‘ঘুরে না গাড়ির চাকা রে ভাই ঘুরে না গাড়ির চাকা, কেমন করে এগিয়ে যাবে জ্যামের শহর ঢাকা।' --- ঢাকা মহানগরীতে গাড়ির জ্যাম নতুন কোন বিষয় নয়, তবে সম্প্রতি এর তীব্রতা অতিমাত্রায় বেড়েছে। রাস্তার মাঝেই নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা, অপচয় হচ্ছে অর্থ এবং তীব্রভাবে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ। সবাই সব কিছু দেখছে, বুঝছে কিন্তু কারো যেন কোন কিছু করার নেই। জ্যাম দূরীকরণে নানা উদ্যোগ গৃহীত হলেও সেটা আলোর মুখ দেখেনি। ঢাকামুখী জনস্রোতে ঢাকা আজ সত্যি কাহিল হয়ে পড়েছে। ঢাকার আকাশ আজ দূষণের রাজসাক্ষী। কি করছি আমরা? যার যার মতো করে ভেবে যাচ্ছি। একে অন্যকে দায় চাপাচ্ছি। কিন্তু সমাধান কোথায়? বিশ্বব্যাংক বলছে ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিদিন ৩২ লাখ শ্রমঘণ্টা নষ্ট হয়। জ্যাম দেশের জিডিপির একটি বড় অংশ খেয়ে ফেলে। জ্যাম সমস্যার সমাধান হলে মাথাপিছু আয় আরো অনেক বাড়তো। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে যে, ট্রাফিক জ্যামের কারণে প্রতিদিন গড় ক্ষতি ৩০০-৩৫০ কোটি টাকা। গত এক যুগে বছরে ঢাকার গড় ট্রাফিক স্পীড ২১ কিমি ঘণ্টা থেকে নেমে ৫ কিমি ঘণ্টায় দাঁড়িয়েছে এবং এই গতি আরো নেমে যাওয়ার কথা বলছেন বিশেষজ্ঞরা। হাঁটার গতিও এর থেকে বেশি হয়ে থাকে প্রতি ঘণ্টায়।
বিভিন্ন পত্রপত্রিকার প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঢাকায় অতিমাত্রায় বাড়ছে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা। ৬৫ শতাংশ ব্যক্তিগত গাড়ি বাড়লেও গণপরিবহণ বেড়েছে মাত্র ২-৩ শতাংশ। প্রতি মাসে যোগ হচ্ছে দেড় থেকে দুই হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি। উন্নত দেশগুলোতে যেখানে গণপরিবহণকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে, সেখানে আমাদের ঢাকার চিত্র একেবারেই বিপরীত। ঢাকায় ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা অতিমাত্রায় বাড়ছে। এসব ব্যক্তিগত গাড়ির মধ্যে প্রায় ৫০ শতাংশ মোটর সাইকেল এবং ১৮ শতাংশ প্রাইভেট কার। ঢাকার পথে গণপরিবহণে চড়তে অনেকেই অপছন্দ করেন উন্নত সেবা ও পরিবেশ না থাকার কারণে। তাই যে যেভাবে পারে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবস্থা করছে, যেটার চাপ সামলাতে পারছে না রাজপথ। ঢাকার জনসংখ্যা দুই কোটিরও বেশি। জনঘনত্বের বিচারে ঢাকা বিশ্বের সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ শহর। ৩০৬ বর্গকিঃমিঃ আয়তনের এই শহরে প্রতি বর্গকিলোমিটারে ২৩ হাজার লোক বাস করে। অতি জনবহুল এ শহরে সেভাবে প্রশস্ত রাস্তা তৈরি হয়নি। ঢাকাতে বর্তমানে বাস রুটের সংখ্যা ৩০০-এর