ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষার্থীদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে বহিরাগত যানবাহন ও মানুষ। সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জনসমুদ্রে পরিণত হয় বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা। মানসিকভাবে ভারসাম্যহীন ও ভবঘুরেদের কারণেও নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিরাপত্তা জোরদারে ও বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার যানবাহন নিয়ন্ত্রণে ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস চালু করার উদ্যোগ নিয়েছে ঢাবি প্রশাসন। এছাড়াও প্রক্টরিয়াল বডির মোবাইল টিমে জনবল নিয়োগ, ক্যাম্পাসে ছয়টি সিকিউরিটি বক্সে সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাপ্রহরী থাকাসহ শিক্ষার্থীদের যুক্ত করে ‘ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস’ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিসে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরিয়াল বডি ও মোবাইল টিমের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কাজ করবেন। ঢাবিতে শিক্ষার্থীদের খণ্ডকালীন কাজের সুযোগ এবং বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য চালু আছে ‘স্টুডেন্ট প্রমোশন অ্যান্ড সাপোর্ট ইউনিট’। এই ইউনিটের অধীনে আবেদন করে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিসে যোগ দিতে পারবেন। শিক্ষার্থীরা প্রতিদিন নিজেদের সুবিধাজনক সময়ে দুই থেকে চার ঘণ্টা এই কাজ করতে পারবেন। কাজে যোগদানের আগে শিক্ষার্থীদের ওরিয়েন্টেশন প্রগ্রাম ও ইন্ডাকশন ট্রেনিং দেয়া হবে। নির্দিষ্ট পোশাক ও আইডি কার্ডের ব্যবস্থা করা হবে এবং শিক্ষার্থীদের কর্মঘণ্টা অনুযায়ী নির্দিষ্ট পরিমাণ পারিশ্রমিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দেয়া হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর।
তড়িঘড়ি করে গত বছরের ১৬ জুন ঢাবির পাঁচটি প্রবেশদ্বারে (নীলক্ষেত, পলাশী মোড়, শাহবাগ, হাইকোর্ট মোড়, শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন) বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা জোরদার ও নিশ্চিত করতে সিকিউরিটি অ্যান্ড সার্ভেইল্যান্স বক্স উদ্বোধন করেন তৎকালীন উপাচার্য ড. মো. আখতারুজ্জামান। তবে তা শুধু উদ্বোধন পর্যায়েই থেকে যায়; সেখানে নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে কাউকে নিয়োগ দেয়া হয়নি। চার মাসের মতো খালি পড়ে থাকে বক্সগুলো। পরবর্তী সময়ে ওই বছরের নভেম্বর মাসে শুধু তিনটি বক্সে (শাহবাগ, নীলক্ষেত, পলাশী মোড়) নিরাপত্তাপ্রহরী হিসেবে ৯ জনকে নিয়োগ দেয়া হয়। দুটি বক্স খালি থাকে। নিয়োগ দেয়া নিরাপত্তাপ্রহরীদের আন্ত যোগাযোগের জন্য ওয়াকিটকি দেয়ার কথা থাকলেও তা দেয়া হয়নি। তাঁদের জন্য নির্দিষ্ট কোনো পোশাকও ছিল না। জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের সময় পুলিশ বক্স মনে করে এই বক্সগুলো ভেঙে ফেলে আন্দোলনকারীরা।
দেশের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আবারও ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর করার উদ্যোগ নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। শুক্রবার নিরাপত্তাপ্রহরীদের জন্য নির্দিষ্ট পোশাক দেয়া হয়। পাশাপাশি হাইকোর্ট মোড় ও শহীদুল্লাহ হল সংলগ্ন বক্সেও সার্বক্ষণিক নিরাপত্তাপ্রহরী থাকার জন্য লোকবল নিয়োগ দিতে গতকাল রবিবার প্রক্টর অফিস থেকে ছয়জন নিরাপত্তাপ্রহরী চেয়ে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়েছে। এ ছাড়া ভেঙে ফেলা পাঁচটি বক্স দ্রুত সংস্কার করে সেখানে নিয়মিত নিরাপত্তাপ্রহরী রাখা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল টাওয়ারের সামনেসহ মোট ছয়টি প্রবেশমুখে ‘বার’ স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ।
বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার সড়কগুলোতে ট্রাফিক সামলানোর জন্য কোনো ট্রাফিক পুলিশ নেই। রাস্তা পার হওয়ার জন্য নেই কোনো ফুট ওভারব্রিজ। এ জন্য ওই এলাকায় ভারী যানবাহন চলাচল বন্ধ এবং বহিরাগত যানবাহন চলাচলে নিয়ন্ত্রণ চান শিক্ষার্থীরা।
বিজয় একাত্তর হলের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ রুহেল বলেন, ‘বহিরাগত যানবাহন ও মানুষ নিয়ন্ত্রণে প্রশাসনের উচিত ক্যাম্পাসে পর্যাপ্ত সিসিটিভি এবং কর্মক্ষম ও সর্বোচ্চ দক্ষ একটা প্রশাসনিক টিম তৈরি করা। এ ছাড়া সার্বক্ষণিক হটলাইনের ব্যবস্থা রাখা দরকার। ক্যাম্পাসে ছুটির দিনগুলোতে যানবাহন প্রবেশ কমিয়ে দিতে পারলে ক্যাম্পাস তূলনামূলক ভালো থাকবে।’
স্যার এ এফ রহমান হলের শিক্ষার্থী আনাস ইবনে মুনির বলেন, ‘প্রতিদিন বহিরাগতদের আগমন ও অসংখ্য যানবাহন প্রবেশের কারণে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পরিবেশ থাকে না। মেয়ে শিক্ষার্থীদের হ্যারাসমেন্ট, মাদকসেবীদের আশ্রয়স্থলসহ ঢাবি ক্যাম্পাস ঢাকার অনেকের কাছে পর্যটন স্পট। স্বল্পসংখ্যক বর্তমান ও সাবেক কিছু শিক্ষার্থী বহিরাগত নিয়ন্ত্রণের বিরোধিতা করলেও ক্যাম্পাসের বেশির ভাগ শিক্ষার্থীর চাওয়া বহিরাগত নিয়ন্ত্রণ।’
শামসুন নাহার হলের শিক্ষার্থী স্মৃতি আফরোজ সুমি বলেন, ‘ঢাকা শহরে ঘোরার মতো স্থানের স্বল্পতার কারণে অনেকেই এখানে ছুটির দিনে ঘুরতে আসেন। তাঁরা চান না বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা রেস্ট্রিক্টেড হোক। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সুষ্ঠু পরিবেশ নিশ্চিত করতে এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টি সবার বিবেচনায় নিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবেশপথগুলোতে চেকপোস্ট বসিয়ে যান চলাচল নিয়ন্ত্রণ করা উচিত।’
ক্যাম্পাস সিকিউরিটি সার্ভিস ও সিকিউরিটি বক্সের মাধ্যমে ক্যাম্পাসে যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ এবং ভারী যানবাহন প্রবেশ বন্ধ করতে চায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনও। ক্যাম্পাসে যানজট কমাতে রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন যেন পার্ক করে থাকতে না পারে সে জন্য বিশেষ নির্দেশনা দেয়া থাকবে। ক্যাম্পাসের প্রবেশপথ দিয়ে যেন ভারী যানবাহন ও ট্রাক প্রবেশ করতে না পরে সে জন্য ‘বার’ স্থাপন করা হবে বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন।
প্রক্টর বলেন, ‘ক্যাম্পাসের ভেতরে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছাড়া অন্য কাউকে সমাবেশ করতে দেয়া হবে না, যদি সেটা জাতীয় খুব গুরুত্বপূর্ণ কোনো ইস্যু না হয়ে থাকে। সেটাও অনুমতি সাপেক্ষে। কোনো ভিড়, মিছিল ঢুকতে চাইলে আমরা সেগুলো আটকাব। বিশেষ বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রয়োজনবোধে যারা ক্যাম্পাসে ঢুকতে চাইবে তাদের আইডি কার্ড চেক করা হবে, যেভাবে আমরা দুর্গাপূজার সময় করেছিলাম।’ এ ছাড়া সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঘুরতে আসা মানুষের ভিড়, উদ্যানের গেটে দাঁড়িয়ে থাকা যানবাহন ও উদ্যান এলাকায় সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের জন্য টিএসসিসংলগ্ন উদ্যানের গেট বন্ধ রাখতে গণপূর্ত অধিদপ্তর ও পুলিশের সঙ্গে আলোচনা চলছে বলে জানিয়েছেন প্রক্টর।
প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ অন্যরা ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসতে পারেন। তবে এটা যেন তাঁদের এবং বর্তমান শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ থাকে। আমরা বুঝতে পারি কে বেড়াতে আসছে আর কে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। সেটা পরিষ্কার বোঝা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সেই ‘ম্যাচিউরিটি’ আছে—কে এখানে শো-অফ করতে এসেছে আর কে অবসর সময় কাটাতে এসেছে। যে-ই আসুক, তাকে যদি আমাদের মনে হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থী, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য হুমকিস্বরূপ, তাকে আমরা এখানে অবস্থান করতে দেব না।”