বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ সময় পর প্রকাশ্যে এসেছে জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’। বিশেষ করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন নেতা ছাত্রশিবিরের সভাপতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় এনিয়ে আলোচনা আরও তীব্র হয়েছে। আবু সাদিক কায়েম গত শনিবার নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রশিবিরের সভাপতি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন।
এমন একটি সময়ে কায়েম নিজের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করলেন যখন বিশ্ববিদ্যালয়টিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র ও শিক্ষক রাজনীতি বন্ধ করার আলোচনা চলছে। এমনকি স্থায়ীভাবে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ব্যাপারেও প্রস্তাব রয়েছে। এর মধ্যেই ছাত্রশিবির নেতার পরিচয় সামনে এনে মি. কায়েম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন, যা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মহলে নানান আলোচনা-সমালোচনা হতে দেখা যাচ্ছে।
ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে আসা ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে বৈঠকে অংশ নেওয়ার ঘটনায় ইতোমধ্যেই নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপির ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় অন্য রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠনগুলো। অন্যদিকে, শনিবার নিজেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি ঘোষণা দেওয়ার আগ পর্যন্ত সাধারণ শিক্ষার্থীরা মি. কায়েমকে চিনতেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের একজন সক্রিয় নেতা হিসেবে।
ফলে তার নেতৃত্ব মেনে যারা মাঠে আন্দোলন করেছেন, তাদের অনেকেই এখন 'প্রতারিত' বোধ করছেন। আবার মি. কায়েমের পরিচয় প্রকাশ পাওয়ার পর বেশ 'অস্বস্তিতে' পড়েছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্য নেতারা।
'আমরা আগে থেকেই ছিলাম' জানিয়ে মি. কায়েম বিবিসিকে বলছেন, পরিস্থিতির কারণেই এতদিন তিনি নিজের রাজনৈতিক পরিচয় গোপন রাখতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এতদিন ছাত্রশিবির কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে পারেনি? আর এখনই-বা হঠাৎ কেন তারা প্রকাশ্যে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চাচ্ছে?
রাজনীতি বন্ধ হয়েছিল যেভাবে
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে রাজনীতি বন্ধ করা হয়েছিল এখন থেকে তিন দশক আগে। 'নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সব সংগঠন একাট্টা হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবির রাজনীতি বন্ধ করেছিল', বলেন লেখক ও গবেষক মহিউদ্দিন আহমদ।
ওই সময় ছাত্রশিবিরের সাথে জাতীয় পার্টির ছাত্রসংগঠন ‘ছাত্র সমাজ’র রাজনীতিও বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল। 'আশির দশকে স্বৈরাচার এরশাদের সহযোগী জাতীয় ছাত্রসমাজ এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের কারণে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে ছাত্র-শিক্ষক সবাই ঐক্যমতের ভিত্তিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে তাদের রাজনীতি নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল', বলছিলেন ছাত্রদলের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক নাহিদুজ্জামান শিপন।
বিশ্লেষকরা বলছেন, ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠনের নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্রসংঘ’। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বিতর্কিত ভূামিকার কারণে জামায়াতের সঙ্গে ছাত্রসংঘেরও রাজনীতি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর ১৯৭৭ খ্রিষ্টাব্দে পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছাত্রসংগঠনটি ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ নামধারণ করে পুনরায় আত্মপ্রকাশ করে।
'এরপর আশির দশকে তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এমনভাবে সক্রিয় হতে থাকে যে, বাকি ছাত্রসংগঠনগুলো তাদেরকে হুমকি হিসেবে দেখা শুরু করে', বলছিলেন গবেষক মি. আহমদ।
ওই সময়ে বেশকিছু সহিংসতা ও হত্যার ঘটনাও ঘটে। এর মধ্যে ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে হামলায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে একজন ছাত্রদল নেতা নিহত হন, যেটার জন্য ছাত্রশিবিরকে দায়ী করা হয়। ওই ঘটনার জেরে পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কর্তৃপক্ষ।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও একই পথে হাঁটে। যদিও জাহাঙ্গীরনগরের মতো আনুষ্ঠানিকভাবে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম নিষিদ্ধের ঘোষণা তখন দেয়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। 'বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ লিখিত আদেশ দিয়েছিল বলে শুনি নাই। যতটুকু জানি, শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাই একসঙ্গে বসে শিবির ও ছাত্র সমাজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে রাজনীতি না করতে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল', বিবিসি বাংলাকে বলেন লেখক ও গবেষক মি. আহমদ।
ছাত্রসংগঠনগুলো কী বলছে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের তরফে লিখিত কোনো আদেশ না দেওয়া হলেও গত ত্রিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে প্রকাশ্যে খুব একটা কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়নি ছাত্রশিবিরকে। 'তারা এটা পারেনি, কারণ বাকি ছাত্রসংগঠনগুলো পরেও তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা ছিল', বলছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে শিবিরের রাজনীতি বন্ধ করা হলেও তারা যে রাজনৈতিক দলের ছাত্রসংগঠন, সেই জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি- উভয় রাজনৈতিক দলকে একসাথে আন্দোলন করতে দেখা গেছে। এমনকি ২০০১ খ্রিষ্টাব্দে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক হয়ে মন্ত্রীও হতে দেখা গিয়েছিল জামায়াত নেতাদের। তখনও ক্যাম্পাসটিতে ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি বলে জানিয়েছেন ছাত্রদল নেতারা।
কিন্তু এখন কি তাদের অবস্থান পাল্টেছে?