কাছাকাছি। এসব রুটের কিছু বর্তমানে অকার্যকর আর কিছু আছে নামমাত্র। বাকিগুলোতে প্রচন্ড জ্যাম লেগেই থাকে। বিভিন্ন তথ্য-উপাত্ত থেকে জানা যায়, ২০২১ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত রাজধানীতে নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ছিল ১৭ লাখ ১৩ হাজার ৫৫৪টি। এর মধ্যে মাত্র ২ শতাংশ গণপরিবহন, যা খুবই অপ্রতুল। বছরে যানজটে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় এক লাখ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, দেশের পুরো জনসংখ্যার ১০ শতাংশের বসবাস ঢাকা ও এর আশেপাশে। সকল অফিস-আদালতের হেডকোয়াটার ঢাকায়। প্রশাসনিক দপ্তর ছাড়ারও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন কোম্পানী, পোশাক কারখানাসহ নানা কিছু ঢাকায় অবস্থিত এবং এর ফলে ঢাকায় জনস্রোত থামানো যাচ্ছে না। গত এক দশকে রাজধানীতে চলাচলের জন্য নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা তিন গুণের বেশি হয়েছে, যা আন্তর্জাতিক মানদন্ডের মধ্যে পড়ে না। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী, রাজধানীর সড়কে সর্বোচ্চ দুই লাখ ১৬ হাজার গাড়ি চলাচল করতে পারে। অথচ এখন ঢাকায় নিবন্ধিত গাড়ির সংখ্যা ১৭ লাখেরও বেশি। যানজট নিরসনে শত শত কোটি টাকা খরচ হলেও অবস্থার কোনো উন্নতি হয়নি। যানজট কমাতে গত এক দশকে উড়াল সড়ক নির্মাণসহ অবকাঠামো খাতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা। ট্রাফিক পুলিশের তথ্যানুযায়ী, ঢাকা শহরে রাস্তা আছে ২২০০ কিলোমিটার, যার মধ্যে ২১০ কিলোমিটার প্রধান সড়ক। কিন্তু প্রধান সড়ক প্রয়োজন প্রায় ৬ হাজার কিলোমিটার। অপ্রতুল এসব সড়কের ৭৬ শতাংশই দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি।
গণপরিবহনের দখলে থাকে ৬-৮ শতাংশ। এছাড়াও বড় সড়কগুলোর অর্ধেকের বেশি দখল করে রাখে ফুটপাতসহ নানা নির্মাণসামগ্রী, ভ্যান, রিকশা, লেগুনা, হিউম্যান হলার, ট্রাক, সবজি ও মাছ বিক্রতার বিভিন্ন পরিবহন ইত্যাদি। ঢাকা শহরের সড়কগুলোতে সারা বছর চলে খুঁড়াখুঁড়ি, যার ফলে জ্যাম লেগেই থাকে। ঢাকা শহরের রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করে রাখার কারণে তীব্র জ্যামের সৃষ্টি হয়। দেশে এখনো কার্যকরী পার্কিং নীতিমালা নেই। দুই সিটি করপোরেশন ও ট্রাফিক পুলিশ মিলে নগরীর অন্তত ৫০টি স্থানে রাস্তায় পার্কিং ব্যবস্থা চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলো। কিন্তু সেটার সঠিক বাস্তবায়ন হয়নি। আর ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা তো আছেই। কিন্তু রাজধানীর সড়কগুলোতে মিশ্রজাতের গাড়ি চলাচল করে, যা ট্র্ফিক ব্যবস্থাপনায় চরম ঝামেলার সৃষ্টি