ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বিদেশি ভুয়া মাস্টার্স (এমবিএ) ডিগ্রির সনদ ব্যবহার করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এই সনদ ব্যবহারের ফলে তার অধ্যাপক পদে পদোন্নতি সহজ হয়। যদিও অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি।
দৈনিক আমাদের বার্তার অনুসন্ধানে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে কর্মরত এই জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্যাসল ইউনিভার্সিটি থেকে এমবিএ ডিগ্রি অর্জন করেছেন বলে দাবি করেন। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে ওই সময়ে ওই নামে কোনো প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব ছিল না। ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে ওই নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়টির বিরুদ্ধে সার্টিফিকেট বিক্রিসহ নানা অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ায় ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের ৫ মার্চ যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসন এটি বন্ধ করে দেয়।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০০১ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর থেকে ঢাকায় বিএনপি-জামাতপন্থী শিক্ষা ব্যবসায়ীরা ক্যামরিয়ান, নিউক্যাসল, ওয়েস্টকোস্ট, রয়েল রোডসসহ কয়েকটি তথাকথিত বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খুলে সেখান থেকে সনদ বিক্রি শুরু করেন। নানা সময়ে নানা কারনে নাম ও স্থান বদলও করেছে তারা। এদের সঙ্গে আর্থিক যোগাযোগ ছিলো বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারীর। তবে, অবৈধ প্রতিষ্ঠানগুলো বিরুদ্ধে কঠোর ছিলেন ওই সময়ের ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক আসাদুজ্জামান। ২০০২ থেকে অদ্যাবধি কয়েক লাখ এমফিল, পিএইচডি, এমবিএসহ বিভিন্ন বিষয়ের সনদ বিক্রি হয়েছে এইসব ভুয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অবৈধ শাখা থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকডজন অধ্যাপক এগুলোর সঙ্গে যুক্ত। আরো কয়েকজনের এমন সনদ রয়েছে।
জানা যায়, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কুমিল্লা বোর্ড থেকে ১৯৭৩ খ্রিষ্টাব্দে বাণিজ্য বিভাগে এসএসসি, ১৯৭৫ খ্রিষ্টাব্দে এইচএসসি পাস করেন প্রথম বিভাগে। ১৯৭৮ (১৯৮০-তে অনুষ্ঠিত) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং বিভাগ থেকে বিকম (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান এবং ১৯৭৯ সালে (১৯৮২ সালে অনুষ্ঠিত) এমকম পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেন। ২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে যুক্তরাষ্ট্রের নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমবিএ করেছেন বলে বিশ্ববিদ্যালয়ে সনদ জমা দেন। বাংলাদেশের ইনস্টিটিউট অব কস্ট অ্যান্ড ম্যানেজমেন্ট অ্যাকাউন্ট্যান্টস (আইসিএমএ) থেকে সিএমএ ডিগ্রি অর্জন করেন তিনি। অধ্যাপক মমতাজ লেকচারার হিসেবে ১৯৮৪ খ্রিষ্টাব্দে প্রথমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ও পরে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং বিভাগে যোগ দেন। ১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দে সহকারী অধ্যাপক ও ১৯৯৬ তে সহযোগী অধ্যাপক হন। ২০০৪ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ণ অধ্যাপক পদে পদোন্নতি পান।
স্নাতক থেকে শুরু করে পরবর্তী যে কোনো বিদেশি উচ্চতর ডিগ্রি বাংলাদেশে ব্যবহার করতে হলে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) 'ইকুইভ্যালেন্ট সার্টিফিকেট' বা 'সমমান সনদ' অনুমতি নিতে হয়। ইউজিসি সূত্র থেকে জানা যায়, অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিনের এমবিএ ডিগ্রির ক্ষেত্রে কমিশন কোনো সমমান সনদ দেয়নি। বিদেশি ডিগ্রির সমমান সনদ প্রদানের কাজটি করে ইউজিসির রিসার্চ সাপোর্ট অ্যান্ড পাবলিকেশন বিভাগ। এ বিভাগে যোগাযোগ করা হলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশ থেকে কোনো ডিগ্রি আনলেই তা ইকুইভ্যালেন্ট বা সমমান হয় না। এর জন্য বিদেশ থেকে ডিগ্রি নেওয়া ব্যক্তিকে একটি নির্দিষ্ট ফরম পূরণ করে আবেদন করতে হয়। ইউজিসির নির্ধারিত একটি কমিটির দ্বারা যাচাই-বাছাই করে বাংলাদেশের সঙ্গে সমতার উপযোগী হলে ডিগ্রি ব্যবহারের অনুমতি সনদ দেয় ইউজিসি।
ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পদোন্নতিতে একেকটি বিশ্ববিদ্যালয় একেক ধরনের পদ্ধতি অনুসরণ করছে। সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে একাধিক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি ও পিএইচডি প্রয়োজন হয়। এ ক্ষেত্রে একাধিক বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি থাকলে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদোন্নতির ক্ষেত্রেও দুই বিষয়ে স্নাতকোত্তর থাকলে বাড়তি পয়েন্ট যোগ হয়।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক মমতাজ উদ্দিন আহমেদ বলেন, ' অনলাইনে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিগ্রিটি নিয়েছি। এটি আমি বিশ্ববিদ্যালয়কেও জানিয়েছি।'
তিনি বলেন, '২০০৩ খ্রিষ্টাব্দে ধানমন্ডিসহ ঢাকার বিভিন্ন স্থানে কয়েকটি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা ছিল। তারই একটি এটি। আমার বিভাগের প্রধানের অনুমতি নিয়েই আমি সেখানে ভর্তি হয়েছিলাম। এত দিন পর এ নিয়ে কথা উঠছে কেন, বুঝতে পারছি না।'
এ বিষয়ে সন্ধান করলে ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, ২০০৩ সালে বাংলাদেশে কোনো বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা, স্টাডি সেন্টার ও ক্যাম্পাস প্রতিষ্ঠার অনুমতি ছিল না। এখন পর্যন্ত মাত্র একটি প্রতিষ্ঠানকে এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মোনাশ কলেজকে (অস্ট্রেলিয়া) স্টাডি সেন্টার করার অনুমতি দেয় ইউজিসি। আর কারও কোনো অনুমতি নেই।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, ' পুরোটা খতিয়ে না দেখে এ বিষয়ে মন্তব্য করা কঠিন।'