'ক্যাম্পাসের সবাই মিলেই যে সিদ্ধান্তটি নেওয়া হয়েছিল, সেটি এখনও অপরিবর্তত রয়েছে। সুতরাং আমাদের অবস্থানও আগের মতোই আছে', বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক মি. শিপন। আর সেকারণেই ছাত্রশিবিরের প্রকাশ্যে আসা নিয়ে নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছে বিএনপি'র ছাত্র সংগঠনটি।
'শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলোচনা না করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন হঠাৎ যেভাবে শিবিরকে মতবিনিময় সভায় ডেকেছে, আমরা সেটি সমর্থন করি না। সেজন্য স্পষ্ট ভাষায় এর নিন্দা ও প্রতিবাদ জানিয়েছি', বলেন মি. শিপন।
একইভাবে প্রতিবাদ জানিয়েছে বামসহ অন্য দলের ছাত্রসংগঠনগুলোও। 'তারা যে মতামত নিতে শিবিরকে ডেকেছে, সেটা আমরা আগে জানতামই না। শিবির সকালে দেখা করেছে, আমরা বিকেলে', বলছিলেন বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মাঈন আহমেদ।
'তাদের ব্যাপারে যেহেতু একটা সিদ্ধান্ত আছে, কাজেই ক্যাম্পাসে এভাবে তারা (ছাত্রশিবির) হুট করে প্রকাশ্য রাজনীতি করতে পারে না', বলেন তিনি। প্রকাশ্যে রাজনীতি করতে হলে আগে ছাত্রশিবিরকে একাত্তরসহ যেসব বিষয়ে তাদের ভূমিকা নিয়ে সমালোচনা ও বিতর্ক রয়েছে, সেগুলোর ব্যাপারে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট তুলে ধরতে হবে বলে জানান মি. আহমেদ। 'এরপর শিক্ষার্থীরাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দিবেন যে, শিবির ক্যাম্পাসে রাজনীতি করতে পারবে কিনা', বলছিলেন বামপন্থী ছাত্রসংগঠনটির এই নেতা।
প্রায় একই ধরনের মতামত জানিয়েছেন বামপন্থী আরও দুই সংগঠন ছাত্র ফ্রন্ট ও ছাত্র ফেডারেশনের নেতারা। 'প্রতিবাদ জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা উপাচার্যকে এই প্রশ্নও করেছি যে, আমরা কেউ যেখানে ক্যাম্পাসে শিবির নেতাদের চিনি না, সেখানে তারা চেনেন কীভাবে? কিন্তু জবাব পাইনি', বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের (মার্ক্সবাদী) সাংগঠনিক সম্পাদক মোজাম্মেল হক।
আওয়ামী লীগের গত দেড় দশকের শাসনামলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের রাজনীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানে ছিল ছাত্রলীগ। বিভিন্ন সময়ে শিক্ষার্থীদের 'শিবির সন্দেহে' নির্যাতনও করেছে তারা। কিন্তু গণ-আন্দোলনের মুখে শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর ছাত্রসংগঠনটির নেতাকর্মীরা নিজেরাই এখন ‘আত্মগোপনে’ চলে গেছেন বলে জানা যাচ্ছে।
সাম্প্রতিক ছাত্র আন্দোলনে সংগঠনটির নেতাকর্মীদের বিতর্কিত ভূমিকাকে সামনে এনে এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতিকেও বন্ধের দাবি তুলেছে বাকি ছাত্রসংগঠনগুলো। বিষয়টি নিয়ে আওয়ামী লীগের ছাত্রসংগঠনটির কেন্দ্রীয় ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার একাধিক নেতার সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
‘আমরা আগে থেকেই ছিলাম’
প্রকাশ্যে কার্যক্রম না চালালেও ক্যাম্পাসে ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম থেমে ছিল না বলে জানিয়েছেন ছাত্রশিবিরের অন্যতম শীর্ষ এই নেতা। 'আমরা আগে থেকেই ছিলাম। ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের এত জুলুম-নির্যাতনের পরও আমরা শেষ হয়ে যাইনি', বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি আবু সাদিক কায়েম।