করে। রাজধানীর সড়কগুলোতে একই সাথে ১৯ ধরনের গাড়ি চলাচল করে, যাদের কোনটির গতি বেশি আবার কোনটির গতি কম, আবার কিছু আছে যেগুলোর ইঞ্জিন নেই। একই রোডে একসাথে চলে বাস, ট্রাক, লেগুনা, সিএনজি অটো, ভ্যান, রিকশা, প্রাইভেট কার, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, মাইক্রোবাস, মিনিবাস, এ্যাম্বুলেন্স, টেম্পু, ম্যাক্সি, ঠেলাগাড়ি, মালবাহী গাড়ি, দোতলা বাসসহ হরেক জাতের পরিবহণ। এর ফলে একটি হযবরল অবস্থার সৃষ্টি হয়। আবার রাজধানীতে অনেক গলি আছে যেগুলোতে ব্যাটারিচালিত অটো চলে। এর ফলে গলির মুখে জ্যাম লেগেই থাকে। বৈধ পরিবহণের পাশাপাশি চলে অবৈধ পরিবহণ আর এই অবৈধ পরিবহণের সংখ্যা কতো তার সঠিক কোন পরিসংখ্যান নেই। ঢাকাতে প্রায় চার লাখ রিকশা চলাচল করে এবং এর একটি বিরাট অংশ রয়েছে নিবন্ধনহীন। ঢাকা শহরে জ্যামের কারণগুলো আমরা সবাই কমবেশি জানি। তবে কিছু সুনির্দিষ্ট কারণে জ্যাম দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। সেগুলো হলো- ১. অতিরিক্ত জনগণ, ২. অতিরিক্ত গাড়ির চাপ, ৩. গণপরিবহণ কমে যাওয়া, ৪. ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা বৃদ্ধি, ৫. সড়কে মিশ্রজাতের গাড়ির একসাথে চলাচল, ৬. অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও অবকাঠামো নির্মাণ, ৭. সড়কে খনন, ৮. দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, ৮. সড়ক দখল, ৯. সড়কে গাড়ি পার্কিং, ১০. যাত্রী তোলার জন্য যেখান সেখানে বাস ও গাড়ি থামা, ১১. রাস্তার উপর নির্মাণসামগ্রী ফেলে রাখা, ১২. পর্যাপ্ত ইউলুপ না থাকা, ১৩. জনগণের অনিয়ন্ত্রিত রাস্তা পারাপার, ১৪. সীমিত সংযোগ সড়ক এবং ১৫. পার্কিং নীতিমালা না থাকা। এছাড়াও আরো বহুবিধ কারণ রয়েছে। বাস্তবতা হল কোন আদর্শ মহানগরীতে আয়তনের ২৫ শতাংশ সড়ক থাকতে হয়। কিন্তু ঢাকা শহরে আয়তনের তুলনায় আছে মাত্র ৭ শতাংশ সড়ক। প্রধান প্রধান সড়কের মধ্যে মাত্র ৪ শতাংশ সড়কে যন্ত্রচালিত বড় গাড়ি চলাচল করতে পারে। বাকি ৯৬ শতাংশ সড়কে নানান জাতের গাড়ি আর অনিয়মের কারণে চলাচলের অনুপোযোগী থাকে। ঢাকার যানজট নিয়ন্ত্রনে সবচেয়ে বড় উদ্যোগ হলো মেট্রোরেল। এ বছরেই ট্রেন চলার কথা আছে। আশা করা হচ্ছে মেট্রেরেল যানজট কমাবে। কিন্তু প্রশ্ন হল বর্তমানে ঢাকায় যে পরিবহণগুলো চলাচল করছে এগুলো তো থেকে যাবে। আর এগুলো যদি থেকে যায় তবে জ্যাম কিভাবে কমবে? বরঞ্চ গাড়ির সংখ্যা আরো বাড়বে। আসলে সবচেয়ে যেটা বড় প্রয়োজন, সেটা হলো সড়কে শৃংঙ্খলা। ঢাকার পথগুলোতে চরম সংকট শৃঙ্খলার। আর সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য সবার আগে দরকার অত্যাধুনিক ট্রাফিক সিস্টেম। হাত উঠিয়ে ট্রাফিক কন্ট্রোল বাদ দিতে