নিজ বিভাগে বসবাস করার প্রবণতা সবচেয়ে কম বরিশালের মানুষের। এ ক্ষেত্রে নিজেদের ভূমিকে ভালোবেসে নিজ বিভাগেই বসবাসের প্রবণতা সবচেয়ে বেশি সিলেটের মানুষের মধ্যে।
রাজধানী ঢাকায় সবচেয়ে বেশি বসবাস বরিশাল বিভাগের মানুষের। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বাস ময়মনসিংহ বিভাগের মানুষের। সামাজিক, অর্থনৈতিক, ভূতাত্ত্বিক কারণে এই দুই বিভাগের মানুষ নিজ ভূমি ছেড়ে কাজের জন্য ঢাকায় আসে বলে মনে করছেন সমাজবিজ্ঞানীরা। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন, কাজের ক্ষেত্র কম ও অতি দরিদ্রতার কারণেও এসব অঞ্চলের মানুষের রাজধানীতে আসার প্রবণতা বেশি বলে মনে করছেন তারা।
সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর প্রকাশিত ‘জনশুমারি ও গৃহগণনা ২০২২’ পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনে বিভিন্ন বিভাগের মানুষের এসব তথ্য উঠে এসেছে।
জনশুমারির তথ্যে দেখা যায়, বিভাগগুলোর মধ্যে বরিশালের মানুষ সবচেয়ে কম, মাত্র ৭৮ দশমিক ৩০ শতাংশ নিজ বিভাগে অবস্থান করে। বিপরীতে বরিশাল বিভাগের ১৮ দশমিক ৬২ শতাংশ মানুষ জীবন ও জীবিকার জন্য ঢাকায় অবস্থান করছে। আর ময়মনসিংহ বিভাগের ১৪ দশমিক ৪৩ শতাংশ মানুষ ঢাকায় অবস্থান করছে।
সিলেট বিভাগের মানুষ নিজ বিভাগেই থাকার ক্ষেত্রে শীর্ষে রয়েছে। নিজ এলাকায় জলবায়ু পরিবর্তন কম হওয়া, অর্থনৈতিক সক্ষমতা বেশি হওয়ার কারণে এই বিভাগের মানুষের অন্য বিভাগে স্থানান্তর হওয়ার প্রবণতা কম। জনশুমারির হিসাব বলছে, এ বিভাগের মাত্র ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ ঢাকায় অবস্থান করে। নিজ বিভাগে অবস্থান করছে ৯৫ দশমিক ৬৯ শতাংশ সিলেটবাসী।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিনাত হুদা দেশ রূপান্তরকে বলেন, অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর ঘটে মূলত দুটি কারণে। একটি হলো একেবারেই বাধ্য হয়ে, আরেকটি উন্নত জীবনের আকর্ষণে। বরিশাল বিভাগের খাল, বিল, নদী-নালা সবচেয়ে বেশি। এ এলাকাটি অনেক প্রান্তিক। ফলে এখানকার মানুষ নদীভাঙনও সবচেয়ে বেশি দেখে। নদী ভাঙলে একটা গ্রামীণ জীবন কিংবা একটা এলাকা পুরোপুরি বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এখানকার মানুষ তখন বাধ্য হয় নিজের জীবন-জীবিকা, যাবতীয় জীবনের যা কিছু প্রয়োজন সে কারণেই এসব এলাকার মানুষের অভ্যন্তরীণ স্থানান্তর ঘটে। এটি অর্থনৈতিক ও সমাজতাত্ত্বিক কারণ।
তিনি বলেন, ‘বৃহত্তর ময়মনসিংহেও আমরা দেখতে পাই এ এলাকার মানুষ খুব বেশি স্বাবলম্বী না। ময়মনসিংহ এলাকায় বরিশালের মতো নদী এলাকা না থাকলে সেখানে হাওর, বাঁওড় বিভিন্ন জায়গায় রয়েছে, কিছু কিছু এলাকা পাহাড়ি এলাকা। এটি একটি রিস্ক ফ্যাক্টর। ফলে অনেকে এখান থেকে অনেকে স্থানান্তরে বাধ্য হচ্ছেন।’
উন্নত জীবনের আকর্ষণের কারণেও মানুষ স্থানান্তরিত হয় বলে মনে করেন এই সমাজবিজ্ঞানী। জিনাত হুদা বলেন, ‘আমরা আকর্ষণ অনুভব করি। নতুন জীবন, চাকচিক্যময় ও উন্নত জীবনের প্রতিও মানুষের আকর্ষণ তৈরি হয়। তবে এদের সংখ্যা তুলনামূলক কম। ঢাকা হোক আর যেখানেই হোক, যেসব এলাকায় চাহিদাগুলো পূরণ করতে পারে, সেখানে স্বাভাবিকভাবেই মানুষ স্থানান্তরিত হয়।’