২০১৬-১৭ শিক্ষাবর্ষে বিশ্ববিদ্যালয়টিতে ভর্তি হওয়া মি. কায়েম সম্প্রতি রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। গত পাঁচ বছর তিনি হলে থেকেই পড়াশোনা করেছেন, গোপনে চালিয়েছেন সাংগঠনিক কার্যক্রমও। 'শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় ছাত্রলীগ ক্যাম্পাসে আমাদের নেতাকর্মীদের উপর নির্যাতন চালিয়ে যেভাবে ভয়ের সংস্কৃতি গড়ে তুলেছিলো, সেটির কারণেই আমরা এতদিন প্রকাশ্যে আসতে পারিনি', বলেন মি. কায়েম।
কোটা সংস্কার আন্দোলন শুরুর আগে খাগড়াছড়ির বাসিন্দা মি. কায়েমকে ক্যাম্পাসে অনেকে চিনতেন পার্বত্য চট্টগ্রাম ছাত্র সংসদের সাবেক সভাপতি এবং হিল সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে। তবে তিনি স্কুলজীবন থেকেই ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন বলে নিজেই জানিয়েছেন। এরপর চলতি বছরের শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতির দায়িত্ব পান।
'এখন যেহেতু ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের পতন হয়েছে, সেহেতু তারা বাদে বাকি সব সংগঠনের সঙ্গে ঐকমত্যের ভিত্তিতে ক্যাম্পাসে আমরা সুস্থ ধারার রাজনীতি করতে চাই', বিবিসি বাংলাকে বলেন শিবির নেতা মি. কায়েম।
ছাত্রশিবিরের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটির তালিকা ইতোমধ্যেই চূড়ান্ত হয়েছে জানিয়ে তিনি আরও বলেছেন, খুব শিগগিরই নামগুলো প্রকাশ করা হবে।
‘অস্বস্তিতে’ বৈষম্যবিরোধী ছাত্ররা?
শিবিরনেতা মি. কায়েম গত শনিবার নিজের রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করার পর থেকে বেশ ‘অস্বস্তিতে’ পড়েছেন বলে জানাচ্ছেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারা। 'উনি যে শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত সেটা সম্পর্কে আমার কোনো ধারণা ছিল না', বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন প্ল্যাটফর্মটির অন্যতম সমন্বয়ক আরিফ সোহেল।
অন্য সমন্বয়করাও বিষয়টি জানতেন না বলে জানিয়েছেন তিনি। 'খবরটি পাওয়ার পর কেন্দ্রীয় সমন্বয়কদের সঙ্গেও আমি যোগাযোগ করেছি। তারাও কিছু জানতো না বলে জানিয়েছে', বলেন এই সমন্বয়ক।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন প্ল্যাটফর্মটি সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছিল একটি অরাজনৈতিক ছাত্রসংগঠন সংগঠন হিসেবে। গত জুলাইয়ে আত্মপ্রকাশের সময় প্ল্যাটফর্মটি নিজেও একই দাবি করেছিল।
'কাজেই এখানে রাজনৈতিক পরিচয় গোপন করাটা ঠিক হয়নি বলে আমি মনে করি', বলছিলেন মি. সোহেল।
শিবির নেতা মি. কায়েমের বিষয়টি জানার পর সংগঠনের বাকি সমন্বয়কদের প্রতিক্রিয়া কী? তার কাছে জানতে চেয়েছিল বিবিসি বাংলা।
'বিষয়টা নিয়ে আমরা সবাই বেশ অস্বস্তিতে পড়েছি, কিছুটা বিব্রতকর অবস্থায় বলতে পারেন', বলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা।
তাহলে এখন মি. কায়েমের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত কী? তিনি কি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারবেন?