হবে। রাস্তায় টহল পুলিশের সংখ্যা অনেক বাড়াতে হবে। খুব ব্যস্ত মোড়গুলোতে বাইপাসের সুযোগ করে দিতে হবে। যেমন- বিজয় সরণীর কথা বলা যায়। এখানে ট্রাফিক জ্যাম লেগেই থাকে। এই মোড়টিতে যদি উপর দিয়ে এবং নিচ দিয়ে গাড়ি পার হওয়ার সুযোগ করে দেয়া হয় তবে জ্যাম সেখানে থাকার কথা নয়। ঢাকা শহরের জ্যাম কমানোর জন্য উড়াল সড়ক নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্ত সেই উড়াল সড়কেও এখন জ্যাম দেখা যায়। তাহলে লাভ কি হলো? আসলে ঢাকায় জনসংখ্যা কমানো এবং গাড়ির সংখ্যা কমানোর সময় এসেছে। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা ছাড়া যতোই পদক্ষেপ নেয়া হোক তা কাজে আসবে না। প্রতিনিয়ত মানুষ ও গাড়ি বাড়ছে ঢাকায়। এখানে লাগাম টানতে হবে। ব্যক্তিগত গাড়ির অনুমোদন অবশ্যই নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। যে সকল রাস্তাগুলো দখল হয়ে আছে সেগুলো উদ্ধার করতে হবে। বাস স্টোপেজ নির্ধারণ করে দিতে হবে। উল্টা পথে গাড়ির চালোনার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে। স্কুল শুরুর আগে এবং ছুটির পর জ্যাম হয়। এ দুটি সময়ে সর্বোচ্চ নজরদারি রাখতে হবে। একটু খেয়াল করলে দেখা যায় যে, ঢাকার প্রধান সড়কগুলো যথেষ্ট বড়। কিন্তু তার অর্ধেকটাই যদি নানাভাবে দখল হয়ে থাকে তবে জ্যাম তো হবেই। প্রধান সড়কগুলোতে নির্দিষ্ট স্থান ছাড়া কোনভাবেই যেন গাড়ি দাঁড়াতে না পারে সে ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকার জ্যাম নিয়ন্ত্রণে পৃথক একটি বডি দরকার এবং পর্যাপ্ত জনবল প্রয়োজন। যে যার খুশিমত চললে ঢাকার জ্যাম কি আদৌ নিয়ন্ত্রণে আসবে? যতোই সড়ক নির্মাণ আর পরিকল্পনা করা হোক না কেন, তা কাজে আসবে না যদি তিনটি বিষয়ে কার্যকরী সিদ্ধান্ত না নেয়া যায়। সেগুলো হলো- ১. ঢাকায় জনতার চাপ কমানো, ২. ঢাকায় গাড়ির সংখ্যা কমানো এবং ৩. সড়কে কঠোর শৃঙ্খলা নিশ্চিতকরণ। ঢাকা আজ বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠেছে। গাড়ির ধোঁয়ায় ঢাকার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। কি ভবিষ্যত এই মেগা সিটির? ঢাকাকে বাঁচাতে হলে ঢাকামুখী জনস্রোতে লাগাম টানতে হবে। প্রয়োজনে সিটি কার্ড চালু করা যেতে পারে। বিআরটিএ’কে কঠোর থেকে কঠোরতর ভূমিকা রাখতে হবে। তবে যতো আশাবাদই ব্যক্ত করি না কেন, দুর্নীতি বন্ধ না করা গেলে ঢাকাকে একসময় পরিত্যক্ত ঘোষণা ছাড়া আর উপায় থাকবে না। রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতির কারণে ঢাকা আজ অপরিকল্পিতভাবে বড় হচ্ছে। এর শেষ কোথায়? তীব্র যানজটের কারণে তবে কি ঢাকাবাসীর স্বপ্নগুলোর কবর রাজপথেই রচিত হবে!
লেখক : মাজহার মান্নান, কবি ও কলামিস্ট