বঙ্গবন্ধু ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত বহুতল বিশিষ্ট সুসজ্জিত প্রাথমিক বিদ্যালয় ডালপালা বিহীন অনেকটা তালগাছের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। সেখানে আছে প্রয়োজনীয় উচ্চশিক্ষিত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক। উচ্চ বিদ্যালয়, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়েও এতো প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের সমাহার নেই। শিক্ষাবান্ধব সরকারের বাজেটে রয়েছে শিশুদের মনোরম চিত্তাকর্ষক পরিবেশে পাঠদানের জন্য পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ। প্রাথমিকের প্রায় অধিকাংশ বিদ্যালয় যেন শিশুদের স্বর্গ।
এছাড়া রয়েছে উপবৃত্তি, অবৈতনিক শিক্ষা, জাতীয় পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু ও বঙ্গমাতা ফুটবল, সাংস্কৃতিক ও খেলাধুলা প্রতিযোগিতাসহ সরকারি নানা সুযোগ-সুবিধা। দেশের অন্য কোনো পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এতো সুযোগ সুবিধা নেই। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নেই কোনো অপ্রাসঙ্গিক বইয়ের চাপ। এতে শিশু শিক্ষার্থীর মেধাবিকাশ বাধাগ্রস্ত হয় না।
এতো সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সুযোগ্য কন্যার জাতীয়করণ প্রাথমিক বিদ্যালয় আজ মারাত্মক শিক্ষার্থী সংকটে। দেশের প্রায় সব মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি নিয়ে চালু করেছে প্লে, নার্সারি থেকে প্রাথমিক শাখা। তাদের তেমন নেই শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক।
গোলাপফুলে সুবাস না থাকলেও দেখতে সুন্দর বিধায় গোলাপের মতো হাইস্কুল, কলেজের প্রাথমিক শাখায় অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের ভর্তি করিয়ে গর্ববোধ করে থাকেন। নিজেদের শিশুদের বিদ্যালয়ের নামে পরিচয় দিয়ে গৌরবান্বিত হন। প্রাথমিকে বিভিন্ন পরিবেশের শিশুর সঙ্গে সহাবস্থানে তাদের মাঝে অহঙ্কারবোধ জাগ্রত হয় না। অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধরনের পেশার শিক্ষার্থীদের সঙ্গে অবস্থান না থাকায় তাদের মাঝে কিঞ্চিত হলেও অহংকারবোধ জাগ্রত হয়ে থাকে। বিশেষ করে কোনো বিশেষ মহল, প্রতিষ্ঠানের ব্যবসায়ী মনোবৃত্তি আগামী প্রজন্মের অগ্রগতির প্রধান চ্যালেঞ্জ। শিশুর শারীরিক, মানসিক ও মেধার বিকাশের জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষিত ও শিশু শিক্ষায় প্রশিক্ষপ্রাপ্ত শিক্ষক। উচ্চ বিদ্যালয় তথা উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক আছেন বটে, কিন্তু প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষকের তেমন ছায়া নেই। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক ছাড়া আগামী প্রজন্ম বেড়ে উঠবে অনেকটা বিকলাঙ্গ মেধা বা জ্ঞান নিয়ে।
বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশেষ করে শিশুশিক্ষার প্রতি অধিকতর গুরুত্ব দিয়ে প্রাথমিক শিক্ষাকে বিশ্বের উন্নত দেশের পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয় লটারির মাধ্যমে উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শাখায় ভর্তির কার্যক্রমকে পৃষ্ঠপোষকতা করে প্রাথমিকে শিক্ষার্থী সংকট সৃষ্টি করে চলেছেন। ঢাকা শহরের কোতয়ালী থানার ২০২২ খিষ্টাব্দের চিত্র দেখলে বুঝা যাবে, উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা কীভাবে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকট সৃষ্টি করে চলেছে।
উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখায় শিক্ষার্থী ১৫৭৩৪, প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৮৫৮৫, কিন্ডারগার্টেনে ৩০০৯, এনজিও স্কুলে ৯৫০, শিশুকল্যাণ বিদ্যালয়ে ১৭৫, মাদরাসায় ১১৪০।
ঢাকা শহরসহ দেশের সব শহরের চিত্র প্রায় একই। গ্রামাঞ্চলে উচ্চ বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে ও প্রাথমিক শাখার খোলার হিড়িক দৃশ্যমান। জাতীয় শিক্ষানীতি ২০১০ এর আলোকে প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত। মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষা হবে নবম শ্রেণি থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। অথচ এ বিষয়টি প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়সহ শিক্ষা মন্ত্রণালয় আমলে নিচ্ছে না। তারা উৎসাহ-উদ্দীপনা সহকারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ও তাঁরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সংকট সৃষ্টি করে অস্তিত্ব বিলীন করে যাচ্ছেন। থানা শিক্ষা অফিস কোতয়ালী, সূত্রাপুরের অফিস প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ওপরে অবস্থিত। থানা শিক্ষা কর্মকর্তাসহ উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ওই বিদ্যালয়গুলো বেশি বেশি দেখভাল করে যাচ্ছেন। অথচ বিদ্যালয়গুলো চরম শিক্ষার্থী সংকটে ভুগছে। সেসব বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী কম সেসব বিদ্যালয় দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে এক শিফটে চলে আসছে। এতো দেখভাল করার পরও শিক্ষার্থী সংখ্যা কম। সেখানে দক্ষ, অভিজ্ঞ, নিবেদিতপ্রাণ কর্মকর্তাকে প্রধান শিক্ষকের দায়িত্ব দিলেও কোনো সফলতা আসবে না।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থী সংকট দূর করার জন্য প্রথমত, উচ্চ বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাথমিক শাখা বন্ধ করতে হবে। দ্বিতীয়ত, শিশুবান্ধব সময়সূচি নিশ্চিত করতে দুপুর ২টা পর্যন্ত বিদ্যালয়ের কার্যক্রম রাখতে হবে।
এছাড়া উচ্চ বিদ্যালয়ে প্রাথমিক শাখা বিলুপ্তসহ দুপুর ২টার মধ্যে শিশুশিক্ষার কার্যক্রম শেষ করে দুপুরে গোসল করে গরম ভাত খাওয়ার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এরপর খানিকটা বিশ্রাম বা সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। এতে বিকেল বেলা বিনোদন বা খেলাধুলা এনে দেবে শিশুর শারীরিক, মানসিক বিকাশসহ আনন্দময় পরিবেশের প্রশান্তি। প্রাথমিক কিন্ডারগার্টেন, হাইস্কুলের ছুটি, বই, মূল্যায়ন প্রক্রিয়া হবে এক ও অভিন্ন। প্রাথমিকে শিক্ষক সংকট দূরীকরণের শূন্য সহিষ্ণুতা নামিয়ে আনতে হবে। তা হলে সরকারের জাতীয়করণকৃত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সাফল্য আসবে। উপকৃত হবে দেশ ও জাতি।
লেখক : মো. সিদ্দিকুর রহমান, সম্পাদকীয় উপদেষ্টা, দৈনিক শিক্ষাডটকম