'এটা খুব শিগগিরই আমরা বাকি সমন্বয়করা বসবো। এরপর যে সিদ্ধান্তই নেওয়া হয়, সবাইকে জানিয়ে দেওয়া হবে', বলেন মি. সোহেল।
অন্যদিকে কোটা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে যারা মি. কায়েমের নেতৃত্ব মাঠে নেমেছেন, তাদের অনেকে এখন 'প্রতারিত' বোধ করছেন।
'সাদিক কায়েম ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি, এটা জানার পর চিটেড ফিল করতেছি', সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে লিখেছেন মোস্তফা সানি নামের এক শিক্ষার্থী।
প্রায় একই ধরনের অনুভূতি জানিয়ে রেখা ইসলাম নামের আরেক শিক্ষার্থী লিখেছেন, 'যত দিন যাচ্ছে, ততই অবাক হচ্ছি। জানি না সামনে আরও কত কী দেখতে হবে!'
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রশিবিরের সভাপতি মি. কায়েমের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'পরিচয় জানানোর কারণে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঐক্য যেন হুমকির মধ্যে না পড়ে, সেজন্যই গোপন রেখেছিলাম।'
কী বলছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ?
শিক্ষার্থীদের একটি পক্ষের দাবি মুখে, গত ২০ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অনির্দিষ্টকালের জন্য ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সব ধরনের দলীয় রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত নেয় বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট। তবে এ নিয়ে এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়নি বলে জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এরপর ছাত্র রাজনীতি পুরোপুরি নিষিদ্ধের যে দাবি উঠেছে, সে বিষয়ে মতামত জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সক্রিয় ছাত্রসংগঠ গুলোর নেতাদের ডাকে কর্তৃপক্ষ।
'এবারের গণ-অভ্যুত্থানে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, এমন ছাত্রসংগঠনগুলোকেই মূলত আমরা ডেকেছিলাম তাদের মতামত জানতে', বলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ।
গত শনিবারের ওই বৈঠকে যে দশটি ছাত্রসংগঠন অংশ নিয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে একমাত্র ছাত্রশিবিরকেই এতদিন প্রকাশ্যে কার্যক্রম চালাতে দেখা যায়নি।
তাহলে সংগঠনটির নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ হলে কীভাবে? 'কিছু তথ্য আমাদের কাছে আগেই ছিল', বলছিলেন মি. আহমেদ।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে অবশ্য শিবিরনেতা মি. কায়েম জানিয়েছেন, মতবিনিময় সভার ঘোষণা দেওয়ার পরপরই তিনি নিজ থেকে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। 'আন্দোলনে নিহতদের লিস্ট তৈরি ও আহতদের চিকিৎসায় কাজ করার সময়েই নতুন ভিসি স্যারের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়', বলছিলেন মি. কায়েম।
তিনি আরও বলেন, 'পরে তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন জানার পর নিজ থেকে গিয়েই আমি আমার রাজনৈতিক পরিচয় তুলে ধরি, তারপর উনি আমাকেও আমন্ত্রণ জানান।'
কিন্তু দীর্ঘদিন প্রকাশ্য রাজনীতিতে না থাকা ছাত্রসংগঠনটির বিষয়ে বাকিদের আপত্তির বিষয়ে কী বলছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন?
'প্রথম কথা হচ্ছে, ছাত্রশিবির যে ক্যাম্পাসে নিষিদ্ধ, সে ব্যাপারে লিখিত কোনো ডকুমেন্ট আমরা খুঁজে পাইনি', বলছিলেন প্রক্টর মি. আহমেদ। তিনি আরও বলেন, 'কাজেই তারা যেন বলতে না পারে যে, আমরা তাদের সঙ্গে বিনা কারণে বৈষম্যমূলক আচরণ করেছি। সেজন্যই শিবিরকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে।'
তবে ছাত্রশিবিরের ব্যাপারে বাকি ছাত্র সংগঠনগুলো যে আপত্তি জানিয়েছে, সে বিষয়টিও কর্তৃপক্ষের নজরে রয়েছে বলে বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। 'কারো উপরেই আমরা কোনো সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিবো না। সবার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করেই যেকোনো বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে', বলছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর। এছাড়া ক্যাম্পাসের শান্তি-শৃঙ্খলা ও পড়াশোনার পরিবেশ নষ্ট হয়, এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে না বলেও জানিয়েছেন প্রক্টর।
সূত্র : বিবিসি বাংলা