তিনি গাইবান্ধার সাপমারা গ্রামের আবজাল হোসেনের ছেলে এবং আজিজুল হক কলেজের কামারগাড়ি গেট এলাকার মার্কেটে রাসেল কম্পিউটার অ্যান্ড ফটোস্ট্যাট দোকানের স্বত্বাধিকারী। এ ছাড়া তিনি ওই কলেজের ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগের মাস্টার্সের পরীক্ষার্থী।

র‌্যাব-১২ বগুড়া সূত্র জানায়, তাদের গোয়েন্দা দল জানতে পারে যে শহরের কামারগাড়িতে কিছু অসাধু কম্পিউটার ও ফটোস্ট্যাট দোকানদার সরকারি হাসপাতালের নাম ব্যবহার করে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় ডোপ টেস্টের ভুয়া প্রতিবেদন বিক্রি করছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বৃহস্পতিবার রাতে অভিযান চালিয়ে ২২-২৩টি ডোপ টেস্টের ভুয়া প্রতিবেদনসহ রাসেলকে আটক করা হয়।

র‌্যাব-১২ বগুড়া ক্যাম্পের কম্পানি কমান্ডার সোহরাব হোসেন জানান, রাসেলের বিরুদ্ধে প্রচলিত আইনে মামলা করে সদর থানায় পাঠানো হবে।

 


পাঠকের মন্তব্য দেখুন
জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন - dainik shiksha জড়িত মনে হলে চেয়ারম্যানও গ্রেফতার: ডিবির হারুন পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ - dainik shiksha পছন্দের স্কুলে বদলির জন্য ‘ভুয়া’ বিবাহবিচ্ছেদ হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা - dainik shiksha হিট স্ট্রোকের ঝুঁকি কমাতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে - dainik shiksha সনদ বাণিজ্য : কারিগরি শিক্ষা বোর্ড চেয়ারম্যানের স্ত্রী কারাগারে কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে - dainik shiksha কওমি মাদরাসা : একটি অসমাপ্ত প্রকাশনা গ্রন্থটি এখন বাজারে উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ - dainik shiksha উপবৃত্তির জন্য সব অ্যাকাউন্ট নগদে রূপান্তরের নির্দেশ সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা - dainik shiksha সপ্তম শ্রেণিতে শরীফার গল্প থাকছে, বিতর্কের কিছু পায়নি বিশেষজ্ঞরা জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন - dainik shiksha জাতীয়করণ আন্দোলনের শিক্ষক নেতা শেখ কাওছার আলীর বরখাস্ত অনুমোদন ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো - dainik shiksha ১৭তম ৩৫-প্লাস শিক্ষক নিবন্ধিতদের বিষয়ে চেম্বার আদালত যা করলো দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে - dainik shiksha দৈনিক শিক্ষার নামে একাধিক ভুয়া পেজ-গ্রুপ ফেসবুকে তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা - dainik shiksha তিন স্তরে সনদ বিক্রি করতেন শামসুজ্জামান, দুদকের দুই কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা please click here to view dainikshiksha website Execution time: 0.012612104415894