রাজশাহী বিভাগের মানুষের ঢাকায় অবস্থানও কম। এ বিভাগের ৯২ শতাংশ মানুষ নিজ বিভাগে অবস্থান করছে। ঢাকায় তাদের অবস্থান ৬ দশমিক ৯৭ শতাংশ। এ ছাড়া খুলনা বিভাগের ৫ দশমিক ৬২, চট্টগ্রাম বিভাগের ৭ দশমিক ১৭ ও রংপুর বিভাগের ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ মানুষ ঢাকায় অবস্থান করে।
২০১৯ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ গবেষণা উন্নয়ন সংস্থার (বিআইডিএস) এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকায় গত ১০ বছরে বরিশাল থেকে সবচেয়ে বেশি মানুষ এসেছে। এরপর রয়েছে ময়মনসিংহ, কিশোরগঞ্জ, ভোলা এবং সবচেয়ে কম মানুষ এসেছে শরীয়তপুর থেকে। গত ৫ বছরের হিসাবে সবচেয়ে বেশি মানুষ ঢাকায় এসেছে কিশোরগঞ্জ থেকে। এরপর রয়েছে বরিশাল, ময়মনসিংহ, ভোলা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, রংপুর, চাঁদপুর ও নোয়াখালী। আর সবচেয়ে কম মানুষ টাঙ্গাইলের বলেও প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়।
ঢাকায় অবস্থান করা বরিশাল বিভাগের কয়েকজন নাগরিক বলছেন, এসব এলাকার পানচাষি সুদের ফাঁদে পড়ে অভিবাসনের শিকার হয়েছেন। সন্ধ্যা নদীর ভাঙনে বালাম চাল উৎপাদনে জড়িত কুটিয়াল সম্প্রদায় বিলুপ্তির পথে। এ অঞ্চলে লবণপানি ঢুকে পড়ায় ফসলের বিপর্যয় ঘটছে। প্লাস্টিক বর্জ্য ধ্বংস করছে পরিবেশ।
২০২১ খ্রিষ্টাব্দে বিশ্বব্যাংকের প্রকাশিত ‘দক্ষিণ এশিয়ার জলবায়ু উপদ্রুত এলাকা (হটস্পট), জীবনমানের ওপরে তাপমাত্রা বৃদ্ধির প্রভাব’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে ২০৫০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে বাংলাদেশে যে ক্ষতি হবে, তার আর্থিক পরিমাণ ১৪ লাখ ১৯ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। চট্টগ্রাম ও বরিশাল বিভাগ ক্ষতির দিক থেকে শীর্ষে থাকবে।
ওই প্রতিবেদনে উঠে আসে, ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড় সিডর, ২০০৯ খ্রিষ্টাব্দে আইলা, ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে ঘূর্ণিঝড় মহাসেনের আঘাতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বরিশাল বিভাগটি। শিল্পায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির দিক থেকেও এই বিভাগ পিছিয়ে আছে। যোগাযোগ অবকাঠামোর দিক থেকে এই বিভাগ সবচেয়ে দুর্বল। এসব কারণে জলবায়ু পরিবর্তনের আঘাত সহ্য করার ক্ষমতা এই বিভাগের কম।
অধ্যাপক জিনাত হুদা বলেন, ‘বরিশালের জলবায়ুকে আমরা এখন রিস্ক ফ্যাক্টর বলছি। এটি যেকোনো সময় ডুবে যায়, পানি উঠে যায়। ময়মনসিংহ অঞ্চলের ক্ষেত্রেও রিস্ক ফ্যাক্টর রয়ে গেছে। ফলে শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই নয়, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ভূতাত্ত্বিক কারণে এসব অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় স্থানান্তরিত হচ্ছে বেশি।’
স্বাধীনতার পর থেকে এ অঞ্চলে দুর্বল যোগাযোগব্যবস্থা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগপ্রবণ হওয়ার কারণে শিল্প গড়ে ওঠেনি। ঘন ঘন জলবায়ু সংকটের টেকসই কোনো পেশা নেই। ফলে উন্নত শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানের তাগিদে এসব অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় পাড়ি জমায়। আবার যেসব অঞ্চলে স্থানীয় পর্যায়ে একটা স্থিতিশীল ও টেকসই বাজার ব্যবস্থা ও অর্থনীতি আছে, সেসব অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় কম আসে। যেমন সিলেট ও চট্টগ্রাম।